অভিমত

কী শিক্ষা কেন শিক্ষা

প্রকাশ: নভেম্বর ২৪, ২০২২

রহমান মৃধা

বিশ্বে অনলাইন ব্যবসার সুবিধার্থে প্রচুর পরিমাণ গুদাম ঘর তৈরি করা হচ্ছে। গুদাম ঘর কী? যেখানে উৎপাদিত মালপত্র সংরক্ষিত করা হয় তাকে গুদাম ঘর বলে। গুদামে জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা হয় মূলত ক্রেতাকে তার চাহিদামতো জিনিস সময়মতো পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে, যাকে বলা হয় ‘জাস্ট ইন টাইম ডেলিভারি।’

এখন ক্রেতা অর্ডার করল জুতার, বিক্রেতার গুদামে জুতা নেই আছে স্যান্ডেল, দিল সেটা পাঠিয়ে। ক্রেতা অবাক! শুরু হলো সমস্যা। ফোন করা, সেটা সম্ভব না হলে ই-মেইল করা। দ্বি-মতের কারণে সেটা ফেরত দেয়া, নতুন করে অন্য কোথাও অর্ডার দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। কী হলো বিষয়টা? জাস্ট ইন টাইম ডেলিভারি হয়তো হয়েছিল কিন্তু যেটা অর্ডার করা হয়েছিল সেটা না পাওয়ার কারণে কোনো কিছুই মনঃপূত হয়নি। কারণ চাহিদা অনুযায়ী যদি কিছু উৎপাদন না করা হয় তখন সেটা গুদামজাত করে রাখা ছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে অন্য কোনো উপায় থাকে না। এভাবে বিশ্বের অনেক দেশে ভূরি ভূরি গুদাম ঘর রয়েছে যেখানে মালপত্রের অভাব নেই, অভাব ক্রেতার।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে চলেছে, কমিটমেন্ট ছাড়া তৈরি হচ্ছে শিক্ষার্থী, ক্রেতার অভাবে বেকার হয়ে বাবা-মার হোটেলে শুয়ে-বসে দিন-রাত কাটছে অনেকের।

সঠিক শিক্ষার জন্য বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে যে পরিবর্তনের দরকার তার ওপর ভিত্তি করে এখানে আরো নতুন কিছু তথ্য সংযোজন করলাম। বিশেষায়িত শিক্ষক, প্রশিক্ষণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। তাই সঠিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়া খুবই দরকার। আর দেরি নয়। বাংলাদেশে সঠিক শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে অতিসত্বর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন, বিশেষ করে প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি লেভেলের শিক্ষার ওপর এবং তা হতে হবে অত্যন্ত কোয়ালিটিসম্পন্ন। এখানে বেসিক শিক্ষাটার ওপর অনেক জোর দিতে হবে, সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শেখা এবং বোঝার জন্য শিক্ষা, এমন প্রভাব বিস্তার করতে হবে। যারা শিখছে তাদের কাছে থেকে সরাসরি শেখার এবং সরাসরি কাজ করার মাধ্যমে শেখার প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, যাকে বলা হয় Learning from Learners and Learning by Doing.

কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা হতে হবে চাহিদা অনুযায়ী। কয়েকটি উদাহরণ: শিল্প পক্ষত্রে কী পরিমাণ শ্রমিক প্রয়োজন হতে পারে আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে, দেশের চাহিদা মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে বহির্বিশ্বে কী পরিমাণ রফতানি করার ইচ্ছে রয়েছে, ৫-১৫ বছরের মধ্যে তার ওপর নির্ভর করে চাহিদা ও মানসম্পন্ন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে হবে, বাড়াতে হবে বা অ্যাডজাস্ট করতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে কতজন ডাক্তারের প্রয়োজন, বাংলাদেশে এবং আগামী ৫-১৫ বছরের মধ্যে কী পরিমাণ ডাক্তার রফতানি করার প্ল্যান রয়েছে এবং কোন কোন দেশে? এগুলো ভাবতে হবে। এ ধরনের চিন্তাধারার সঙ্গে মিল রেখে গ্লোবাল চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা পদ্ধতিকে সবসময় সমন্বয় করতে হবে। কেউ হয়তো পড়াশোনা করছে রসায়নে অথচ চাকরি করছে ব্যাংকে। কারণ, চাহিদা অনুযায়ী তার লেখাপড়া হয়নি বা হচ্ছে না বিধায় সে বেকার। লেখাপড়ার পেছনে কোনো পরিকল্পনা না থাকায় বেশির ভাগ সময় মানসম্পন্ন বা যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। এতে হচ্ছে দেশের শিক্ষার এবং শিল্প ক্ষেত্রের অবনতি। একটি উদাহরণ, দেশে দরকার ধানের কিন্তু আমরা পাট তৈরি করছি, এখন বিদেশে সেটা রফতানি করা যাচ্ছে না কারণ হয় চাহিদা নেই বা মান ভালো নয় অন্য দেশের তুলনায় তাই প্রচুর স্টক জমা হয়ে রয়েছে যা পরে নষ্ট বা বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। বলতেই হয় বাংলাদেশ একটা মানুষ উৎপাদনের কারখানা যেখানে মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে সময়ের সঙ্গে এবং তাকে আর কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না, তখন তারা বেছে নিচ্ছে খুনখারাবি, রাজনীতি বা ধর্মের ওপর হৈচৈ যা ঠেলে দিচ্ছে সমাজকে অন্ধকারের দিকে। ওপরের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল করলে বলতে হয় এক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব এবং তাদেরও যথাযথ জ্ঞান থাকা দরকার। সবাইকে কম-বেশি শিক্ষার সঙ্গে দৈনন্দিন জড়িয়ে থাকতে হবে। একইভাবে শিল্পপতি এবং অভিভাবকেরও সজাগ থাকতে হবে কী প্রয়োজন এবং কী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে জানতে হবে।

এ পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ বেকার যুবক সমাজ এবং ধর্মকে বানাবে হাতিয়ার এবং ধর্মের অপব্যবহার করবে। বেকারত্ব বাড়বে এবং বাড়ছে। সরকারি সুবিধা পাবে কিছুসংখ্যক মানুষ। ধর্মীয় গোড়ামি বাড়তে থাকবে দিন দিন। সামাজিক অনাচার বাড়বে। অন্যায্যতা বাড়বে। বাড়বে ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা। কমবে সু এবং সঠিক শিক্ষিতের সংখ্যা। কিছুসংখ্যক লোক ধনী থেকে আরো ধনী হবে।

ব্রিটিশ বা পাকিস্তানিরা যেমন শোষণ করেছিল তেমনটি হতে থাকবে, যা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে কিছুসংখ্যক লোকের মধ্যে। আমাদের ভাগ্য, আমাদের চিন্তাধারা আমাদেরই কিছু করতে সাহায্য করবে যদি আমরা সঠিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাই। না হলে বহির্বিশ্বের কিছু লোক চুক্তি করবে এদেশের কিছু লোকের সঙ্গে, করবে ব্যবসা যেমন গার্মেন্টসের মতো বাণিজ্য আর গড়বে প্রাচীর, সঙ্গে কলুর বলদের মতো সারা জীবন খাটবে দেশের মেহনতি মানুষ। চিন্তাশক্তির যাতে লোপ পায় তার জন্য বিদেশী কূটনীতিকরা সারাক্ষণ সরকারকে ব্যস্ত রাখবে দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অরাজকতার মধ্য দিয়ে। তাই এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হবে সঠিক শিক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দেশবাসী এবং সরকারকে অতিসত্বর হাত বাড়াতে হবে পরিবর্তনের জন্য, চালু করতে হবে এ বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

রহমান মৃধা: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫