বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী

দেশে দ্রুত সমন্বয় করা হোক

প্রকাশ: আগস্ট ১৮, ২০২২

সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি এসেছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে দেশেও সমন্বয় করা হবে। যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে বাড়তে ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলারে উঠে গিয়েছিল, তা বর্তমানে ১০০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাপী আসন্ন মন্দার কারণে পূর্বাভাস রয়েছে বছর শেষে জ্বালানি তেলের দর ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারে এবং ২০২৩ সালে তার চেয়ে আরো কম হতে পারে। ফলে যে যুক্তি দিয়ে কর্তৃপক্ষ দাম বাড়িয়েছে সেটি এখন আর কার্যকর নেই। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গে দেশেও জ্বালানির দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন। শুল্ককর কমিয়েও সরকার দাম কমাতে ব্যবস্থা নিতে পারে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন নিম্নমুখী। একদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক দেশ চীনের চাহিদা কমে যাওয়ার তথ্য প্রকাশ, অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রফতানিকারক কোম্পানি সৌদি আরামকো তেলের উৎপাদন বাড়াতে প্রস্তুত থাকার ঘোষণা দেয়ায় দাম কমছে তেলের। সোমবার বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে দশমিক ১৪ ডলার বা দশমিক শতাংশ কমে হয়েছে ৯৭ দশমিক শূন্য ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুডের দর প্রতি ব্যারেল এখন ৯১ দশমিক শূন্য ডলার। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরো কমবে। বাংলাদেশের জন্য এটি সুযোগ। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশেও তার সমন্বয় হওয়া চাই।

তেলের দাম নির্ধারণে সারা বিশ্বের দেশগুলো প্রধানত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করে। এর মধ্যে অধিকাংশই বাজারদরের সঙ্গে মিল রেখে সমন্বয় করে। কিছু দেশ আছে প্রাইস সিলিং বা সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী ভারতে জ্বালানি তেলের দাম প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় বাজারমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে। ডায়নামিক ডেইলি প্রাইসিং মেথড নামে পদ্ধতি ২০১৭ সাল থেকে চালু হয়েছে দেশটিতে। বাজারদর অনুযায়ী পদ্ধতিতে প্রতিদিনই দাম সমন্বয়ের সুযোগ আছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তানেও বাজারমূল্যের সঙ্গে তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করা হয়। বাংলাদেশে তেলের দাম নির্ধারণ হয় সরকারের নির্বাহী আদেশে ফিক্সড প্রাইস মেথডে। পদ্ধতি অনুসরণের ফলে বিশ্ববাজারে আচমকা দাম বেড়ে গেলে ভর্তুকি দিতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি বেড়ে যায়, আবার তেলের দাম অনেক কমে গেলেও সবক্ষেত্রে কমে না; ফলে তেলের মূল্য কম থাকার যে সুবিধা সেটি থেকে ভোক্তারা বঞ্চিত হন। ২০১৪-১৬ সালে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) যখন প্রতি লিটার ডিজেল আর কেরোসিনে ২০ টাকা লাভ করছিল, তখন অনেক সমালোচনার পর ২০১৬ সালের এপ্রিলে ডিজেল কেরোসিনের দাম ৬৮ থেকে মাত্র টাকা কমানো হয়েছিল! সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, বিপিসির মুনাফার টাকা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়া-কমা নিয়মিত ঘটনা। ফলে তেলের দাম কম থাকার সময় যে মুনাফা হয়, তা দিয়ে মূল্যবৃদ্ধির সময়কার লোকসান সমন্বয় করতে তহবিল গঠন করা উচিত ছিল। তার বদলে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বা সরকার নিয়ে যাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। আরেকটা বিষয়, মুনাফা ছাড়াও সরকার বিপিসির কাছ থেকে ট্যাক্স-ভ্যাট বাবদ বছরে - হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। মুনাফা ছাড়াও শুধু শুল্ক করের আয় হিসেবে গত সাত বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে বিপিসি। সেখান থেকেও কিছু অর্থ দিয়ে জ্বালানির দাম সমন্বয় করা সম্ভব।

জ্বালানি তেলের দাম কমানোর আরেকটি বিকল্প উপায় হলো জ্বালানি তেলের ওপর কর প্রত্যাহার। জ্বালানি তেল আমদানিতে মোট করভার প্রায় ৩২ শতাংশ। কর প্রত্যাহার করে নিলেই বিপিসিকে লোকসান দিতে হতো না, জনগণের ওপর বাড়তি মূল্যের বোঝাও চাপত না। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ জানিয়েছে, সব রকমের কর প্রত্যাহার করলে প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য কম করে হলেও ৩৬ টাকা কমানো সম্ভব। ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল, ডিজেল অকটেনের আমদানির ওপর কাস্টমস শুল্ক অন্যান্য কর বাবদ রাজস্ব কর্তৃপক্ষ প্রায় ৩৪ শতাংশ কর আদায় করে। এর মধ্যে কাস্টমস শুল্ক হলো ১০ শতাংশ, ভ্যাট বা মূসক ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর শতাংশ। এখন ১১৪ টাকার প্রতি লিটার ডিজেল থেকে ৩৬ টাকা কর আদায় করছে সরকার। ভারতে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক নির্ধারিত হয়ে থাকে। দেশটির জনগণকে জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থেকে রক্ষায় সরকার শুল্ককরের হার কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এক্ষেত্রেও সুযোগ রয়েছে শুল্ককর কমিয়ে জ্বালানির দাম কমানোর। ইতিবাচক বিষয় হলো জ্বালানির দাম কমানোর জন্য বিপিসি পেট্রোবাংলাকে নিয়ে শুল্ক কতটা কমানো যেতে পারে, তা জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগ পর্যালোচনা করছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব অর্থ বিভাগের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া এখনো মেলেনি। এক্ষেত্রে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন।

করোনাকালে বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেকেই পেশা বদল করেছে। কেউ আবার চাকরি হারিয়ে পেশা বদলিয়ে কৃষিকে বেছে নিয়েছে। এখন ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি দেশের কৃষি খাতকে বড় ধরনের একটি সংকটের মধ্যে ফেলে দেবে। দেশের উৎপাদনমুখী শিল্প-কারখানা বিদ্যুৎ জ্বালানি তেলের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। গ্যাসের অপ্রতুলতা বিদ্যুৎ ডিজেলের ওপর নির্ভরশীলতাকে অনেকাংশেই বৃদ্ধি করেছে। সুতরাং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা এটি নিয়ে চিন্তিত। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এরই মধ্যে জ্বালানির দাম কমানোর প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। সেখানে শুল্ককর হ্রাস করে হলেও জ্বালানির দাম কমানোর কথা বলা হয়েছে। আশা করি, সরকার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে। করোনার ফলে দেশে উল্লেখ করার মতো কোনো বিনিয়োগ হয়নি। বহু প্রবাসী দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের সবাইকে পুনরায় কর্মস্থলে ফেরানো সম্ভব হয়নি। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়েছে। দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এমন সংকটের সময় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এমনিতে গত দুই বছরে মানুষের আয় না বাড়লেও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয় বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের কৃষি অর্থনীতি রফতানিমুখী শিল্প-কারখানার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকার বা সংশ্লিষ্টরা নেতিবাচক দিক বিবেচনা করে দেখেছেন কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিশ্চিত করেই জনদুর্ভোগ বাড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এদিকে পেট্রল অকটেনের দাম বাড়ার ফলে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যয়ও অনেকাংশে বেড়েছে। মোটা দাগে বলতে গেলে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে। অনেক দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকায় সরকার কোথাও সারে ভর্তুকি দেয় না। কিন্তু আমাদের দেশে ভর্তুকি বন্ধ করা কঠিন। কারণ প্রকৃত মূল্যে সার বিক্রি করলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে কৃষিজ পণ্যের দাম বাড়বে। ঠিক তেমনি বিদ্যুৎ-গ্যাস প্রকৃত দরে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করলে শিল্প দ্রব্যের দাম বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ গ্যাসে সরকার ভর্তুকি দেয় বলেই বাংলাদেশের গার্মেন্টসের উৎপাদন খরচ কম এবং সেজন্য আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বেশি। অবশ্য এক্ষেত্রে কম মজুরির শ্রমের অবদানও অনেক।

বাংলাদেশ এখন প্রায় ৫০ লাখ টন ডিজেল এবং ৪০ লাখ টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করে। শোধনাগারের সক্ষমতা না থাকায় সরকার মাত্র ১৩ লাখ টন ক্রুড অয়েল আমদানি করে। বিপিসির কাছে নগদ অর্থ থাকলে তা দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে ক্রুড অয়েল রিফাইনারি ক্যাপাসিটি এবং রিজার্ভ সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। বাংলাদেশের শোধনাগার রাশিয়ার তেল শোধন করার জন্য উপযোগী না হওয়ায় কম দামে রাশিয়ার তেলও কেনা যাচ্ছে না বলে জানা যাচ্ছে। বিপিসির লাভ খরচ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। অনেকের মতে, বিপিসির মূল্য সমন্বয় সঠিক হয়নি, আরো কম মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল। বর্তমান অবস্থায় বিপিসির আর্থিক অবস্থা জানা দরকার, অনেকের ধারণা বিপিসি স্বচ্ছ নয়। বিপিসির নিরীক্ষিত কোনো হিসাব বিবরণী নেই, থাকলে এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য মন্ত্রী বা সচিবের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন হতো না। বিপিসির জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫