নিঃশব্দেই বাড়ে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা

প্রকাশ: অক্টোবর ০৩, ২০২২

আমাদের দেহের কোষসমূহ আন্তকোষীয় পদার্থের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বিভিন্ন রকম লিপিড। নির্দিষ্ট পরিমাণ লিপিড (কোলেস্টেরল) যেমন জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে, তেমনি লিপিডের কোনো এক বা একাধিক উপাদানের মাত্রা কম-বেশি হলে তা অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়। এখন এটা প্রতিষ্ঠিত যে রক্তে অস্বাভাবিক মাত্রায় লিপিডের উপস্থিতি হূদরোগ রক্তনালির অসুখের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

রক্তের লিপিডের পাঁচটি উপাদানের মধ্যে টাইপ- ডায়াবেটিসে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়, এইচডিএলের (উপকারী কোলেস্টেরল) পরিমাণ কমে যায়। তবে এলডিএলের (অপকারী কোলেস্টেরল) পরিমাণ প্রায় স্বাভাবিক থাকে। যাদের ডায়াবেটিস হূদরোগ নেই তাদের জন্য রক্তে এলডিএলের নিরাপদ মাত্রা ১৩০ মিলিগ্রাম/ডিএলের কম এইচডিএল ৪০ মিলিগ্রাম/ডিএলের ওপরে। আর যাদের ডায়াবেটিস আছে (অথবা কোনো রকম হূদরোগ আছে) তাদের রক্তে এলডিএল ৭০ মিলিগ্রাম/ডিএলের কম এইচডিএলের পরিমাণ ৪০ মিলিগ্রাম/ডিএলের বেশি।

খাদ্যাভ্যাস আর জীবনযাত্রার কারণে কোলেস্টেরল বাড়ছে কথা সবাই জানেন। তবুও সচেতনতা বাড়ছে না। শরীরে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে গেলে দেখা দেয় একাধিক সমস্যা। সামান্য হেঁটেই যদি পা ব্যথা হয় তাহলেও কিন্তু সাবধান। হতে পারে কোলেস্টেরলের সমস্যা।

কোলেস্টেরল মানেই যে ক্ষতিকর, তা কিন্তু নয়। বরং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ কোলেস্টেরলের প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যাটা হয় দেহে কোলেস্টেরলের পরিমাণটা রেড়ে গেলে। তখন তা হূদরোগজনিত অসুস্থতার কারণ হয়ে ওঠে। দেহের কোলেস্টেরলের মাত্রা কত, তা একমাত্র রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই জানা যায়। আর রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলেই চিকিৎসকরা কোলেস্টেরল কমানোর জন্য ওষুধ দিয়ে থাকেন।


কোলেস্টেরল কমাতে সত্যিই কি ওষুধ খাওয়া উচিত: চিকিৎসকদের মতে প্রথমেই ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে প্রথমেই দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। এর সঙ্গে নিয়মিত শরীরচর্চারও প্রয়োজন। কিন্তু তার পরও যদি তেমন কোনো উন্নতি না হয় তখনই ওষুধের কথা ভাবেন চিকিৎসকরা। আর সেই ওষুধ রোগীর কোলেস্টেরলের মাত্রা তার অন্যান্য শারীরিক সমস্যার বিষয়ে বিস্তারিত জেনেবুঝে তবেই দেয়া হয়। তার আগে চিকিৎসক জানতে চান রোগীর কো-মর্বিডিটি (দীর্ঘমেয়াদি রোগ) বা হূদযন্ত্রে সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা, উচ্চরক্তচাপ ডায়াবেটিসজনিত সমস্যা রয়েছে কিনা। কাজেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজ উদ্যোগে দোকান থেকে কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ কিনতে যাবেন না। কারণ ওষুধটির পরিমাপ প্রয়োজনীয়তা একেক রোগীর ক্ষেত্রে একেক রকম। অনেক সময় রোগীর একাধিক জটিলতা থাকায় চিকিৎসকেরাকম্বিনেশন মেডিসিন দিয়ে থাকেন।

রক্তে কোলেস্টেরল নিঃশব্দেই বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত পরীক্ষা না করালে আপনি তা বুঝতেও পারবেন না। কোলেস্টেরল বাড়তে শুরু করলে তা রক্তনালির দেয়ালে জমতে শুরু করে। কোলেস্টেরল জমতে শুরু করলেই বাড়ে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা। হতে পারে কিডনির সমস্যাও। তাই প্রতিটি মানুষকেই এই কোলেস্টেরল নিয়ে সচেতন হতে হবে। কোলেস্টেরলের জন্য এতগুলো রোগের আশঙ্কা বাড়লেও বহু মানুষ এর স্বাভাবিক মাত্রা সম্পর্কে কোনো খবরই রাখেন না। কারণেই সমস্যা দেখা দেয়ার আশঙ্কা অনেকটাই বাড়ে। তাই আর দেরি না করে অবশ্যই বিষয়টি জেনে নেয়াই ভালো। তবেই ভালো থাকা যাবে।

শরীরে স্বাভাবিক কোলেস্টেরলের মাত্রা: শরীরে দুই ধরনের কোলেস্টেরল থাকে। এলডিএল এইচডিএল। এলডিএল হলো খারাপ কোলেস্টেরল। শরীরে এলডিএল কোলেস্টেরল ১০০-এর নিচে থাকলে ভালো। অন্যদিকে এইচডিএল রক্তে থাকা ভালো। পুরুষদের ক্ষেত্রে কোলেস্টেরলের মাত্রা ৫০-এর বেশি মহিলাদের ক্ষেত্রে ৬০-এর বেশি থাকা খুবই জরুরি। আর তাই বছরে অন্তত দুবার কোলেস্টেরল পরীক্ষা করিয়ে নেয়া খুব জরুরি। আচমকা হার্ট অ্যাটাকের জন্যও দায়ী কোলেস্টেরল। খুব কম বয়সীদের মধ্যেও আজকাল হার্ট অ্যাটাক দেখা দিচ্ছে। তাই সচেতন হওয়া খুব জরুরি।

ডায়াবেটিস রক্তের অস্বাভাবিক লিপিড: আমাদের দেহের কোষসমূহ আন্তকোষীয় পদার্থের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বিভিন্ন রকম লিপিড। নির্দিষ্ট পরিমাণ লিপিড (কোলেস্টেরল) যেমন জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে। তেমনি লিপিডের কোনো এক বা একাধিক উপাদানের মাত্রা কম-বেশি হলে তা অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়। এখন এটা প্রতিষ্ঠিত যে রক্তে অস্বাভাবিক মাত্রায় লিপিডের উপস্থিতি হূদরোগ   রক্তনালির অসুখের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের জন্য যেমন সত্য, তেমনি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও সত্য। রক্তের অস্বাভাবিক লিপিড টাইপ- ডায়াবেটিস রোগীদের হূদরোগ রক্তনালির অসুখ দুই থেকে চার গুণ বৃদ্ধি করে।

রক্তের লিপিডের পাঁচটি উপাদানের মধ্যে টাইপ- ডায়াবেটিসে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়, এইচডিএলের (উপকারী কোলেস্টেরল) পরিমাণ কমে যায়। তবে এলডিএলের (অপকারী কোলেস্টেরল) পরিমাণ প্রায় স্বাভাবিক থাকে। যাদের ডায়াবেটিস হূদরোগ নেই তাদের জন্য রক্তে এলডিএলের নিরাপদ মাত্রা ১৩০ মিলিগ্রাম/ডিএলের কম এইচডিএল ৪০ মিলিগ্রাম/ডিএলের ওপরে। আর যাদের ডায়াবেটিস আছে (অথবা কোনো রকম হূদরোগ আছে) তাদের রক্তে এলডিএল ৭০ মিলিগ্রাম/ডিএলের কম এইচডিএলের পরিমাণ ৪০ মিলিগ্রাম/ডিএলের বেশি।

ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের অতিরিক্ত ট্রাইগ্লিসারাইড একটি বড় ঝুঁকি। এজন্য এটিকে সহনীয় বা নিরাপদ মাত্রায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে গুরুত্ব সহকারে। রক্তের লিপিড সঠিক মাত্রায় রাখার প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো জীবনযাপন পরিশুদ্ধিকরণ। এর মধ্যে আছে দৈহিক ওজন কমানো, শারীরিক শ্রম বৃদ্ধিকরণ, সমসত্ত্ব চর্বি গ্রহণ কমানো একই সঙ্গে অসমসত্ত্ব চর্বি গ্রহণ বৃদ্ধিকরণ, শর্করাজাতীয় খাবার খাওয়া কমানো মদ্য পান কমানো। আর রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা সঠিক পর্যায়ে রাখতে পারলে কোলেস্টেরলের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে। এক্ষেত্রে ইনসুলিন ইনজেকশন গ্রহণ যথেষ্ট সহায়ক হয়। 

যারা এসব পদ্ধতি অবলম্বন করেও রক্তের কোলেস্টেরল নিরাপদ মাত্রায় আনতে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাদের কোলেস্টেরল কমানোর জন্য ওষুধ সেবন প্রয়োজন হয়। তবে বর্তমান ধারণা মতে চল্লিশোর্ধ্ব ডায়াবেটিস রোগীদের প্রত্যেককেই লিপিড কমানোর ওষুধ সেবন করতে দেয়া উচিত। তীব্রভাবে লিপিড কমানোর ওষুধ ব্যবহার করে ডায়াবেটিস রোগীদের হূদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়।

কোন বয়স থেকে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত: আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০ বছর বয়স থেকেই কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত। মুম্বাইয়ের কার্ডিওলজিস্ট প্রবীণ কুমারের কথায়, ‘ বছর বয়সেই একবার রক্তে লিপিডের মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত। তারপর ১৭-২০ বছর বয়সে ফের একবার পরীক্ষা করে দেখার পরামর্শ দেয়া হয়।চিকিৎসকরা বলছেন, নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে কোলেস্টেরল পরীক্ষা করানোটা অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।

বয়স অনুযায়ী কোলেস্টেরলের আদর্শ মাত্রা কত: ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত মোট কোলেস্টেরলের মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে ১৭০ মিলিগ্রামের নিচে থাকা উচিত। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা ২০০-এর কম। মাত্রা ২০০ থেকে ২৩৯-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করলে সতর্ক হতে হবে।

রক্তে কোলেস্টেরলের রিপোর্ট কীভাবে দেখতে হয়: কোলেস্টেরলের মধ্যে রয়েছে এইচডিএল বা উচ্চ ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন, এলডিএল বা কম ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন ট্রাইগ্লিসারাইড। এলডিএলকে খারাপ কোলেস্টেরল বলা হয়, এইচডিএল হলো ভালো কোলেস্টেরল ট্রাইগ্লিসারাইড, যা ক্ষতিকারক হিসেবে বিবেচিত না হলেও হূদরোগের সঙ্গে যুক্ত। রক্তে বিভিন্ন কোলেস্টেরলের মাত্রা নির্ধারণের জন্য একটি সম্পূর্ণ কোলেস্টেরল পরীক্ষা করা হয়। কোলেস্টেরলের মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে মিলিগ্রাম বা এমজি/ডিএল হিসেবে পরিমাপ করা হয়। রক্তের মোট কোলেস্টেরলের মাত্রা যখন ২০০-এর নিচে থাকে, তখন এটি স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। বর্ডার লাইন কোলেস্টেরল হলো যখন রিডিং ২০০ থেকে ২৩৯-এর মধ্যে হয়। ২৪০-এর ওপরে কোলেস্টেরলকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। এলডিএলের স্তর সবচেয়ে বড় নির্ধারক। এলডিএলের স্বীকৃত মাত্রা ১০০-এর নিচে যাদের করোনারি আর্টারি ডিজিজ রয়েছে তাদের জন্য চিকিৎসকরা এটি ৭০-এর নিচে রাখার পরামর্শ দেন। একইভাবে ট্রাইগ্লিসারাইড এইচডিএলের স্বাভাবিক মাত্রা যথাক্রমে ১৪৯ এবং ৪০-এর নিচে।

কোলেস্টেরল ঠেকাতে যেসব নিয়ম মেনে চলতেই হবে: তেল-মসলা, লাল মাংস, চিনি, বড় মাছ, মাছের তেলের থেকে সমস্যা হতে পারে। স্যাচুরেটেড ফ্যাট আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থেকেও দূরে থাকুন। শাকসবজি বেশি করে খান। সেই সঙ্গে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার, ফাইবার এসবও বেশি পরিমাণে খেতে হবে। যেকোনো বয়সের মানুষের জন্যই শরীরচর্চা খুব জরুরি। রোজ নিয়ম করে ৩০ মিনিট শরীর চর্চা করতেই হবে। বাড়ির কাজে যে পরিশ্রম আর হাঁটাচলা হয় তার সঙ্গে দৈনন্দিন শরীরচর্চার ব্যবধান রয়েছে। তাই নিয়ম মেনে ৩০ মিনিট শরীরচর্চা করতেই হবে। এতে শরীর থাকবে সচল। হার্ট, কিডনি, লিভার সবই থাকবে সুস্থ। মদ্যপান, ধূমপান একেবারেই নয়। দিনে দুটো সিগারেট কিংবা সপ্তাহে একদিন মদ্যপানও শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। তাই সতর্ক থাকুন। মেনে চলুন চিকিৎসকের পরামর্শ।

পরিশেষে মনে রাখা দরকার, কোলেস্টেরল মানবদেহের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান। একই সঙ্গে এর পরিমাণের তারতম্য হলে তা বহুবিধ শারীরিক সমস্যা ডেকে আনতে পারে। নিয়মিত স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণ করে পরিমিত শারীরিক পরিশ্রমে রক্তের কোলেস্টেরল কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাখা সম্ভব।

 

লেখক: ডা. শাহজাদা সেলিম

সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫