বরিশালে ধ্বংসের উপক্রম ১২৭ বছরের বেল ইসলামিয়া হোস্টেল

প্রকাশ: অক্টোবর ০২, ২০২২

এম. মিরাজ হোসাইন, বরিশাল

বরিশাল অঞ্চলের মুসলিম ছাত্রদের জন্য ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একমাত্র ছাত্রাবাস বেল ইসলামিয়া হোস্টেল ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। ১২৭ বছরের পুরনো বরিশালের বেল ইসলামিয়া হোস্টেলটি এখন আনুষ্ঠানিক পরিত্যক্ত ঘোষণার অপেক্ষায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। তাছাড়া ট্রাস্টের কমিটি, আয়-ব্যয় সম্পত্তি নিয়ে সচেতন নগরবাসীর পক্ষ থেকে লুকোচুরির অভিযোগ  উঠেছে। এমনকি পদাধিকারবলে ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি জেলা প্রশাসকও জানেন না প্রাচীন প্রতিষ্ঠান কীভাবে পরিচালিত হয়।

জানা যায়, ১৮৯৫ সালে বরিশাল নগরীর গির্জা মহল্লায় তত্কালীন বাকেরগঞ্জ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট নিকোলাস বিটসেন বেল খান বাহাদুর মৌলভী হেমায়েত উদ্দিনের চেষ্টায় মুসলিম ছাত্রদের থাকার জন্য হোস্টেলটি নির্মাণ করা হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিকোলাস বিটসেন বেলের নামানুসারে বেল ইসলামিয়া হোস্টেল নামকরণ করে ট্রাস্টিজ বোর্ড গঠনের মাধ্যমে হোস্টেলটি পরিচালনা শুরু হয় ১৯০৫ সালে।

ব্রিটিশ আমলে মুসলিম পরিবারের সন্তানরা যখন স্কুলে যাওয়ার চিন্তা করত না তখন ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী বরগুনার বিত্তবান পরিবারের সন্তানদের এখানে রেখে পড়াশোনা করানো হতো। হোস্টেলের আবাসিক ছাত্রদের অনেকেই পরে দেশের খ্যাতিমান আমলা-মন্ত্রী হয়েছেন। মাত্র আট কাঠা জমি দিয়ে হোস্টেলের যাত্রা হলেও কালক্রমে এর জমির পরিমাণ প্রায় চার একর পর্যন্ত পৌঁছে।

করোনার প্রাদুর্ভাবের আগেও জরাজীর্ণ হোস্টেলটির ১৭টি কক্ষে ২৭ জন ছাত্র বসবাস করতেন। বর্তমানে এখানে মাত্র সাতজন নিবাসী রয়েছেন। হোস্টেলে অবস্থানকারী বরিশাল পলিটেকনিক কলেজের পাওয়ার ডিপার্টমেন্টের সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্র মামুন জানান, মাসে ৫০০ টাকায় থাকছি। বৃষ্টি হলে ওপর থেকে পানি সরাসরি বিছানায় পড়ে। এজন্য রুমের মধ্যে পলিথিন টানিয়ে নিয়েছি। এখন মাত্র সাতটি রুম বসবাসের জন্য রয়েছে। বাকিগুলো পুরোপুরি পরিত্যক্ত বলে জানান মামুন।

অন্য শিক্ষার্থী মারুফ হোসেন বলেন, নিরুপায় হয়েই থাকতে হচ্ছে এখানে। কারণ শহরের মধ্যে এত কম ভাড়ায় থাকার কোনো হোস্টেল নেই। ভেতরে শুধুই ধ্বংসের ছাপ। দিনের বেলায়ও আলো জ্বালিয়ে থাকতে হয় আমাদের।

বর্তমানে হোস্টেলের জমিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আছমত আলী খান ইনস্টিটিউশন (একে স্কুল), একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় বরিশালের কেন্দ্রীয় হেমায়েত উদ্দিন ঈদগাহ্ ময়দান। এখন বেল ইসলামিয়া হোস্টেল কর্তৃপক্ষের অধীনে রয়েছে মাত্র ৯৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ জমি।

১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠানের আয় বাড়াতে হোস্টেলের জমিতে ২৭টি দোকান নির্মাণ করা হয়। যার নাম ইসলামিয়া মার্কেট। এখান থেকে মাসে বিপুল অংকের টাকা আয় হলেও তা দিয়ে হোস্টেলের কোনো উন্নয়ন করেনি ট্রাস্টি বোর্ড। ২০০৫ সালের থেকে ওই মার্কেটের দোতলা তিনতলা নামমাত্র টাকায় ভাড়া নিয়ে মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক কর্তৃপক্ষ ব্যবসা করে আসছে।

বর্তমান সময়ে মার্কেটের একটি দোকানের ভাড়া পাশের মার্কেটের হিসাবে ১৫-২০ হাজার টাকা হওয়ার কথা। সেখানে ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, মার্কেটের একটি দোকান ভাড়া মাত্র হাজার ৫০০ টাকা। আর দ্বিতীয় তৃতীয় তলার একটি ফ্লোরের ভাড়া বর্তমান সময়ে লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকা হলেও ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা ভাড়া পাচ্ছেন মাত্র ২১ হাজার টাকা, যা পুকুরচুরি হিসেবে অভিহিত করছেন সচেতন নগরবাসী।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৮৫ সালে করা তিন সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছেন পদাধিকারবলে সভাপতি জেলা প্রশাসক, সম্পাদক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ন অ্যাডভোকেট মানবেন্দ্র বটব্যাল। কমিটি নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক।

স্থানীয়দের দাবি ট্রাস্টের ৩৭ বছরের পুরনো কমিটির সম্পাদক আর সদস্যদের জবাবদিহির আওতায় আনলে ট্রাস্টের সম্পত্তি আয়ের খাত নিয়ে ঘাপলার অবসান ঘটবে।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজল ঘোষ বলেন, ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হলেও ভবনের অবস্থা খুবই নাজুক। বহুবার আমরা হোস্টেল ট্রাস্টির বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছি, স্মারকলিপি দিয়েছি, কিন্তু  কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী বলেন, ১৯৮৫ সালে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই সম্পত্তি অর্থ নিয়ে ঘাপলা দেখা দিয়েছে। এর আগে ভালোভাবেই চলছিল প্রতিষ্ঠান। বারবার কমিটি বদল হোস্টেলটি সংস্কারের দাবি উঠলেও তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন, জানা মতে বর্তমানে ট্রাস্টের ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে, যা দিয়ে এটির সংস্কার করা সম্ভব। কেন তারা সংস্কার করছেন না তা আমার বোধগম্য নয়।

বেল ইসলামিয়া হোস্টেলের সুপার মো. মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ভবনটি এখন পুরোপুরি বসবাসের অনুপযোগী। তাই সরকার এটিকে রক্ষায় সুদৃষ্টি দিলে দর্শনীয় স্থান হিসেবে থাকবে। তবে ট্রাস্টি বোর্ডের এটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ আছে কিনা সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই তার কাছে। তাছাড়া ট্রাস্টির সম্পত্তি থেকে মাসে কত টাকা আয় আসছে সে তথ্যও তার দেয়ার ক্ষমতা নেই বলে দাবি করেন।

হোস্টেল কেন সংস্কার করা হচ্ছে না এবং মার্কেটের আয়ব্যয়ের বিষয়ে জানতে সম্প্রতি ট্রাস্টি বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের সেলফোনে কল দেয়া হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে তার সহকারীকে ফোন ধরিয়ে দেন। সহকারী হোস্টেল সুপারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। এরপর সুপার মঞ্জুরুল ইসলাম ট্রাস্টের অন্য সদস্য মানবেন্দ্র বটব্যালের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। পরে মানবেন্দ্র বটব্যালের কাছে সেলফোনে জানতে চাইলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন আয়-ব্যয়ের কোনো তথ্য দেয়া যাবে না। পরবর্তী সময়ে বিষয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে তিনি সম্প্রতি প্রতিবেদক বরাবর একটি সাদা কাগজে লেখা চিঠিতে সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন হায়দার জানান, বরিশালে রকম একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান রয়েছে তা আমার জানা ছিল না। ১২৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি রক্ষায় বিগত দিনে কেউ কাজ করেনি শুনে অবাক লাগছে। তাদের উচিত ছিল এর রক্ষণাবেক্ষণ বা সংরক্ষণে কাজ করা। যাই হোক এখন এটি সরেজমিন দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫