চা শ্রমিক দিবস

দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা, শিক্ষা স্বাস্থ্যেও পিছিয়ে চা শ্রমিকরা

প্রকাশ: মে ২০, ২০২২

আফরোজ আহমেদ, মৌলভীবাজার

১৯২১ সালের ২০ মে। চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে পিতৃপুরুষের আদি ঠিকানায় ফিরে যেতে চাওয়া চা শ্রমিকদের ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্যরা। মৃত্যু হয়েছিল কয়েক হাজার শ্রমিকের। এর পর থেকে প্রতি বছরই দিনটিতে নিহত সে শ্রমিকদের স্মরণ করা হচ্ছে। পালন করা হচ্ছে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে।

ওই ঘটনার পর পেরিয়েছে ঠিক ১০১ বছর। দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সবকিছুতেই পরিবর্তন এসেছে অনেক। বদলায়নি চা শ্রমিকদের জীবন। সারা দিনের খাটুনির পর বাগানে মজুরি মিলছে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানিসহ মৌলিক সব সূচকেই পিছিয়ে চা শ্রমিকের জীবন।

দেশে চায়ের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। সিলেটের মালনীছড়ায় স্থাপিত বাংলাদেশের প্রথম চা বাগানটির মালিকানা ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। এরপর একে একে বাড়তে থাকে চা বাগানের সংখ্যা। এসব বাগান তৈরি পরিচর্যার জন্য শ্রমিক সংগ্রহ করা হতো বর্তমান ভারতের আসাম, ওড়িশা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে। দরিদ্র শ্রমিকদের নিয়ে আসা হতো নানা প্রলোভন দেখিয়ে। যদিও কিছুদিনের মধ্যেই তা পরিণত হতো দুঃস্বপ্নে। বিশাল পাহাড় বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে বাগান তৈরি করতে গিয়ে মারা পড়েন অনেকে। খাটুনিও ছিল অমানুষিক। জীবনযাত্রাও ছিল মানবেতর।

এভাবেই পেরিয়ে যায় অনেক দিন। একপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলতে থাকেন চা শ্রমিকরা। চা বাগানের জীবনযাত্রা থেকে বেরিয়ে আসতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা। মুল্লুক চলো (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন চা শ্রমিক নেতা গঙ্গাচরণ দীক্ষিত দেওসরন।

তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে একত্র হন সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। ১৯২১ সালের মে মাসে সিলেট থেকে পায়ে হেঁটে নিজ দেশের উদ্দেশে বের হন শ্রমিকরা। দীর্ঘ পদযাত্রা খাবারের অভাবে পথেই মৃত্যু হয় অনেকের। চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটে পৌঁছার পর তাদের ফেরাতে নির্বিচারে গুলি চালায় ব্রিটিশ সেনারা। গুলিতে মৃত্যু হয় শত শত শ্রমিকের। সেদিনের সে হত্যাযজ্ঞে নিহত শ্রমিকের কোনো স্পষ্ট পরিসংখ্যান নেই। বলা হয়, মৃত শ্রমিকদের দেহ সে সময় প্রমত্তা মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে অন্যরা ফিরে আসেন বাগানে। এরপর থেকে ২০ মে দিনটিকে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন চা শ্রমিকরা।

দিবসটির ১০১ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। মুল্লুক চলো বা নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন দেশের চা জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শতবছরের বেশি সময় পেরোলেও আজও দিবসটির সরকারি স্বীকৃতি মেলেনি।

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসেনি দরিদ্র চা শ্রমিকদেরও। এখনো সর্বোচ্চ দৈনিক ১২০ টাকা মজুরিতে বাগানে কাজ করছেন তারা। চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদ (বিটিএ) চা-শ্রমিক ইউনিয়নের চুক্তির ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারণ করা হয়। প্রতি দুই বছরের জন্য চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে দৈনিক ১১৭-১২০ টাকা করে পাচ্ছেন চা শ্রমিকরা। এজন্য একজন শ্রেণীর শ্রমিক দিনে ১২০ টাকা, বি শ্রেণীর শ্রমিক ১১৮ সি শ্রেণীর বাগানের শ্রমিক ১১৭ টাকা পেয়ে থাকেন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এরপর করোনা মহামারীসহ নানা কারণে আর কোনো চুক্তি সম্পাদন হয়নি।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাহী উপদেষ্টা সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী জানান, ২০১৯ সালের অক্টোবরে গঠন করা হয় মজুরি বোর্ড। কিন্তু শুরুতেই বোর্ড বিতর্কের জন্ম দেয়। ২০২১ সালের ১৩ জুন মজুরি বোর্ড চা শ্রমিকদের মজুরি ১১৭-১২০ টাকা করে খসড়া ঘোষণা দেয়। অথচ খসড়া প্রকাশের আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকেই চা শ্রমিকরা ১১৭-১২০ টাকা করে পাচ্ছেন। এতে আমাদের সঙ্গে তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে। গত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রায় দেড় বছর অতিক্রম হয়েছে কিন্তু মজুরি বোর্ড মজুরি সুপারিশ করতে পারেনি।

তিনি আরো বলেন, শোষণ-প্রতারণার শিকার হয়ে ১০১ বছর আগে চা শ্রমিকরা যখন নিজ দেশে ফেরত যেতে চেয়েছিলেন, তখন তাদের ফেরাতে গুলি চালানো হয়। অথচ এখন শ্রমিকরা যখন চা বাগানে থাকতে চান, তখন তাদের নানা কৌশলে বের করে দেয়া হচ্ছে।

তবে খাতটির উদ্যোক্তারা বলছেন, মজুরি কম হলেও আবাসন, চিকিৎসা, রেশনের মতো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে শ্রমিকদের। বাংলাদেশীয় চা সংসদ সিলেট অঞ্চলের সভাপতি গোলাম মো. শিবলি বলেন, শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কম হলেও চা বাগান মালিকরা তাদের থাকার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, রেশন ইত্যাদির মতো সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করেন, যা অর্থের দিক দিয়ে পরিমাপ করা হয় না। সব সুযোগ-সুবিধা হিসাব করলে তাদের মাসিক মজুরি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা হয়।

চা শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্যমতে, দেশে চা জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় আট লাখ। তার মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিক এক লাখ। অনিয়মিত শ্রমিক সংখ্যা আরো প্রায় ৪০ হাজার। শুধু মজুরি নয়, জীবনযাত্রার অন্যান্য সূচকেও অনেক পিছিয়ে চা জনগোষ্ঠী। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, শিক্ষা-চিকিৎসার সংকট তাদের চিরকালীন। সুপেয় পানি স্যানিটেশনের সমস্যাও রয়েছে অধিকাংশ চা বাগানে।

২০১৯ সালে সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলোর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রথমবারের মতো জরিপ চালায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, অপুষ্টির কারণে চা বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশুই খর্বাকায়। ২৭ শতাংশ শীর্ণকায়। স্বল্প ওজনের শিশু ৪৭ দশমিক শতাংশ। তাছাড়া ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ৪৬ শতাংশ কিশোরীর এবং মা হয়ে যাচ্ছে ২২ শতাংশ। এছাড়া ন্যূনতম স্যানিটেশন সুবিধা নেই চা বাগানের ৬৭ শতাংশ পরিবারের।

এর আগে ২০১৮ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোর নারীদের ওপর একটি গবেষণা করে জানায়, চা বাগানের প্রায় ১৫ শতাংশ নারী জরায়ু ক্যানসারে ভুগছেন।

সচেতনরা বলছেন, স্বল্পমজুরি, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবার অভাব, শিক্ষার অভাব কুসংস্কারের কারণে অপুষ্টি সংক্রামক-অসংক্রামক নানা রোগের শিকার হচ্ছেন চা বাগানের নারী শিশুরা।

চা শ্রমিক ইউনিয়ন মৌলভীবাজারের মনু দলই ভ্যালির সভাপতি ধরা বাউরী বলেন, স্বল্পমজুরির পাশাপাশি আরো নানা ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন চা শ্রমিকরা। প্রায় ২০০ বছর একই জমিতে বসবাস করেও এখন পর্যন্ত ভূমির অধিকার আমাদের নেই। বেশির ভাগ বাগানেই বিদ্যালয় নেই। আবার প্রাথমিকের পর শিক্ষার দায়িত্বও নেয় না বাগান কর্তৃপক্ষ। বেশির ভাগ বাগানে নামমাত্র একটি চিকিৎসা কেন্দ্র থাকলেও জটিল কোনো রোগ হলে নিজ খরচে বাইরে চিকিৎসা করাতে হয়।

চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে চা বোর্ডের নিবন্ধিত বাগান রয়েছে ১৬৭টি। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯১টি, হবিগঞ্জে ২৫, সিলেটে ১৯, চট্টগ্রামে ২২, পঞ্চগড়ে সাত, রাঙ্গামাটিতে দুই ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগানে মোট জমির পরিমাণ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৯ একর। দেশে মোট উৎপাদিত চায়ের দুই-তৃতীয়াংশ আসে মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলো থেকে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫