উল্লাসে সরগরম আল-জানুব অদেখাই থাকল জাহা হাদিদের

প্রকাশ: নভেম্বর ২৪, ২০২২

বণিক বার্তা অনলাইন

আয়োজক দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ নিয়ে কাতারের প্রস্তুতি গত এক দশকের। তার ফলাফল হিসেবে অনিন্দ্যরূপে সেজেছে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশটি। এর মাঝে সারা বিশ্বের নজর এখন দৃষ্টিনন্দন আট স্টেডিয়ামে। সেখান থেকে বিশেষভাবে বলতে হয় আল-জানুব স্টেডিয়াম ও এর রূপকারের কথা।

রাজধানী দোহার দক্ষিণে ৪০ হাজার আসনবিশিষ্ট স্টেডিয়ামটি সেখানকার ঐতিহ্যবাহী নৌকা দাউ-এর আকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত। মনোরম এ স্টেডিয়াম নির্মাণের পেছনে কাজ করেছেন নারী স্থপতি জাহা হাদিদ।

আল-জানুবে আসার আগে তিনি পাড়ি দিয়েছেন বেশ দীর্ঘ পথ। জিতে এসেছেন স্থাপত্যবিদ্যার নোবেল হিসেবে পরিচিত প্রিৎজকার পুরস্কার। 

জাহা হাদিদের জন্ম ১৯৫০ সালের ইরাকে। লেবাননের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭২ সালে লন্ডন চলে যান স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে। স্থাপত্যকেই বেছে নেন ক্যারিয়ার হিসেবে। কিছুদিন স্বাধীনভাবে কাজ করলেও ১৯৭৯ সালে লন্ডনে নিজের ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন, নাম জাহা হাদিদ আর্কিটেক্টস।

অবশ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আরো কিছু বছর অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৮৩ সালে হংকংয়ে বিখ্যাত অবকাশ যাপনকেন্দ্র দ্য পিকের নকশা প্রণয়নের জন্য পুরস্কৃত হন জাহা হাদিদ।

নকশায় জ্যামিতিক কাঠামো ব্যবহারে তিনি অন্য মাত্রা আনেন। দ্রুতই আধুনিক স্থাপত্যের ডিকনস্ট্রাকটিভিস্ট ধারার অগ্রগণ্য একজন হিসেবে পরিণত করেন নিজেকে। তারপরও প্রায়ই ‘পেপার আর্কিটেক্ট’ তকমা পেতে হয়েছে। কারণ তার নকশাগুলো আকর্ষণীয় হলেও প্রায়ই এতটাই জটিল হতো যে, বাস্তবে যার প্রয়োগ করা কঠিন।

জাহা হাদিদের আলোর মুখ দেখতে পারা প্রথম প্রজেক্ট ছিল ১৯৯৩ সালে জার্মানির রাইনে নির্মিত ভিত্রা ফায়ার স্টেশন। স্থাপনাটি দেখতে উড়ন্ত পাখির মতো। তারপর থেকে প্রতিটা কাজের মধ্যে হাদিদ নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা দেখিয়েছেন।

২০০০ সালে তিনি লুইস অ্যান্ড রিচার্ড রোজেন্থাল সেন্টার ফর কনটেমপোরারি আর্ট জাদুঘরের নকশা করেন। ২০০৩ সালে জাদুঘরের কাজ শুরু হয়, যা কোনো নারী স্থপতির নকশায় যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে প্রথম জাদুঘর।

২০১০ সালে ইতালির রোমে নির্মিত হয় ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি আর্টস বা এমএ টুয়েন্টি ফার্স্ট জাদুঘর। এর নকশা জাহা হাদিদকে তারকা খ্যাতি এনে দেয়। রয়েল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (আরআইবিএ) থেকে লাভ করেন স্টারলিং পুরস্কার। লন্ডনেই একটা স্কুলের নকশা প্রণয়ন করে একই পুরস্কার পান দ্বিতীয়বারের মতো।

২০১২ সালে আজারবাইজানের বাকুতে হায়দার আলিয়েভ সেন্টার নির্মিত হয় তার প্রণীত নকশায়, যা শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে পুরস্কৃত হয় লন্ডন ডিজাইন মিউজিয়াম থেকে। প্রথম নারী হিসেবে এই সম্মাননা গ্রহণ করেন হাদিদ।

এ ছাড়া ২০১২ সালে অলিম্পিকের জন্য লন্ডনের অ্যাকুয়াটিক সেন্টার, মিশিগানের দ্য এলি অ্যান্ড এডিথ ব্রড আর্ট মিউজিয়াম এবং হংকং পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটিতে জকি ক্লাব ইনোভেশন টাওয়ার নির্মাণে তার মুনশিয়ানা দেখা যায়।

জাহা হাদিদের কাজের ছাপ ছড়িয়ে আছে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটিতেও। এমনকি গয়না, আসবাবপত্র, জুতা ও ব্যাগেরও ডিজাইন করেছেন তিনি।     

অবশ্য কিছুটা সমালোচনা যুক্ত হয়েছে তার ক্যারিয়ারে। যেমন; ২০১৪ সালে কাতারে আল-জানুব স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় শ্রমিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তার নকশা নিয়েও কথা হয়।

অল্প-বিস্তর সমালোচনা ছাপিয়ে তিনি নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করেছেন। প্রিৎজকার পুরস্কারের বাইরেও লাভ করেছেন বহু আন্তর্জাতিক সম্মাননা। ২০০৯ সালে জাপান আর্ট অ্যাসোসিয়েশন তাকে প্রদান করে প্রাইমিয়াম ইম্পেরিয়ালে পুরস্কার। ২০১৬ সালে আরআইবিএ থেকে পান সর্বোচ্চ সম্মাননা রয়েল গোল্ড মেডেল। ২০১২ সালে তাকে ডেম কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (ডিবিএ) খেতাব দেয়া হয়। এছাড়া হাদিদ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার সম্পাদনা পরিষদের সদস্য ছিলেন।  

এমন সব বর্ণাঢ্য নির্মাণ ও অর্জনের মাঝেই ২০১৬ সালে মারা যান জাহা হাদিদ। তখনো অনেক কাজই অসমাপ্ত অবস্থায়। দেখে যেতে পারেননি আল-জানুব স্টেডিয়ামের নির্মাণ।

হার্ট অ্যাটাকে হাদিদের মৃত্যুর পর তার ব্যবসায়িক পার্টনার প্যাট্রিক শুমাখ্যার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার হাতেই শেষ হয় আল-জানুব স্টেডিয়ামের বাকি কাজটুকু। আর কিছু না হোক; বিশ্বকাপে আল-জানুব স্টেডিয়ামে দর্শকদের উল্লাসের মাঝেই বেঁচে থাকবে জাহা হাদিদের মেধা। যা পরবর্তী প্রজন্মের স্থপতিদের অনুপ্রাণিত করবে।    


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫