বিশ্লেষণ

শ্রীলংকার অর্থনীতির পতন কেন ঘটল?

প্রকাশ: জুলাই ২৯, ২০২২

কৌশিক বসু

আমাদের চোখের সামনে শ্রীলংকার অর্থনীতি ধসে পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, উচ্চজীবনমান এবং স্থিতিশীল অর্থনীতি হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত একটা দেশে এটা কীভাবে ঘটল? কিছু তথ্য খতিয়ে দেখা যাক। -যাবত দেশটির অর্জন কম নয়। কয়েক দশক ধরেই প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে কিছু সূচকে দেশটি এগিয়ে। শ্রীলংকার মাথাপিছু জিডিপি ভারতের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি এবং সেখানে গড় আয়ুষ্কাল ৭৭ বছর। এটা বাংলাদেশ (৭৩ বছর), ভারত (৭০ বছর) এবং পাকিস্তানের (৬৭ বছর) চেয়েও বেশি।

তবে এখন শ্রীলংকার অর্থনীতি গভীর মন্দায় নিপতিত। সংকটের তাত্ক্ষণিক কারণগুলো  বেশ স্পষ্ট। এক্ষেত্রে দেশটির নিজস্ব নীতি ভুল তো আছে, সঙ্গে রয়েছে কভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টর। সব মিলিয়ে দেশটিতে বিরাজমান সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। নীতি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে  (যিনি এখন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন) অবিবেচনাপ্রসূত কয়েক দফা কর হ্রাস করেছেন। ফলে দেশটি রাষ্ট্রীয় ব্যয় মেটানোর প্রয়োজনীয় রাজস্বপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এরপর ২০২১ সালে তার সরকার হঠাৎ করে রাসায়নিক সার কীটনাশক আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। ওই নীতির লক্ষ্য ছিল বৈদেশিক মুদ্রার বহিঃপ্রবাহ রোধ করা। এর ফল হয়েছিল মারাত্মক। খাদ্য উৎপাদন নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায় এবং চলতি বছর দেখা দেয় তীব্র খাদ্য ঘাটতি। 

বিবৃত সংকটের মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছিল দেশটির মুদ্রা রুপি কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার সরকারি প্রচেষ্টা। কারিগরিভাবে শ্রীলংকা একটা নমনীয় কৌশল ব্যবহার করে। দর বেঁধে দেয়ার সরকারি নির্দেশনা দেয়ার পরিবর্তে ভাসমান বিনিময় হার বজায় রাখা হয়; যদিও  বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অত্যধিক ওঠানামা ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ডলার কেনাবেচা) মাঝে মধ্যে হস্তক্ষেপ করেছে। 

তবে রুপি টু ডলারের বিনিময় হারের সারণি দেখায়, দেশটির নমনীয় কৌশলটি আসলেই একটি ভুল পদক্ষেপ। অনেক বছর ধরেই সেখানে বিনিময় হার স্থিতিশীল ছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডলার ১৭৫-২০০ রুপির মধ্যে ছিল। এর কারণ নোয়াহ স্মিথের লেখায় মেলে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, রুপির মূল্যমান চাঙ্গা রাখতে শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত ডলার বিক্রি করে আসছিল। অবশেষে দীর্ঘস্থায়ী হস্তক্ষেপ কেবল যেভাবে পর্যবসিত হতে পারত, সেভাবেই পর্যবসিত হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলের দিকে রুপি ব্যাপকভাবে অবমূল্যায়িত হওয়া শুরু করে। দুয়েক মাসের মধ্যে ডলারের বিপরীতে রুপির মূল্যমান দাঁড়ায় ৩৫০ এবং অচিরেই দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মজুদ সর্বাত্মকভাবে নিঃশেষিত হয়। 

মে মাসে শ্রীলংকা তার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। আমরা এখন জানি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে না গিয়ে যাদের পুনরুদ্ধার কর্মসূচিগুলো কঠোর নীতি সংস্কারের শর্তে বাঁধা, তারা নতুন ঋণের জন্য চীনের দ্বারস্থ হয়। বিশেষ করে যখন দেশটির রাজকোষাগার প্রায় নিঃশেষ হচ্ছিল তখন। কিন্তু এতে দুর্দশা কাটেনি, এটা বরং দেশটির বৈদেশিক ঋণ আরো বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে নিশ্চিত করে, এর অনিবার্য সংকট আরো অনেক গভীর হবেযখন এটি শেষ পর্যন্ত পৌঁছবে।

শ্রীলংকার ক্ষেত্রে (ইথিওপিয়ার মতো অন্য উন্নয়নশীল দেশের  ক্ষেত্রেও) চীনের নেয়া কৌশলে আগের ঔপনিবেশিক শক্তি এবং উন্নয়নশীল দেশে গ্রামীণ মহাজনদের অ্যাপ্রোচের সঙ্গে যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। অমিত ভাদুড়ি কেমব্রিজ জার্নাল অব ইকোনমিক্সে ১৯৭৭ সালে একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। ক্ল্যাসিক ওই প্রবন্ধে তিনি যেমনটা দেখিয়েছিলেন, অনানুষ্ঠানিক গ্রামীণ মহাজনরা সাধারণত গ্রহীতার খেলাপি হওয়া নয়; বরং তার খেলাপি না হওয়া নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকে। কারণ তাহলে তারা জামানত (সাধারণত ভূমি) জব্দ করে বড় মুনাফা করতে পারে না।

এবার হাম্বানটোটা বন্দরের কথা বিবেচনা করা যাক। এটা ২০০৫-১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকা মাহিন্দা রাজাপাকসের (এবং তার ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে) হাতে নেয়া প্রিয় প্রকল্পের একটি। কিন্তু শ্রীলংকা যখন পরে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন উপহারটি জামানত হিসেবে জব্দ করা হয়। বন্দর এখন চীনের জিম্মায়। এটি দেশটির কাছে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রীয় পরিপক্বতার জন্য দীর্ঘদিনের সুনাম থাকা একটি দেশ কীভাবে এতগুলো ভুল করেছে? এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, শ্রীলংকার রাজনীতিই আজকের অর্থনৈতিক সংকটের বীজ বপন করেছে। তামিল টাইগারদের পরাজয় এবং ২০০৯ সালে কয়েক দশকব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসানের পর রাজাপাকসে নেতৃত্বাধীন সরকার অব্যাহতভাবে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল। তারা দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল করেছিল, সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন করেছিল এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিল। 

কর্তৃত্ববাদ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থনীতি ধ্বংস করলেও কিছু কর্তৃত্ববাদী সরকার অবশ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে সমর্থ হয়েছে। কিছুদিনের জন্য সম্ভবত রাজাপাকসে সরকারও ক্যাটাগরির মধ্যে পড়েছিল। তবে তারা যেহেতু জনতুষ্টিবাদকে আলিঙ্গন করেছিল, সেহেতু শিগগিরই এটা পরিষ্কার হয়েছে যে সাঙ্গাত পুঁজিবাদই (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) হবে দেশটির নিয়তি। 

রাজাপাকসে সরকার ২০১৯ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে এলে তারা বিপুল জনসমর্থন পায়। এটা ধরে রাখতে তারা কিছু ভুল অর্থনৈতিক পরামর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। এর প্রভাব পড়ে জনজীবনে। তারা ভেতরে ভেতরে বিক্ষুব্ধ হয়। বলাবাহুল্য, জনগণের ধৈর্য দীর্ঘদিনের জন্য কেনা যায় না, অবশেষে অস্থায়িত্বশীল নীতিগুলো দেয়ালে পর্যবসিত হয়। জনগণ ফুঁসে ওঠে।

খুব বেশি আত্মগর্ব আত্মবিশ্বাস না থাকলে রাজাপাকসে সরকার ভুল শুধরে নিতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। যুক্তিসংগত জোরালো সমালোচনা সত্ত্বেও ক্ষমতায় এসে তারা তাত্ক্ষণিকভাবে বড় ধরনের কর হ্রাসের ঘোষণা দেয়। ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর সাবেক অর্থমন্ত্রী মঙ্গলা সামারাউইরা টুইটারে সতর্ক করেছিলেন, গোতাবায়ার কর পরিকল্পনা শ্রীলংকাকে দেউলিয়াত্বের এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠাতে চায়। ঝুঁকি সত্ত্বেও রাজাপাকসে তার পরিকল্পনা এগিয়ে নেয়। যখন সরকার হঠাৎ করে রাসায়নিক সার কীটনাশক আমদানি নিষিদ্ধ করে, তখন নীতির প্রভাব কী হবে তা সবার কাছে অনুমেয় ছিল।

দ্রুত বদলে যাওয়া দৃশ্যপটে দেশটির চলমান সংকট কোথায় গিয়ে থামবে, সেটা এখনো অস্পষ্ট। এমনকি প্রক্সি হিসেবেও যদি রাজাপাকসেরা ক্ষমতায় না আসে, তাহলে অন্য ঝুঁকি রয়েছে। আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে এমন কোনো সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত আইএমএফ কোনো পুনরুদ্ধার কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসবে না। তবে সংকটের গভীরতর পর্যায়ে কিছুটা আমলাতান্ত্রিক নীতিমালা স্থগিত করে শ্রীলংকাকে সাহায্য করতে আইএমএফ এবং সভরেন ক্রেডিটরের প্যারিস ক্লাবউভয়েরই আরো সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা হবে দেশটিতে বেড়ে চলা মানবিক বিপর্যয়ের সম্ভাব্য পরিণাম।

[স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

 

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ভারত সরকারের সাবেক মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের জ্যেষ্ঠ অনাবাসিক ফেলো

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫