আলোকপাত

দক্ষতা, মেধা ও প্রতিযোগিতার ওপর ‘বাজার অর্থনীতি’ দাঁড়াচ্ছে না

প্রকাশ: অক্টোবর ০৫, ২০২২

ড. আরএম দেবনাথ

উন্নয়ন, দেশের উন্নয়ন কে না চায়, কিন্তু চাইলেই তো হবে না। উন্নয়নের কাজটা কে করবে? সাধারণ মানুষ, শ্রমিক শ্রেণী, কৃষককুল, উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা? ব্যাপারে একেক দেশের অভিজ্ঞতা একেক রকমের। পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি, কল্যাণকামী অর্থনীতি ইত্যাদির কথা আমরা সবসময়ই শুনি, কিন্তু মূল প্রশ্ন কোন পথে হবে উন্নয়ন? পথ পন্থা নিয়ে পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-৭১) আলোচনা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ-পন্থা অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা ছিল। আমার মনে আছে, ১৯৬৫-৬৬ সালের দিকে আমরা তখন বাণিজ্যের (কমার্স) ছাত্র তখন আমাদেরকে চারটি দেশের অর্থনীতির অভিজ্ঞতা পড়ানো হতো। স্যারদের জিজ্ঞেস করলে বলতেন, বাণিজ্যের ছেলেমেয়েদের অর্থনীতি পড়া দরকার। কারণ বাণিজ্য হচ্ছে ফলিত অর্থনীতি (অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকস) অর্থনীতি শুধু পড়লেই হবে না, তার নীতিমালা বাজারে কীভাবে কাজ করে তা জানা দরকার। ব্যবসা কীভাবে সংগঠিত করতে হয়, মালিকানা কীভাবে ব্যবসাকে প্রভাবিত করে, ব্যবসা ক্ষেত্রে আইন-কানুন কী কী আছে, হিসাবপত্র কীভাবে রাখতে হয়, কীভাবে নিরীক্ষণ চালাতে হয়, উৎপাদিত পণ্যের খরচ কত, পণ্য বাজারজাতকরণ কীভাবে হবে, পরিবহন, গুদামজাতকরণ ফাইন্যান্স কীভাবে জোগাড় হবে, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা কীভাবে হবে, সবই জানতে হয়। শুধু চাহিদা সরবরাহ তত্ত্ব জানলে চলে না। স্যারেরা এসব বলতে বলতে চলে যেতেন অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে। মনে আছে চারটি দেশের অর্থনীতি এবং তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের পড়ানো হতো। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জাপান। তখনকার দিনে ওই দেশ চারটিই ছিল সবচেয়ে উন্নত। ঢাকার বাজার ছিল জাপানি পণ্যে বোঝাই। ইলেকট্রনিকস, জামাকাপড় থেকে শুরু করে কিনা ছিল। আজকের ভারত চীন কোনো আলোচনাতেই ছিল না। ভারতকে বলা হতো হাতির মতো শ্লথ গতির দেশ, আর চীন হচ্ছে ড্রাগনের দেশ। উন্নত বা উন্নয়নের ছোঁয়া তখনো তাদের গায়ে লাগেনি। ইংল্যান্ড বা যুক্তরাজ্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে পুরনো। তাদের দেশের প্রাথমিক পুঁজি এসেছে ভূমি থেকে, আর এসেছে উপনিবেশ থেকে। লুণ্ঠন করা টাকা। বণিক নাবিকরা তাদের দেশে উন্নয়নে নেতৃত্ব দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল ইমিগ্র্যান্ট ইহুদি বণিকেরা। এদের ছিল ব্যবসায়িক বুদ্ধি, ছিল অফুরন্ত পুঁজি। আবার বহু প্রবাসী ইউরোপ থেকে যায়, উন্নয়নে গতি সঞ্চার করে তারা। রাশিয়া বা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা। যুক্তরাজ্য আমেরিকার মাধ্যম ছিল পুঁজিবাদ। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পথ ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। তারা পরিকল্পিত উন্নয়নের পথ ধরে। সমাজতন্ত্রই তাদের পাথেয়। ভারী শিল্পের পথ তাদের উন্নয়নের মাধ্যম। রাষ্ট্র পুঁজি, ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করে। তারা ব্লেড তৈরি না করলেও চাঁদে যায় ঠিকই। জিনিসপত্রের মূল্য সরকার নির্ধারিত। শ্রমিকদের শাসন। তাদের একনায়কত্ব। ভিন্ন এই পথে তারাও শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়। এদিকে পুবের দেশ হচ্ছে জাপান। সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যবস্থাপনা নীতি অনুসরণ করে তারা অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করে। পুঁজি সরবরাহ এবং উদ্যোক্তা সরবরাহ ঘটে কিছুসংখ্যক পরিবার থেকে। টয়োটা, ইয়ামাহা ইত্যাদি তার উদাহরণ। জাপানে কেউ চাকরিতে ঢুকলে চাকরি আর যেত না। লাইফ লং এমপ্লয়মেন্ট বা পশ্চিমা ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জাপান এখন ম্রিয়মাণ অর্থনীতির দেশ। এখন এগিয়ে যাচ্ছে উদীয়মান দেশের অর্থনীতিগুলো। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি দেশই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বিশেষ করে চীন এবং এর পরই রয়েছে ভারতের নাম। চীন জাতি এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, ভারত পঞ্চম। চীন বস্তুত একটা চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত। তারা কম্যুনিস্ট শাসিত সমাজতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিত। কিন্তু বাজার অর্থনীতি তাদের পাথেয়। ভারত, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশেরও তা, আমাদেরও তা। চীন যে নীতি গ্রহণ করে আজকের সাফল্য এসেছে তার কেন্দ্রবিন্দুতে একটি কথা। কিছু লোককে ধনী হতে দাও, তারা ঝুঁকি কমাক। তারাই উন্নয়নের চাবিকাঠি হবে। ফলে দেখা যায় বর্তমান চীনে শতকোটি ডলারের মালিক অগনিত। বড় বড় ব্যবসায়ী হাউজের জন্ম হয়েছে। তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়াও তাই।

এসব দেশে উন্নয়নের চাবিকাঠি পরিবারভিত্তিক বড় বড় কোম্পানির হাতে। প্রতিবেশী ভারতও তাই। ভারতের উদ্যোক্তাদের অবশ্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাদের ধর্মীয় সমাজে বৈশ্য (ট্রেডিং কমিউনিটি) বলে একটা সম্প্রদায় আছে যাদের ঐতিহ্যই ব্যবসা। আদানি আম্বানিরা গুজরাট সম্প্রদায়ের লোক। সেখানে রয়েছে মেমন সম্প্রদায় এবং ফার্সি সম্প্রদায়ের লোক। তারাও ভালো উদ্যোক্তা। বড় পুঁজির মালিক। বস্তুত ভারতের শিল্পায়নের ভার তাদের হাতেই। বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতেই উন্নয়নের চাবিকাঠি। তারা বিশ্বে ঠেক্কা দিয়ে ব্যবসা করছে। বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে তারা আছে। বস্তুত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনীদের মধ্যে আমেরিকা, চীন, জাপান ভারতীয়রাই কর্তৃত্ব করে। এর মধ্যে দেখা যাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রবাসীরাও ভালো ফল করছে। বিভিন্ন কারণে দেশচ্যুত ব্যবসায়ীদের অনেকেই ব্যবসায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে ধন-সম্পত্তি, শিল্প-কারখানা, কারিগরি প্রতিষ্ঠান, টেকনোলজিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি চলে যাচ্ছে কিছু পরিবারের হাতে। বাজার অর্থনীতির মধ্যেই। ব্যক্তিগত খাতের উদ্যোক্তারাই ঘটাচ্ছেন উন্নয়ন। উন্নয়নের চাবিকাঠি কৃষক-শ্রমিক-মজদুর-মধ্যবিত্তরা নন। এরা বড় জোর ভোক্তা।

আমাদের বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কী? বাংলাদেশের বৃহত্তর সমাজে বৈশ্য বলে কোনো সম্প্রদায় নেই। তাই তাদের কাছ থেকে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা আসার সম্ভাবনা নেই। কৃষি খাত থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে শিল্পে আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এখানে বড় ধরনের জমিদার শ্রেণী নেই যা ছিল ১৯৪৭ সালে, দেশ বিভাগের পর তা বিলীন হয়ে যায়। পাকিস্তান আমলেও আমাদের কোনো বড় উদ্যোক্তা শ্রেণী ছিল না। সরকারি মদদে কেউ কেউ শিল্পের মালিক হয়েছিলেন সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন-এর সৌজন্যে। স্বাধীনতার পর সেসব পাটকল বস্ত্রকল রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে চলে যায়। বড় ধনী যারা ছিলেন তারা ছিলেন বড়জোর কনট্রাক্টর, জমির ব্যবসায়ী। ব্যাংক-বীমা-বৃহৎ শিল্প, যা কিছু ছিল তা পশ্চিম পাকিস্তানিদের (বর্তমান পাকিস্তানি) মালিকানাধীন ছিল। স্বাধীনতার পর সেগুলো জাতীয়করণ করা হয়। অতএব শূন্য থেকে বাংলাদেশে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে ব্যাংক হয়, তারপর বীমা এবং নন-ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন। পাকিস্তান আমলের মাঝারি ধরনের ধনীরা এসবের মালিকানা পান। সরকারি ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংকের উদার ফাইন্যান্সিংয়ে ধীরে ধীরে একটা শ্রেণী তৈরি হতে থাকে। জমির ব্যবসা, ম্যানপাওয়ারের ব্যবসা, ছোট ছোট আমদানি-রফতানি ব্যবসা, হুন্ডি ব্যবসা, সীমান্ত ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে যাত্রা হয় তাও নব্বই দশকের শেষের দিক থেকে। নতুন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের উৎস কী?

তারা কী কৃষি খাত থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে শিল্প/ব্যবসায় এসেছেন না। এদের অনেকেই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। আবার কেউ কেউ সরকারি দলের বা সরকারের মদতপুষ্ট লোকজন। দক্ষতা, মেধা, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদের উত্থান এটা হলফ করে বলা যাবে না। একসেস টু পাওয়ার আমাদের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকের লাইসেন্স, বীমার লাইসেন্স, বেসামরিকীকরণকৃত শিক্ষা-কারখানা সরকারি দলের লোকরাই পেয়েছে। অবশ্য তৈরি পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে নিতান্তই কোটার সহায়তায়। এখানে প্রতিযোগিতার কোনো ব্যাপার ছিল না। ম্যানপাওয়ারের ব্যবসায়ও মধ্যপ্রাচ্য-কানেকশন কাজে লেগেছে। সমগ্র বিষয়টি বিচার করলে বোঝা যাবে শিল্পায়ন ব্যবসার উন্নতির ক্ষেত্রে সরকারের নীতি হচ্ছে কিছু লোককে টাকা ধরিয়ে দেয়া, কিছু লোককে ধনী, অতিধনী বানানো। একে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বলা যায়। বাজার অর্থনীতি মুখের কথা! সরকার ব্যবসা করবে না। সরকার অবকাঠামো জোগান দেবে। মুখে কথা বলা হলেও কার্যত ব্যবসায়ীদেরকে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি দেওয়া হয়। বস্তুত এখানে এমন দাঁড়িয়েছে, লাভ ব্যবসায়ীর, লোকসান সরকারের। কম সুদে ঋণ, উদার ব্যাংকঋণ, সুদ মওকুফ, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি, ভর্তুকিতে ঋণ প্রদান, করহ্রাস, কর মওকুফ, কর অবকাশ থেকে শুরু করে এমন কোনো সুযোগ নেই যা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দেয়া হচ্ছে না। যুক্তি উন্নয়ন। দেখা যাচ্ছে উন্নয়নের সব বোঝা সরকারের ওপর। যে বাজার অর্থনীতি দক্ষতা, মেধা, প্রতিযোগিতা কর্মক্ষমতার ওপর দাঁড়ানোর কথা ছিল তা হচ্ছে না। প্রকল্প প্রণয়ন, প্রকল্প গ্রহণ, বিদেশী ঋণ গ্রহণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বড় বড় মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রেই একটি বিষয় দৃশ্যমান, আর তা হলো সরকারি পেট্রোনেজ। মানুষের হাতে, কিছু লোকের হাতে টাকা ধরিয়ে দেয়া। কিছু লোকের হাতে ব্যাংকিং-আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ খাত, পরিবহন খাত তুলে দেয়া, এসব কারণে দেশ আজ ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। বাংলাদেশীদের কেউ কেউ বিদেশে শ্রেষ্ঠ ধনী, অতিধনী, কোন আইনে তা বোধগম্য নয়। দারিদ্র্য বেশ হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে নগর দারিদ্র্য। প্রকট দারিদ্র্য। আঞ্চলিক বৈষম্য চরমে। শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। নকলে ভর্তি বাজার। কোনো মানসম্মত জিনিসপত্র বাজারে পাওয়া মুশকিল। চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসার কথা ছিল তা নয়। ৬০-৭০ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। সরকারের রাজস্ব বাড়ে না। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত আয়কর এবং ভোগ কর দিতে দিতে পাগলপ্রায়। প্রচণ্ড মূল্যস্ফীতির শিকার এখন। দেশ থেকে সমানে পাচার হয়ে যাচ্ছে অর্থ-সম্পদ। উচ্চবিত্ত, ধনী অতিধনীরা কেউ দেশে থাকতে চায় না। প্রায় সবারই বাড়ি-ঘর বিদেশে। বাজেট বড় হচ্ছে, আর বাড়ছে সামাজিক সুরক্ষা বরাদ্দ এর অর্থ অভাবী মানুষের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। অবস্থায় কী আমাদের নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার নয়। ক্ষুদ্র-মাঝারি-ছোট-অতিছোট উদ্যোক্তার সংখ্যা কী বাড়ানো যাবে না?

 

. আরএম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫