অভিমত

শব্দদূষণ মানসিক অসুস্থতা তৈরি করছে

প্রকাশ: মে ২১, ২০২২

রহমান মৃধা

বদলেছে যুগ, বদলেছে মানুষের প্রয়োজন। বহু গুণে বেড়েছে জনসংখ্যা। বেড়েছে সব কিছুর চাহিদাও। কথা সবারই জানা যে, মানুষের সব প্রয়োজন মেটানোর উৎস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রকৃতি। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের কারণে মানুষের চাহিদার আমূল বদল হয়েছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশের ওপর। কারখানায় প্রস্তুত হয় মানুষের নিত্যদিনের সামগ্রী। সেই কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন না করে সর্বত্রই ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, যা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে মাটি সাগরে। আবার সেই বর্জ্য পুড়িয়ে ক্ষতিকর ধোঁয়া বাতাসেও ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন সুবিধার জন্য যে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে তা মাটির ক্ষতি করছে। এভাবে পরিবেশের প্রতিটি উপাদান দূষিত হচ্ছে মানুষের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে।

অবস্থায় গোটা বিশ্বের মানুষ কম-বেশি বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। সুইডেন অন্যান্য দেশের চেয়ে একটু বেশি সচেতন, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, তার প্রমাণ গ্রেটা থুনবার্গ। কয়েক মাস ধরে সুইডেনের সব দোকানে প্লাস্টিক ব্যাগের দাম ক্রোনার থেকে ক্রোনার হয়েছে। কাগজের ব্যাগের দাম পলিথিনের তুলনায় কিছুটা কম। বাসা থেকে ব্যাগ না নিয়ে দোকানে গেলেই একটি ব্যাগের জন্য ক্রোনার দিতে হয়। আজ ব্যাগ নিতে ভুলে গেছি। একটি ব্যাগ কিনতেই অল্প বয়সী ক্যাশিয়ার বলল, পরিবেশের কথা ভাব, আর কত দিন পৃথিবীর পরিবেশ ধ্বংস করবে?

আমি বললাম আজ ব্যাগ আনতে ভুলে গেছি, সরি। সে বকবক করে এক গাদা শক্ত কথা শুনিয়ে দিল। এমনকি কোনো এক সময় বলে ফেলল, তোমরা যারা অন্য দেশ থেকে এসেছ, পরিবেশের ওপর তোমাদের কোনো রেসপেক্ট নেই। এতক্ষণ মেজাজটা ঠিক ছিল তবে শেষের কথাগুলো বলতেই একটু চোটে গেলাম। দোকানে ভিড় কম, মেয়েটিকে একেক করে বলতে শুরু করলাম।

এই মেয়ে শোনো, আমাদের বাড়িতে মা কাঠ দিয়ে রান্না করতেন ছোটবেলায়। সেই রান্না করতে যে কাঠ ব্যবহূত হতো তার অবশিষ্ট যে কয়লা বা ছাই থাকত তা দিয়ে বাড়িতে কাজের লোক থালা-বাসন পরিষ্কার করেছে। কাঠের কয়লা, গাছের ডাল এসব দিয়ে দাঁত ব্রাশ করছি। কাপড় পরিষ্কার করতে ছাই ব্যবহার করতাম। হেঁটে হেঁটে স্কুলে গিয়েছি, গাড়ি বা মোটর চালিয়ে নয়।

টিভি, কম্পিউটার, কেমিক্যাল জিনিসের ব্যবহার খুব কম করেছি। মাঠে গরু দিয়ে চাষ করেছি, কখনো মেশিন ব্যবহার করিনি। ভেবে দেখো, আমি যেভাবে আমার জীবনের কুড়িটি বছর কাটিয়েছি আর তোমার জীবনের কুড়িটি বছর কীভাবে কেটেছে? যেমন তোমার জন্মের শুরুতে তুমি ডায়াপার ব্যবহার করা থেকে শুরু করে সব ধরনের বিলাসিতায় বড় হয়েছো। যার পেছনে জান কী পরিমাণ কেমিক্যাল ব্যবহার হয়েছে? তারপর ভেবে দেখো কী হচ্ছে এখন ইউক্রেনে? আছে কি সভ্যতার কোনো গন্ধ? কীভাবে মারছে আর পুড়িয়ে দেশ তথা বিশ্বের বারোটা বাজাচ্ছে? এখন বলো কে পরিবেশ নষ্ট করেছে, আমি না তুমি?

আমার কথা চলাকালীন বেশকিছু লোক জড়ো হয়ে শুনছে। পরে আমাকে অনুরোধ করেছে আমি যেন সুইডিশ নিউজ পেপারে ঘটনাটি তুলে ধরি। তাদের অনুরোধ রাখতে সবে সুইডিশ ভাষায় লেখাটি শেষ করেছি। ভাবলাম বাংলাতেও বিষয়টি তুলে ধরি, তাই লেখা। ওপরের ঘটনাটির পেছনে যে বিষয়টি জড়িত তা হলো পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ।

সে আবার কী এবং উপরের ঘটনার সঙ্গে পৃথিবীর পরিবেশেরই বা কী সম্পর্ক? আসুন তাহলে জেনে নিই বিষয়ের ওপর কিছু তথ্য। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সুসমন্বিত রূপই হলো সুস্থ পরিবেশ। সুসমন্বিত রূপের ব্যত্যয়ই পরিবেশের দূষণ ঘটায়, যার কারণে পরিবেশের স্বাভাবিক মাত্রার অবক্ষয় দেখা দেয়।

পরিবেশ বিভিন্ন কারণে দূষিত হতে পারে। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণও এর জন্য দায়ী। পরিবেশ দূষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী কিছু মারাত্মক রাসায়নিক দ্রব্য, যেগুলোকে আমরা ডার্টি ডজন বলি। তাছাড়া আরো একটি দূষণ রয়েছে, যাকে বলা হয় শব্দদূষণ। শব্দদূষণ একটি জীবনকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিতে পারে, তা কি আমরা জানি? অনেকেই জানে না শব্দদূষণ কত ক্ষতিকর। যারা শব্দদূষণের সঙ্গে জন্ম থেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তারা তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যা তারা জানে না। যতটুকু জেনেছি বা দেখেছি তা হলো বাংলাদেশের শিক্ষার্থীর শব্দদূষণ বা পারিপার্শ্বিকতার কারণে বিদেশে অ্যাডজাস্ট করতে সমস্যা হচ্ছে না। তাদের সমস্যা দেখা যাচ্ছে শিক্ষা প্রশিক্ষণের ধরনের ওপর। কারণ দেশের মুখস্থ শিক্ষার কারণে এখানে লার্নিং বাই ডুইং কনসেপ্টের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করা কঠিন হয়ে পড়ছে অনেকের ক্ষেত্রে।

যা- হোক শব্দদূষণের কারণে বাংলাদেশে একজন সুইডিশ শিক্ষার্থীর মানসিক অসুস্থতার কথা জানার পর আমার বিবেক বেশ নাড়া দিয়েছে। শব্দদূষণের কারণে কি তাহলে বাংলাদেশের মানুষের চরিত্রের এমনটি বহিঃপ্রকাশ?

অফিসে অমনোযোগী। ক্লাসে অমনোযোগী। বাস ড্রাইভার, ট্রেনচালক লঞ্চচালকের অমনোযোগিতার কারণে কি এত দুর্ঘটনা? চিকিৎসকের ভুল ডায়াগনসিসের কারণে রোগীর অকালমৃত্যু ইত্যাদি।

রাতে ঘুমাতেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে নাক ডাকার প্রতিযোগিতা। বিচারক তার অমনোযোগিতার কারণে দিচ্ছেন রায়ে ভুল সিদ্ধান্ত। শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে ঘুমাচ্ছেন। প্রশাসন তার নিজের গতিতে চলছে। বিবেক তার ভারসাম্য হারিয়েছে বিধায় দুর্নীতি এখন সারা দেশে নীতিতে পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষের ভারসাম্য হারানোর পেছনে কি তাহলে শব্দদূষণই দায়ী? কী করণীয় থাকতে পারে শব্দদূষণ থেকে রেহাই পেতে? আদৌ সম্ভব কি বাংলাদেশের পরিবেশের পরিবর্তন করা? নাকি জাতি বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত।

অকারণে রিকশার ক্রিং ক্রিং শব্দ, গাড়ির হর্ন বাজানো, যেখানে-সেখানে মাইক লাগানো, সারা দিন মিছিলের চিত্কার এসব দূর করা আশু প্রয়োজন। ঘর-দুয়ার তৈরিতে শব্দনিরোধক উপাদান ব্যবহার করা দরকার, বিশেষ করে আবাসিক এলাকায়।

বহুদিন আগের কথা মুহূর্তে মনে পড়ে গেল, যা না উল্লেখ করলেই নয়। আমার এক সুইডিশ বান্ধবীর প্রথম সন্তান, বয়স দুই বছর হয়েছে সত্ত্বেও সে বান্ধবীর বুকের দুধ পান করা বন্ধ করছে না। আমাকে বিষয়টি জানালে বান্ধবীকে বললাম বুকের স্তনবৃন্তে একটু মরিচের গুঁড়ো দিতে, তাহলে ঝালের কারণে হয়তো সে দুধ পান করা ছেড়ে দেবে। বান্ধবী আমার কথামতো তাই করেছিল, কিন্তু তেমন কাজ হয়নি বরং ঘটনা ঘটেছিল উল্টো। বান্ধবীর সন্তান মরিচের গুঁড়ো না দিলে দুধ পান করতে পছন্দ করছে না বলে জানিয়েছিল। বান্ধবী বেশ বিপদে পড়েছিল আমার কথা শুনে। পরে বলেছিলাম মরিচের গুঁড়ো দেয়ার দরকার নেই দেখবে রুচির পরিবর্তনের কারণে দুধ পান করা ছেড়ে দেবে। কয়েক দিন যেতে না যেতে জানিয়েছিল তার সন্তান দুধ পান করা ছেড়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের হয়তো ঘুম নাও হতে পারে যদি শব্দদূষণ না থাকে প্রথম দিকে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং শব্দদূষণ প্রতিরোধ করতে পারলে জাতি স্বস্তি শান্তি ফিরে পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

পরিবেশের ভালো-মন্দ মানুষের কৃতকর্মের ফল। দিন দিন পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। মানুষ নিষ্ঠুরভাবে প্রকৃতি-পরিবেশকে বিনাশ করছে। প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এই যে নির্বিচারে আমরা সৃষ্টিকর্তার সাজানো প্রকৃতির বিনাশ করছি, এতে চূড়ান্ত ভুক্তভোগী কে হচ্ছে?

বিভিন্ন প্রাণীসহ মানুষ প্রকৃতির রোষানলে পড়ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। আমরা পরিবেশ দূষণ করছি হরদম। পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, শব্দদূষণচারদিকে দূষণ আর দূষণ।

শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হচ্ছে, পরিবেশ দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চরিত্রও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় মানুষ যেভাবে বাড়ছে, ভালো মানুষ সেভাবে বাড়ছে কি? মানুষ মানুষের ক্ষতি করছে। হত্যা, গুম, ধর্ষণ, দুর্নীতি, ঘুষ, অপসংস্কৃতি, মারামারি ইত্যাদি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মানুষ যেন অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। যতসব অকল্যাণ, অন্যায় কর্ম সৃষ্টি হচ্ছে, সবগুলোর জন্য দায়ী মানুষ।

পরিবেশের দূষিত উপাদান আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। সাগরের পানি দূষিত হওয়ায় বিপন্ন অনেক জলজ জীবন। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে মৌমাছির সংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনক হারে। পরাগায়নের মাধ্যমে আমাদের বিপুল পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনে মৌমাছির বিকল্প নেই। তাদের দুরবস্থা আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি।

আমরা যদি আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন না হই, তাহলে আমরা বেশি দিন পৃথিবীতে টিকতে পারব না। আমাদের কুকর্মের কারণে আমাদের ধ্বংস হবে। পরিবেশ বাঁচানোর প্রথম পদক্ষেপ আমাদেরই নিতে হবে। জীবনধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করলে দূষণের মাত্রা আরো কমবে।

যেমন প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে এবং সেসঙ্গে তার ব্যবহারও। নতুন প্রজন্ম বেশ ভাবতে শিখেছে, যদিও তারাই কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবেশ নষ্টের জন্য দায়ী যা তারা সরাসরি বুঝতে পারছে না।

পৃথিবীকে সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখতে সবাইকে যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের অস্তিত্ব আরো অনেক বছরের জন্য নিশ্চিত করতে পারব। এখানে আমরা বলতে শুধু সুইডেনকে বুঝলে হবে কি? বাংলাদেশের মানুষ এবং সরকারের কী করণীয় রয়েছে এবং কী প্ল্যান হাতে নেয়া হয়েছে সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে?

প্রাকৃতিক পরিবেশ সামাজিক পরিবেশ আজ মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে। দুই পরিবেশকেই সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে সচেতন ভালো মানুষের কোনো বিকল্প নেই। নিজেদের ভালো রাখার জন্য চলুন প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি করি, পরিবেশ সুরক্ষা করি।

 

রহমান মৃধা: সাবেক পরিচালক (প্রডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫