অভিমত

আর্থিক খাতের সংস্কার নিয়ে কিছু কথা

প্রকাশ: জুলাই ২৫, ২০২২

ড. মিহির কুমার রায়

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী গভর্নর মুদ্রানীতি (২০২২-২৩) ঘোষণাকালে বলেছিলেন দেশের সামনে দুটি মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি অতি আলোচিত বিষয় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর। এরই মধ্যে ১২ জুলাই ২০২২ নতুন গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদানের পর পরই আগের মতো একইভাবে মুদ্রা ব্যবস্থাপনার  সংকট মোকাবেলায় নতুন তিনটি  পদক্ষেপ ঘোষণা দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ডলারের চাহিদা কমিয়ে আনতে পণ্য আমদানি তদারকি, অব্যবহূত ডলার নগদায়ন এবং ব্যাংকের অফশোর ইউনিট থেকে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য অর্থ ধার নেয়ার সুযোগ তৈরি করতে আলাদাভাবে এসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রফতানি আয় হিসেবে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার ইআরকিউ (রফতানিকারকের রিটেনশন কোটা) হিসাবে রাখা অর্থের ৫০ শতাংশ নগদায়ন করতে হবে এবং এর সীমা কমানো হয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকের বিদেশে পরিচালিত অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং কার্যক্রমের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল সরকারি পর্যায়ে আমদানির জন্য ব্যাংকের রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ অর্থ জোগান দেয়া যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী তিন সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।

এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম (আইএমএফ স্টাফ ভিজিট মিশন-২০২২) বাংলাদেশ সফর করেছে এবং ব্যাংক খাতে সংস্কারের অগ্রগতি জানতে গিয়ে সরকারি ব্যাংকে উচ্চখেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উচ্চখেলাপি ঋণ কমাতে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তাও জানতে চেয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি নিয়ে ফের আপত্তি তোলে আইএমএফ। তাদের মতে, রিজার্ভের অর্থে গঠিত রফতানি উন্নয়ন তহবিলসহ (ইডিএফ) বিভিন্ন ঋণ তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখনো রিজার্ভেই দেখানো হচ্ছে। অথচ এগুলো নন-লিকুইড সম্পদ বা ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড সিকিউরিটিজ। সংস্থাটির ব্যালান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন (বিপিএম-) ম্যানুয়াল অনুযায়ী এসব দায় রিজার্ভ হিসাবে বিবেচিত হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দুটি পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক: একটি হলো গ্রস হিসাব আরেকটি নিট হিসাব। নিট হিসাবে রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন ঋণ তহবিল বাদ দেয়া হয়। তবে আগামীতে আইএমএফের ম্যানুয়াল মেনেই রিজার্ভের হিসাব দেখানো হবে বলে একমত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে রিজার্ভের অর্থে ইডিএফে ৭০০ কোটি, জিটিএফে ২০ কোটি, এলটিএফএফে কোটি ৮৫ লাখ এবং সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ৬৪ কোটি ডলার বাংলাদেশ বিমানকে কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে। ৭৯২ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের বাইরে কারেন্সি সোয়াপের আওতায় শ্রীলংকাকে দেয়া হয়েছে ২০ কোটি ডলার। এটা রিজার্ভ থেকে বাদ দিলে প্রকৃত রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে।

খেলাপি ঋণ নিয়ে প্রথম থেকেই  সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় সরগরম এবং শতাংশ ঋণ শোধ করে খেলাপি ঋণীরা আরো নয় মাস ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবে বলে ঘোষণা এসেছিল এবং যারা শতকরা শতাংশ হারে ঋণ নিয়ে নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী তারা অনেকটা অখুশি হয়েছিল, তার পরও খেলাপি ঋণীর সংখ্যা   ঋণের পরিমাণ কমেনি। তথ্য বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, আর আইএমএফের হিসেবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) হিসেবে প্রকৃত পক্ষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় লাখ কোটি টাকা। এখন কোন সংস্থা কোন পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হিসাব করেছে তা অবশ্যই আলোচনার বিষয়। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে একটি চুক্তি করেছে। ওই চুক্তির প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আদায় স্থিতি নিয়ে আগামী তিন বছরের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাংকগুলো নিজ অবস্থান থেকে কী পরিমাণ খেলাপি ঋণ কমাবে, এর ঘোষণা সেখানে দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগামী তিন বছরে খেলাপি ঋণ হাজার ২৪০ কোটি টাকা কমিয়ে আনার রূপরেখার মধ্যে চলতি অর্থবছরে করা হবে হাজার ৭০৫ কোটি টাকা আর আগামী অর্থবছরে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে হাজার ৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ টাকা খেলাপিদের কাছ থেকে আদায় করা হবে। ব্যাংকগুলোর মতে, খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ার কারণে মূলধন সংকট সৃষ্টির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, মূলধন পর্যাপ্ততার হার সঠিক পর্যায়ে রাখা যাচ্ছে না। এর আগের তিন বছরে (২০১৭-১৯) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমিয়েছে হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকিং খাতে বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ব্যবসায়িক প্রভাব রয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে।

তবে আশ্চর্য বিষয় হলো, আব্দুর রউফ তালুকদার নতুন গভর্নর হিসেবে যোগ দেয়ার পাঁচ কার্যদিবসের মাথায় বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নীতিমালা জারি করে এবং নীতিমালায় খেলাপি ঋণে কী সুবিধা দেয়া হবে, তা নির্ধারণ করার পুরো ক্ষমতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, যার ফলে ব্যাংক মালিকরাই এখন ঠিক করবেন তারা ঋণখেলাপিদের কী সুবিধা দেবেন। আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত, যা স্বয়ং গভর্নর অনুমোদন করতেন। নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে সেই ক্ষমতার পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দিয়েছেন। নতুন নির্দেশনা মতে, আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা শ্রেণীকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ঋণখেলাপিদের জন্য বড় ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আড়াই থেকে সাড়ে শতাংশ অর্থ জমা দিলেই হবে। এর আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ১০-৩০ শতাংশ জমা দিতে হতো। আগে ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় পেলে এখন পাঁচ-আট বছর সময় পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে নতুন করেও ঋণ পাওয়া যাবে। ব্যাংকসংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংক মালিকদের হাতে খেলাপি ঋণ সুবিধার ক্ষমতা থাকলেও জালজালিয়াতি, অনিয়ম প্রতারণার ঋণ নতুন নীতিমালার আওতায় নিয়মিত করা যাবে না। একটি ঋণ চার অর্থবছর পর পুনরায় একবার নিয়মিত করতে পারবে। জানা গেছে, করোনার কারণে দেয়া ছাড় উঠে যাওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, নতুন করে অনেক ঋণখেলাপি হয়েছে, পাশাপাশি করোনায় অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে যে লাখ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, তারও বড় একটা অংশ অনাদায়ী হয়ে পড়েছে। কারণে এখন ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাপারে নিরপেক্ষ গবেষকদের মন্তব্য হলো, খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারণ করা ভালো, তবে এটি অর্জন করতে পারলে পুরস্কার আর না হলে তিরস্কারের বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। কারণ, খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক চাপও আসবে, চাপমুক্ত থেকে সংস্থাগুলো কাজ করতে পারলে লক্ষ্য নির্ধারণ সম্ভব হবে। জানা গেছে, বিশেষজ্ঞদের মতে ব্যাংক খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ খেলাপি ঋণ। ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনক বৃদ্ধির কারণে ব্যাংক খাতে আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগামী দিনে খেলাপির পরিমাণ যাতে না বাড়ে, এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া আছে ব্যাংকগুলোয়। ব্যাংকসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনের মতে, খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কমাতে হলে সুশাসন বাড়িয়ে দুর্নীতি বন্ধ করে প্রতিটি ঋণ যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে ঋণের মান বাড়াতে হবে। ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের শাস্তির দৃশ্যমানতা এবং স্বচ্ছতাই ঋণখেলাপি হ্রাসের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে বলে তাদের মতামতে উঠে আসে। তারা আরো বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন মাস অন্তর খেলাপি ঋণের যে হিসাব তৈরি করে, তাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। এর সঙ্গে অবলোপন করা প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে। এছাড়া পুনঃতফসিল পুনর্গঠনে আছে বিপুল অংকের ঋণ। এর বাইরেও আছে লাখ কোটি টাকার মতো মেয়াদোত্তীর্ণ স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (এসএমএ) ঋণ, যেগুলো খেলাপির পূর্ব ধাপে রয়েছে। তাই সরকার মহতী প্রচেষ্টার সফল বাস্তবায়ন দেখতে চায় এদেশের ১৭ কোটি মানুষ এবং ব্যাংক খাত উন্নয়নের সোপান দেশ দেশের বাইরে। গত অক্টোবর, ২০২১ গণমাধ্যম প্রতিবেদনে প্রকাশিত স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০২২-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এতে দেশের জিডিপির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা) বর্তমান মাথাপিছু আয় হাজার ৯২৮ ডলারের বিপরীতে ২০২৬ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের প্রধান স্ট্র্যাটেজিস্ট গ্লোবাল হেড অব রিসার্চ বলেন, যখন বিশ্বব্যাপী পুনরুদ্ধারের গতি এবং সরবরাহ অত্যন্ত অসম রয়ে গেছে, তখন বাংলাদেশ ২০২০ সালে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। জোরদার টিকাদান কর্মসূচি এবং কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এলডিসি থেকে দেশের উত্তরণে প্রত্যাশিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি আরো বেড়েছে। সময়ে আর্থিক খাত এক সহযাত্রী হিসেবে এগিয়ে আসবে প্রত্যাশা রইল।

 

. মিহির কুমার রায়: অধ্যাপক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫