অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে শীর্ষে ময়মনসিংহ বিভাগ

প্রকাশ: জুন ০৯, ২০২২

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার অপপ্রয়োগ বাড়ছে। স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, ময়মনসিংহ বিভাগের রোগীদের মধ্যে এখন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের হার সবচেয়ে বেশি। অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অণুজীব প্রতিরোধী ওষুধ গ্রহণ করছেন রোগীরা। এক্ষেত্রে অনিবন্ধিত, হাতুড়ে অযোগ্য চিকিৎসক বা ওষুধের দোকানদারের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ঘটনা ঘটছে বেশি। এসব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে রোগীর রোগ নির্ণয়ও করা হচ্ছে না।

নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার অপপ্রয়োগের প্রবণতা বেশি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, অতিপ্রয়োগ করা হলে কার্যকারিতা হারায় অ্যান্টিবায়োটিক। সংক্রামক ব্যাধির জীবাণুগুলো হয়ে ওঠে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম বড় সংকটকে অভিহিত করা হয় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) হিসেবে। বৈশ্বিক সংকট এখন সব দেশেই বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে, যার বাইরে নয় বাংলাদেশও।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, দেশের রোগীদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের হার সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ বিভাগে, যার হার ৮৩ শতাংশ। খুলনা বিভাগে হার ৮১ শতাংশ। এছাড়া চট্টগ্রাম রংপুর বিভাগে ৭৯ শতাংশ করে, বরিশাল ঢাকা বিভাগে ৭৮ শতাংশ করে এবং রাজশাহী বিভাগে ৭৪ শতাংশ রোগী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে। সিলেট বিভাগে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ সবচেয়ে কম হলেও বিভাগটিতে ৭৩ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার রয়েছে। সিচুয়েশন অ্যানালাইসিস অব ইউজ অব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালস অ্যামং অ্যালোপ্যাথিক প্র্যাকটিশনার্স ইন বাংলাদেশ: সেকেন্ডারি অ্যানালাইসিস শীর্ষক এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে তথ্য উঠে আসে।

ময়মনসিংহ অঞ্চলে অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়ে সচেতনতা কম বলে জানালেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. শাহ আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকজন বিভিন্ন অঞ্চলে কাজের জন্য যায়। তারা গোষ্ঠীগতভাবে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের জন্য প্রভাবিত হতে পারে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রের বাইরেও তারা অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খায় বেশি। সর্দি-কাশি হলে দেখা যায়, একজনের দেখাদেখি অন্যরাও অ্যান্টিবায়োটিক নেয়া শুরু করছে। অ্যান্টিবায়োটিকের বিষয়ে অঞ্চলের মানুষের জানাশোনা কম। একই সঙ্গে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়ার বিষয়টিও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের অনৈতিকতার বিষয়টিও জড়িত।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট জানিয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ময়মনসিংহ বিভাগে বেশি হলেও অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গাল অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক ওষুধের প্রয়োগ অন্যান্য বিভাগের বেশি। অ্যান্টিভাইরাল সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হচ্ছে রাজশাহীতে, অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ রাজশাহী রংপুর দুই বিভাগেই সর্বোচ্চ প্রয়োগ হয়। আর অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক ওষুধের সর্বোচ্চ প্রয়োগ হচ্ছে সিলেট বিভাগে।

দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার অপপ্রয়োগ নিয়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মূল্যায়নে উঠে এসেছে, শিশুদের ওপর অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে নিবন্ধনহীন চিকিৎসকরাই রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন বেশি। যথাযথ যোগ্যতাহীন চিকিৎসকদের কাছ থেকে আসা ব্যবস্থাপত্রের ৮৩ শতাংশেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগও যথাযথভাবে নির্ণয় করা হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট সেলের ফোকাল পারসন ডা. সুব্রত পাল বণিক বার্তাকে জানান, সুনির্দিষ্ট রোগভিত্তিক খরচের তথ্য বা ডিজিজ স্পেসিফিক অ্যাকাউন্ট তৈরির অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট সারা দেশের রোগীদের কাছ থেকে সাড়ে ১০ হাজার চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র সংগ্রহ করে। ব্যবস্থাপত্রগুলো নিয়ে বছরজুড়ে গবেষণার পর সেসব তথ্য থেকে বিষয়টি তুলে আনা হয়।

শুধু অ্যান্টিবায়োটিক নয়, যেকোনো ওষুধের অতিমাত্রায় অপপ্রয়োগের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে প্রয়োজন ছাড়াই বিভিন্ন ওষুধের প্রয়োগ হচ্ছে। প্রাত্যহিক জীবনে মানুষের মধ্যে ওষুধের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরির ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। যে কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ওষুধের দোকানে যাচ্ছে। এর সুযোগ নিচ্ছে ক্ষুদ্র বড় অসাধু ব্যবসায়ীরা। অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ফলে মানুষ তাত্ক্ষণিকভাবে ভালো ফলাফল পায় বলেই শুরুতে তা গ্রহণ করছে। কিন্তু এর অপপ্রয়োগে এএমআর তৈরির পাশাপাশি শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কেউই সচেতন নয়।

অনিয়ন্ত্রিত বিক্রি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর তদারকির দুর্বলতার সুযোগে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিমাত্রায় প্রয়োগ চলছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ- মাহবুব। বণিক বার্তাকে জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ বন্ধে ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসক, ওষুধের দোকান পল্লী চিকিৎসকের ভূমিকা থাকতে হবে। শুধু গবেষণা করলেই অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ যাবে না। ওষুধের দোকানগুলোয় কাকে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা হচ্ছে, সে সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সারা দেশে প্রচুর ওষুধের দোকান রয়েছে। সেখানে শিক্ষিত লোকবল রাখতে হবে। আর সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো সচেতনতা সৃষ্টি করা। সচেতনতা এক দিন বা এক বছরে হবে না। নিয়মিতভাবেই সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়ে কাজ করতে হবে।

অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহারের ফলে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে উল্লেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগের ফলে বৈশ্বিক খাদ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ফলে যে কেউ যেকোনো বয়সে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক . মো. শাহাদৎ হোসেন মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা গবেষণার পর সে আলোকে প্রাসঙ্গিক গাইডলাইন প্রটোকল তৈরি করে বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে সরবরাহ করি। অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে একটি প্রটোকল দিয়েছি। এতে বলা হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক লিখতে হলে চিকিৎসককে অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হবে। কিছু রোগের ক্ষেত্রে নিবন্ধিত চিকিৎসকও রোগ নির্ণয় ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারবেন না। সময়ে সময়ে এসব গাইডলাইন প্রটোকলকে আমরা পুনর্মূল্যায়ন করি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫