গত দুই দশকে বাংলাদেশে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণের পরিসর বেড়েছে। নগরায়ণ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রভাব মানুষকে অতিমাত্রায় প্লাস্টিক ব্যবহারে আগ্রহী করে তুলেছে। ফলে গত দুই দশকে শহরাঞ্চলে জনপ্রতি প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিনগুণের বেশি। গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু রাজধানীতে প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে তার সিংহভাগই অভিজাত এলাকাগুলোর। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ক্ষতিকর এসব প্লাস্টিক বর্জ্য গিয়ে মিশছে পরিবেশে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন নাগরিকরা।
বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘টুওয়ার্ডস এ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে দৈনিক উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের সবচেয়ে বড় উৎস উচ্চ আয়ের মানুষের আবাস অভিজাত এলাকাগুলো।
রাজধানীর ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, বারিধারা ও বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকার রাস্তার পাশে যে ময়লার বিনগুলো রয়েছে, সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বেশি। বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন ও প্লাস্টিকের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এসব বর্জ্য সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কর্মীরা রাত-দিনে নির্দিষ্ট সময়ে এসে ঢাকনাযুক্ত ট্রাকে করে ময়লার ভাগাড়ে (ল্যান্ডফিল) নিয়ে যান। দুই সিটি করপোরেশনের অভিজাত এলাকার অন্তত দুটি জলাধার ও পার্কের এখানে-সেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য দেখা যায়। লেকের পানিতে ভেসে থাকছে এসব প্লাস্টিক। একসময় পানিতে ডুবে গিয়ে জলাধারের তলদেশে প্লাস্টিকের আস্তরণ তৈরি করছে। আর পার্ক, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা প্লাস্টিক মাটিতে মিশে গেলেও বছরের পর বছর অক্ষত থেকে যাচ্ছে।
জরিপের ভিত্তিতে তৈরি ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে বছরে জনপ্রতি নয় কেজি প্লাস্টিক উৎপাদন হলেও রাজধানীতে তা ২২ কেজির ওপরে। রাজধানীতে দৈনিক সাড়ে ছয় হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়, যার ১০ শতাংশই প্লাস্টিক বর্জ্য। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অভিজাত এলাকা থেকে উৎপাদিত বর্জ্যের মধ্যে ১৬ দশমিক ৪ শতাংশই হলো প্লাস্টিক বর্জ্য। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) এটি ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ডিএনসিসির মধ্যম আয়ের এলাকায় মোট উৎপাদিত বর্জ্যের ১৩ শতাংশ ও নিম্ন আয়ের এলাকার ৬ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য। আর ডিএসসিসির মধ্যম আয়ের এলাকায় উৎপাদিত বর্জ্যের ১২ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য, যা নিম্ন আয়ের এলাকায় ৬ শতাংশ। মূলত নিম্ন আয়ের এলাকাগুলোয় উৎপাদিত বর্জ্যের বড় অংশই শাকসবজি ও খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ। এর পরিমাণ মোট উৎপাদিত বর্জ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ।
ধনী এলাকায় প্লাস্টিকের সর্বোচ্চ ব্যবহারের কারণ হিসেবে ক্রয়ক্ষমতাকে দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লেনার্সের সভাপতি ফজলে রেজা সুমন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা গেলেও বাকিগুলো প্রকৃতিতেই ছড়িয়ে পড়ছে। এসব প্লাস্টিক নগরের পানি নিষ্কাশন, পয়োনিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না। সুপার মার্কেট ও ধনী এলাকায় প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার বেশি। এসব এলাকায় প্যাকেটজাত বিভিন্ন পণ্যের বিক্রি বেশি। উচ্চবিত্তরা বাজার থেকে প্রতিটি পণ্যের সঙ্গে প্লাস্টিক পাত্র ও পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করেন। সরকারিভাবে প্লাস্টিকের বিষয়ে সতর্কীকরণ ও নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ। দিন দিন প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়লেও সে তুলনায় করা হয়নি পুনর্ব্যবহারের ব্যবস্থাপনা। ফলে এসব প্লাস্টিক প্রকৃতিতে কোনো বাধা ছাড়াই থেকে যাচ্ছে।
মৃত্তিকা গবেষণা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমীর মো. জাহিদ বণিক বার্তাকে বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য মাটিতে মিশে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে। প্লাস্টিক সহজে দ্রবীভূত হয় না। ফলে মাটির মধ্যে প্লাস্টিক মিশে গাছপালা বা ফসলের শেকড়ের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে। আবার প্লাস্টিক মাটিতে জমা হওয়ার কারণে মাটির মধ্যে স্বাভাবিক বাতাস ও পানি চলাচল ব্যাহত হয়। এতে মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ নষ্ট হয়। এছাড়া ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক দীর্ঘমেয়াদে মাটিতে বিষাক্ত পদার্থ নিঃসৃত করে, যা ভূমধ্যস্থ পানি বা নিকটস্থ পানির উৎসে মিশে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। আবার প্লাস্টিক দ্রব্যে নানা রকমের রঞ্জক পদার্থ মেশানো হয়, যা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে পরিশেষে মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
করোনা মহামারী শুরুর পর গত দুই বছর ঢাকায় প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে। বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য পলিথিন ও প্লাস্টিক ছিল প্রথম সারিতে। খাবারের মোড়ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবারের মোড়ক ছিল বেশি। এছাড়া মাস্ক, হাতের গ্লাভস ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করেছে। এসব বর্জ্যের প্রায় সিংহভাগ মাটি ও পানিতে থেকে গিয়েছে।
প্লাস্টিক বর্জ্য মানবদেহে অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগের জন্ম দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ক্যান্সারের জন্য প্রধানতম কারণগুলোর মধ্যে প্লাস্টিক অন্যতম। প্লাস্টিকের ছোট ছোট কণা বাতাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। খাদ্যের মাধ্যমেও মানুষের শরীরে যাচ্ছে। এতে কিডনি ও লিভার অকেজো হওয়ার মতো ঝুঁকি রয়েছে।
জানা যায়, বর্জ্য সংগ্রহের জন্য ডিএনসিসির ৪২৬টি নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে। আর ডিএসসিসিতে বর্জ্য সংগ্রহে নির্দিষ্ট করা হয়েছে ২২৯টি স্থান। নির্দিষ্ট করা স্থান ছাড়াও তিন শতাধিক খোলা বর্জ্য সংগ্রহের স্থান রয়েছে। তবে এর বাইরে দুই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন খালের তীরসহ সহস্রাধিক হটস্পট রয়েছে, যেগুলো থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় না। ঢাকার চার নদীর অন্তত ১২৯টি স্থানে বর্জ্য খোলা অবস্থায় রাখা হয়। রাজধানীতে উৎপাদিত প্লাস্টিকের মাত্র ৩৭ শতাংশ পুনরায় ব্যবহূত হয়। প্লাস্টিক বর্জ্যের ৪৮ শতাংশ মাটিতে, ১২ শতাংশ খাল ও নদীতে এবং ৩ শতাংশ নালায় গিয়ে মেশে। মাটিতে পড়া প্লাস্টিকের বড় অংশ পলিথিন ব্যাগ, পণ্যের মোড়ক ও প্যাকেট।
বিশ্বব্যাংক বলছে, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ছয় ধরনের প্লাস্টিকের ৬৪৬ টন বর্জ্য প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য, পাতলা নমনীয়, খাদ্যের প্যাকেট জাতীয় (এলডিপিই) প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে ৩২৩ টন। যদিও ১৭৪ দশমিক ৪ টন ময়লার ভাগাড়ে পৌঁছে। বাকি ৪৬ শতাংশ ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে যায়। পানির বোতল, কোমল পানীয়ের বোতল, ওষুধের বোতল জাতীয় (পিইটি) প্লাস্টিক বর্জ্য ১০০ টন উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৪ টন বর্জ্য সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ময়লার ভাগাড়ে পৌঁছে। আইসক্রিম, ওষুধ-সাবানের মোড়ক, দুধের বোতল, পুতুল ও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের মোড়ক বা বক্স জাতীয় (এইচডিপিই) প্লাস্টিক বর্জ্য ৬৫ টন। পানির ট্যাংক, বোতলের ক্যাপ, প্লাস্টিকের ফুল ইত্যাদি জাতীয় প্লাস্টিক (পিপি) ১০০ টন। পানির পাইপ, পুতুল ও শ্যাম্পুর বোতল জাতীয় প্লাস্টিকের (পিভিসি) বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে ৩২ টন। আর একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের প্লেট ও গ্লাস জাতীয় (পিএস) প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয় ৩২ টন।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে বলে দাবি করেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোয় বছরে মাথাপিছু দেড় থেকে আড়াই কেজি বর্জ্য উৎপাদন হয়। দেশে এ হার অনেক বেশি। প্লাস্টিক ও মেডিকেল বর্জ্যের ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। আরো আধুনিক ব্যবস্থাপনার জন্য ভূগর্ভস্থে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কাজ চলছে। যেসব খালে ময়লা ফেলা হচ্ছে ও দখল রয়েছে, সেগুলো মুক্ত করতে কাজ চলছে।