এক হাজার চাহিদার বিপরীতে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হচ্ছে বছরে গড়ে ২০টি

প্রকাশ: আগস্ট ২৯, ২০২২

ফিচার প্রতিবেদক

১৯৬০ সালে বিশ্বে প্রথম অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি পরে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। থেমে থেমে কয়েক বছর চলার পরে ৯০-এর দিকে ত্বরিতগতিতে শুরু করে দেশটি। মিয়ানমার, শ্রীলংকা পাকিস্তান বাংলাদেশের মতো ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।

তথ্য বলছে, দেশে ১৬৮টি অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হয়েছে ৫২টি, এভারকেয়ার হাসপাতালে হয়েছে ৬২টি, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ৪৯টি, আসগর আলী হাসপাতালে তিনটি আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) একটি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান এবং রক্তরোগ বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএ খান বলেন, ট্রান্সপ্লান্টের হিসাবে বিশ্বের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। মুহূর্তে দেশে প্রায় ১০ হাজার ট্রান্সপ্লান্ট করার মতো রোগী রয়েছে। ১৪ সাল থেকে পর্যন্ত গড়ে বছরে ২০টি ট্রান্সপ্লান্ট করতে পেরেছি। যেখানে করা দরকার এক হাজারটি। তবে দেশে চিকিৎসায় সাফল্যের হার অনেকটা বৈশ্বিক অবস্থার মতোই। আমাদের সাফল্যের হার ৭০-৮০ শতাংশ। অটোলোগাসে কোনো মৃত্যু নেই, অ্যালোজেনিকে মৃত্যুর সংখ্যা রয়েছে। তবে দেশে এর নির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই।

আমাদের রক্তের মধ্যে বেশকিছু রক্তকণিকা যেমন ডব্লিউবিসি, রেড সেল ইত্যাদি রয়েছে। এসব রক্তকণিকা তৈরি হওয়ার মূল কেন্দ্র হচ্ছে বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জা। আর অস্থিমজ্জায় যদি রক্ত সঠিকভাবে তৈরি না হয় বা কম তৈরি হয় তখন অন্য কোনো পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান না হলে বোন অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়।

ডা. এমএ খান বলেন, রক্ত যদি ঠিকভাবে তৈরি না হয় বা কম তৈরি হয় তখন অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া নামে একটি রোগ হয়। যেটা আসলে ক্যান্সার না অথবা কোনো কারণে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হলে সেখানে ক্যান্সারের কোষগুলো তৈরি হয় বেশি বেশি করে। ডব্লিউবিসি প্রভাবিত হলে আমরা বলি লিউকেমিয়া। এসব ক্ষেত্রে যখন বোন ম্যারো ঠিকমতো কাজ না করে তখন রোগীর শরীরে থাকা অস্থিমজ্জা আমরা প্রতিস্থাপন করি।

পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে চিকিৎসক জানান, আক্রান্ত রোগীর শরীরেরটা নষ্ট করে দিয়ে, যার শরীরে কোনো রোগ নেই, তার শরীর থেকে মাদার স্টেম সেল সংগ্রহ করে বিশেষ পদ্ধতিতে রোগীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিই। তখন ওই স্টেম সেলগুলো অস্থিমজ্জায় জায়গামতো চলে যায়। সেটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এভাবে বাড়তে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগে। ট্রান্সপ্লান্টের সময়টা খুব নাজুক, কারণ রোগীর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা থাকে না। ভাইরাল ইনফেকশন, ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন বা ফাঙ্গাল ইনফেকশনের ঝুঁকি থাকে। তাই সময়ে রোগীকে বিশেষ পরিবেশে রাখা হয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া থ্যালাসেমিয়া, দুই ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করলে রোগী ভালো হয়। অটোলোগাসের ক্ষেত্রে রোগীর নিজের শরীর থেকে স্টেম সেল নিয়ে প্রতিস্থাপনে ব্যবহার করা হয়। আর অ্যালোজেনিকের ক্ষেত্রে রোগীর মা, বাবা, ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে অথবা আনরিলেটেড ডোনারের কাছ থেকে স্টেম সেল নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। দেশে অটোলোগাস ট্রান্সপ্লান্ট হয় ৭৬ দশমিক শতাংশ আর অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্লান্ট হয় ২৩ দশমিক শতাংশ।

বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার ইতিহাস তুলে ধরে এমএ খান বলেন, তখন পিজি হাসপাতাল ছাড়া বাংলাদেশে হেমাটোলজি বিভাগ ছিল না। আমি উদ্যোগ নিই সরকারিভাবে ১০টি মেডিকেল কলেজে প্রথম হেমাটোলজি বিভাগ চালু করার। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে সেটা করা দুরূহ ছিল। অনেক কোলাহলপূর্ণ একটি জায়গা, এখানে ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। ২০১১ সালে ভিয়েতনাম আমাকে আমন্ত্রণ জানায় দেশের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে একটা প্রেজেন্টেশন দিতে। তার আগে আমার প্রস্তাব কয়েকবার নাকচ হয়ে যায়। ওখানে যাওয়ার আগে আমি তত্কালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক স্যারের সঙ্গে দেখা করি, তিনি আমাকে কাজ শুরুর কথা বলেন। ওখান থেকে দেশে ফিরে আর আমাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। শুরু করি কাজ। দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ২০১৪ সালের ১০ মার্চ আমরা ট্রান্সপ্লান্ট শুরু করি। সেই সময়ে নার্সদেরও আমরা প্রশিক্ষণ দিই। দেশে সেই সময় থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মোট ১৬৮টি ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সাধারণ রোগীরা ক্যান্সার শুনলেই ভয় পায়। তখন বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে বেশি উদ্বুদ্ধ হয়। অনেকে গিয়ে ফিরে আসে, কেউ আবার গিয়ে সুস্থ না হয়েই আসে। ডা. এমএ খান মনে করেন, রোগীদের বোঝাতে হবে যে দেশেই ভালো চিকিৎসা হয়। আমরা ভালো চিকিৎসা দিতে পারছি। সেটা তাদের কাছে তুলে ধরতে হবে। সেই সঙ্গে দেশের খরচটাও রোগীদের আর্থিক সীমানার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। খরচ অনেক সময় বিদেশের সমান বা তাদের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে রোগীরা বিকল্প পথ বেছে নেয়। সেই জায়গাটায় গুরুত্ব দিতে হবে সরকারকে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দেশে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে ডোনার সংকট রয়েছে। অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্লান্ট করতে গেলে ডোনারের প্রয়োজন হয়। বাবা-মা, সন্তানেরটা অনেক সময় মেলে না, তখন ডোনারের কাছ থেকে নিতে হয়। সেখানে শতভাগ ম্যাচিং হতে হয়। কারণে ডোনার ব্যাংক দরকার বলে মনে করেন তারা। সেটা করতে গেলে অনেক ফাইন্যান্সিয়াল ইনভেস্টমেন্ট দরকার হয়। আর মানুষ যদি ব্লাড ডোনেশনের মতো ডোনেশনে এগিয়ে আসতে পারে তাহলে ডোনারের সংকট দূর হবে।

দেশে ১০-১২ জন ট্রান্সপ্লান্ট বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। সংকটও দূর করার পাশাপাশি দেশের মানুষ যাতে চিকিৎসায় আস্থা রাখে সেজন্য সচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান চিকিৎসাসংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, অর্থশালীরা দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিলে সমস্যা নেই। কিন্তু মধ্যবিত্তরা দেশের বাইরে গিয়ে টাকা খরচ করে চিকিৎসা অর্ধেক করে চলে আসে। এতে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে ভুক্তভোগীরা। এছাড়া দেশে যেসব ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার আছে সেগুলো চালু করতে হবে। আর যেগুলো চালু রয়েছে সেগুলো আরো বেশি প্রসারিত করার দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫