ভাষা সংগ্রাম

শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ও জাতীয় জাগরণ

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২২

ড. এম আকতারুজ্জামান

মাতৃভাষাই যেকোনো দেশের স্বাভাবিক ভাষা। ফ্রান্স, জার্মানি, জাপানসহ যেকোনো উন্নত দেশের মানুষ যার যার মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করা যায়, তবে তা খুবই কঠিন এবং প্রচুর সময়েরও অপচয় হয়। অন্যদিকে তাতে উন্নতির পরিবর্তে অবনতিই হয় বেশি। উন্নত দেশের লোকেরা প্রথমে মাতৃভাষায় লেখাপড়ার মূল কাজটি সেরে নেয়, তারা আবার অন্যদিকে প্রয়োজনমতো এক বা একাধিক অন্য ভাষাও বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই শিখে ফেলে। এভাবে মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে উন্নত দেশগুলো বিকশিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত জীবনের সব দিক দিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশ ইংরেজ আমলে ২০০ বছর তার গোলাম ছিল। আমাদের রাষ্ট্রভাষাও ছিল ইংরেজি। শিক্ষা অফিস-আদালতের ভাষাও ছিল ইংরেজি। সে লেখাপড়াও ছিল সাধারণ জনগণের সামর্থ্যের বাইরে বা ব্যয়বহুল। ব্রিটিশ আমলে অনেকেই খারাপ রেজাল্ট করত বা ফেল করত পরীক্ষায়। এভাবে পুরো জাতির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে ছিল। তবে একেবারেই যে কেউ ভালো রেজাল্ট করত না তা নয়, তবে এদের সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল। এরূপ রুদ্ধ পঙ্গু জাতিকে শোষণ-শাসন ঠকানো সহজ হয়। আমরা বাঙালি জাতির লোকেরা এভাবেই ঠকে যাচ্ছিলাম অতীতে। ব্রিটিশরা প্রস্থানের কালেও আমাদের পঙ্গু করে রেখে যায়, অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা পাঞ্জাবকে ভাগ করে দুটি দেশ তৈরি করে এবং ইংরেজিকে ঠিকই শিক্ষার মাধ্যম অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে বহাল রেখে যায়। আজ ইংরেজিতে শিক্ষা, যা ইংলিশ মিডিয়ামের নামে দেশে অনেক স্কুল বিদ্যমান রয়েছে এবং এই আভিজাত্য বেড়েই চলছে। অন্যদিকে উর্দু, আরবির মাধ্যমেও মাদ্রাসার প্রসার এখনো দিন দিন বেড়েই চলছে। এভাবে আমরা প্রতিনিয়ত ঠকে ঠকে যাচ্ছি। সহজ চিন্তা অনেকেরই মাথার মধ্যে ঢুকতে চায় না।

শিক্ষার মাধ্যম বাংলা: আজ আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছি। আমাদের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা এখনো পূরণ হয়নি। কিন্তু আমরা একটি আশার আলো দেখতে পাচ্ছি আর তা হলো, আমাদের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বেশির ভাগই ভালো রেজাল্ট করে যাচ্ছে। অর্থাৎ জিপিএ লাভ করছে বিপুলভাবে। কারণটি হলো, তারা মাতৃভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া করে যাচ্ছে বলে। এই যে আশাপ্রদ চিত্রটি, তার পেছনে আমরা অনেককে স্মরণ করতে পারি। সেই অক্ষয় কুমার দত্ত থেকে জগদীশ চন্দ্র বসু হয়ে . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পর্যন্ত যারা বিদেশী জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মাতৃভাষায় বর্ণনা করে বাঙালি জাতিকে সমৃদ্ধ করেছেন, আমরা তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু ব্যাপারে যিনি পুরো জাতিকে নাড়া দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জনক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ লেকচারার আবুল কাসেম। সেই ব্রিটিশ আমলেই তিনি শিক্ষক হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং তার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক সত্যেন বসু, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ। তারই নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত এবং সফলতা অর্জিত হয়েছিল। হাতে-কলমে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে সফল করার জন্য এরপর তিনি নিজের উপার্জিত অর্থে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজের প্রাণপুরুষ প্রথম প্রিন্সিপাল ছিলেন আবুল কাসেম। স্কুল-কলেজে তখন বাংলা ভাষায় কোনো বিজ্ঞানের পাঠ্যবই ছিল না। তিনিআমাদের প্রেসনামে একটি ছাপাখানা নিজের পারিবারিক অর্থে চালু করেন এবং স্কুল-কলেজের প্রায় ৪০টি বিজ্ঞানের পাঠ্যবই নিজে বাংলায় লেখেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে পাঠ্যবই রচনার ব্যাপারে বাঙালি জাতির তিনি এক অনন্য পথপ্রদর্শক। পথ ধরে বর্তমানে অনেক প্রতিভাবান শিক্ষক বাংলা ভাষায় উচ্চতর শিক্ষার পাঠ্যবই প্রণয়ন করে চলেছেন। ফলে আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শুরু: আসলে আবুল কাসেম, তমদ্দুন মজলিস রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তিনটি নাম একসঙ্গে মিশে রয়েছে। ব্রিটিশরা যখন ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা পাঞ্জাব ভাগ করে ভারতীয় উপমহাদেশকে দুই ভাগে ভাগ করে ভারত পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র তৈরি করবে বলে মত দেয়, তখন কংগ্রেস ঘোষণা দেয় যে তাদের ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দি। সুরে সুর মিলিয়ে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি . জিয়া উদ্দীন ঘোষণা দেনপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। সে সময় . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজাদ পত্রিকায় একটি লেখার মাধ্যমে . জিয়া উদ্দীনের ঘোষণার তীব্র নিন্দা জানান এবং বলেন যে সংখ্যগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই দেখা গেল সবকিছু ইংরেজ আমলের মতোই চলছে। সবকিছুই ইংরেজি অথবা উর্দুতে চলছে, যেমন তখনকার সিভিল সার্ভিসসহ সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ইংরেজি, উর্দু ইত্যাদি ভাষায় হচ্ছে। এভাবে পূর্ব বাংলার লোকেরা ব্রিটিশ আমলের মতোই আবারো পিছিয়ে পড়ছিল। সে দুর্দিনে নেতারা সবাই তখনো কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। দুর্দিনে মানুষের চেতনাকে কীভাবে উজ্জীবিত করা যায় এবং পঙ্গুত্বের অবসান করা যায়, তা নিয়ে কারো কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরাই এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন। তরুণ শিক্ষক আবুল কাসেম তার প্রিয় শিক্ষক . কাজী মোতাহার হোসেন, . মুহম্মদ শহীদুল্লাহী রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখের সহযোগিতায় তরুণদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনতমদ্দুন মজলিসগড়ে তোলেন। তরুণরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা তত্কালীন মুসলীম লীগের প্রগতিশীল অংশের (শহীদ সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিম গ্রুপের) কর্মী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যেমন সামসুল হক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ফজলুর রহমান ভূইয়া, নুরুল হক ভূইয়া, একেএম আহসান, মোফাখখারুল ইসলাম প্রমুখ। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। তার ১৫ দিন পরে সংগঠন একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে, যার নাম ছিলপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু এখানে তিনজন লেখক পুস্তিকা রচনা করেন। তারা হলেন আবুল কাসেম, . কাজী মোতাহার হোসেন আবুল মনসুর আহমদ। বইটিতে বাংলাকেযা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষাঅন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা অফিস-আদালতের ভাষা হবে বাংলা। ওই বইয়ে আবুল মনসুর আহমদ বলেন, ‘জনগণের ভাষা রাষ্ট্রের ভাষা এক না হইলে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিতে পারে না। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি অশিক্ষিত সরকারি চাকরির অযোগ্য বনিয়া যাইবেন। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফার্সির জায়গায় ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি অশিক্ষিত সরকারি চাকুরির অযোগ্য করিয়াছিল।. কাজী মোতাহার হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের ওপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা করা হয় তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।আবুল কাসেম বলেন, ‘এমনকি লাহোর প্রস্তাবেও পাকিস্তানের প্রত্যেক ইউনিটকে সার্বভৌমত্ব স্বাধীনতার অধিকার দেয়া হয়েছে। কাজেই প্রত্যেক ইউনিটকে তাদের স্ব-স্ব প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নির্ধারণ করার স্বাধীনতা দিতে হবে।আর এভাবে পুস্তকটি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা সূচিত করে। তমদ্দুন মজলিস তখন পুস্তকটি ছাত্র-জনতার মধ্যে ছড়িয়ে এর মর্মবাণী প্রচার করতে থাকে। তারা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বা তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটিও গঠন করে। তখন প্রগতিশীল সবাই ওই সংগ্রাম পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। প্রথম দিকে আবুল কাসেমের বাড়ির একটি কক্ষে এর অফিস ছিল। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রশিদ বিল্ডিংয়ের একটি কক্ষে তমদ্দুন মজলিসের অফিস ছিল। ছাত্রলীগ প্রগতিশীল মুসলিম লীগের কর্মীরা একসঙ্গে এখানেই কাজ করতেন। ওই সময়ে তারা দেশব্যাপী কাজটি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। পুস্তিকাটি দিয়ে তারা তত্কালীন পার্লামেন্টের পূর্ব বাংলার এমএলএদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। প্রচেষ্টাতেই ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এমএলএ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান পার্লামেন্টে উর্দু ইংরেজি ভাষার সঙ্গে বাংলাতেও বক্তৃতার সুযোগ দেয়ার দাবি জানান। কিন্তু লিয়াকত আলী খান সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। খবরে তমদ্দুন মজলিসের সবাই দারুণভাবে আহত হন। পরদিন সংগ্রাম পরিষদ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের আহবান করে। এমনই এক ধর্মঘটে পুলিশি হয়রানি নির্যাতনের প্রতিবাদে ১১ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়। ১১ মার্চের প্রতিবাদ দিবস ব্যাপকভাবে সাফল্যমণ্ডিত হয়। পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেফতার হন কাজী গোলাম মাহবুব, সামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, রণেশ দাসগুপ্ত, আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী প্রমুখ। ওই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগের নেতারা হরতাল সমর্থন করেন এবং ট্রেনসহ অন্যান্য যানবাহন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রাখা সম্ভব হয়েছিল। এরপর ১১, ১২, ১৩, ১৪ ১৫ তারিখ পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত ছিল। এরই মধ্যে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা সফরের সময় ঘনিয়ে আসে। জিন্নাহ সাহেবের আগমন সামনে রেখে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব আবুল কাসেমকে পত্রযোগে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আলোচনার প্রস্তাব দেন এবং কামরুদ্দীনের কাছেও প্রতিনিধি পাঠান। রাষ্ট্রভাষার দাবি মেনে নেয়ার শর্তে ১৫ মার্চে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরে সংগ্রাম পরিষদ রাষ্ট্রপক্ষ উভয়েই সম্মত হয়। চুক্তি অনুযায়ী আন্দোলনে বন্দি ছাত্রনেতাদের মুক্তি দেয়া হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় ফজলুল হলে মুক্তিপ্রাপ্ত ছাত্রনেতাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়।

২১ ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন: এরপর প্রতি বছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ২৭ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে তত্কালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে রাষ্ট্রভাষা চুক্তির সঙ্গে বিশ্বাঘাতকতা করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। তখন পুনরায় আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। খাজা নাজিমুদ্দিনের ওই গাদ্দারি ঘোষণার বিরুদ্ধে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল সংসদ, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ, পূর্ব পাকিস্তান মোহাজের সমিতি প্রভৃতি সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা কাজী গোলাম মাহবুবকে কনভেনর করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রাম পরিষদে মওলানা ভাসানী মনীষী আবুল হাশিমকেও সদস্য হিসেবে রাখা হয়। এরপর সংগ্রাম পরিষদ ওই সভায় ২১ ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সংগ্রাম পরিষদের নানা তত্পরতা সারা দেশে চলতে থাকে। হঠাৎ করেই সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে ৯৪ নং নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে। নির্বাচন সামনে রেখে যদিও ১৭ বনাম ভোটে ওই সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এটাও সিদ্ধান্ত হয় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদ ছাত্রনেতারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাই মেনে নেয়া হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ১০ জন করে ছাত্রছাত্রী রাস্তায় মিছিল স্লোগান দিয়ে বের হচ্ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে পুলিশ টহল দিচ্ছিল। শুরু হলো পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ, ধরপাকড় এবং এক পর্যায়ে বেলা ২টার দিকে এলোপাতাড়ি গুলি চলল। শহীদ হলেন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত প্রমুখ। সংবাদে ঢাকাসহ সারা দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ২২ ফেব্রুয়ারি হত্যাযজ্ঞের খবর তমদ্দুন মজলিসের সাপ্তাহিক পত্রিকা সৈনিক বের করে। বিশেষ সংখ্যা হিসেবে পরপর দুদিন সংখ্যা পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল ব্যাপক জনতার ভিড় চাহিদার কারণে। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গ আইনসভার নির্বাচনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থক দলগুলো নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদে তমদ্দুন মজলিসের দুজন নেতা অধ্যাপক আবুল কাসেম কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলী সদস্য নির্বাচিত হন। প্রাদেশিক আইন পরিষদে অধ্যাপক আবুল কাসেম বাংলাকে সরকারি অফিসাদির ভাষা শিক্ষার বাহন করার দাবিতে প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। গণপরিষদে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে এটি গৃহীত হয়। এতে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এভাবে আবুল কাসেমের তত্পরতায় এবং অন্য সব নেতা ছাত্র-ছাত্রীর সাহসী পদক্ষেপে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক বিজয় সূচিত হয়।

প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের বহুমুখী অবদান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ লেকচারার আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস গড়ে উঠেছিল। দেশব্যাপী তিনি তমদ্দুন মজলিসের শাখা গড়ে তুলেছিলেন। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান প্রত্যেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সংগঠনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মনীষী আবুল হাশিম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, . কাজী মোতাহার হোসেন, লেখক রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ প্রমুখ ব্যক্তিকে তমদ্দুন মজলিসের কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে এর কার্যক্রমকে গৌরবান্বিত করেছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রমেশ দাস গুপ্ত, অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যক্ষ ডা. যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তী, অন্নদাশঙ্কর রায় (কলকাতা), তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক অতুল সেন, অধ্যাপক বি আর রায় প্রমুখ ব্যক্তি তমদ্দুন মজলিসের কার্যক্রমকে দারুণভাবে সহযোগিতা করে সংগঠনকে মহিমান্বিত করেছেন। আবুল কাসেম সাহেব মজলিসের কার্যক্রমের মধ্যে রেখেছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, শিক্ষা আন্দোলন, অসুস্থ কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ, সাংস্কৃতিক সম্মেলন, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা, বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা, ইসলামী একাডেমি প্রতিষ্ঠা, ছাত্র সংগঠন রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি। এসবের মধ্যে অনেকগুলোতেই তিনি সফল হয়েছিলেন। সংগঠনের মূল আদর্শ ছিল সব জমি সম্পদের মালিক একজন সৃষ্টিকর্তা এবং তার সৃষ্ট সব মানুষই ভাই ভাই। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। মানবিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই সংগঠনের তত্পরতা ছিল ব্যাপকভাবে। উল্লেখ্য, বরিশালের বাবুগঞ্জের একজন জমিদার ছিলেন আলতাবুদ্দিন মাহমুদ। তিনি তমদ্দুন মজলিসের ১৯৫০ সালের দাঙ্গাবিরোধী কর্মসূচি বাস্তবায়নে জীবন বাজি রেখে সাম্প্রদায়িক হানাদারদের সঙ্গে লড়েছেন। ওই এলাকার হিন্দুদের বাড়িঘর ভেঙেচুরে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য একদল মুসলমান নামধারী উচ্ছৃঙ্খল লোককে তিনি বাধা দেন। এক পর্যায়ে তিনি আক্রান্ত হন এবং দুর্বৃত্তদের হাতে তিনি প্রাণ দেন। খবর সাপ্তাহিক সৈনিকে এপ্রিল ১৯৫০ সালে পরিবেশিত হয়।

আবুল কাসেম ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার হিসেবে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখেন এবং এটি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে গৃহীত হয়ে ১৯৫৪ সালে সরকারের কাছে প্রেরিত হয় এবং তমদ্দুন মজলিসের সুন্দর পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার এটি প্রতিষ্ঠিত করেছিল যখন আবুল কাসেম আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। বাংলা একাডেমির নীতিনির্ধারণ একাডেমির কার্যক্রমে বাংলা চালুর তিনি সফল প্রচেষ্টা চালান। আগেই বলা হয়েছে, তিনি বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলায় বহু বই রচনা করেন। কাজটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন। তবে তিনি সফল হয়েছিলেন কাজে এবং এসব কাজ এত কঠিন সময়সাপেক্ষ ছিল যে তিনি তমদ্দুন মজলিসের অন্যান্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সময় পাননি, যেমন রাজনৈতিক ফ্রন্ট ছাত্রফ্রন্ট তার সময়ের অভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। জাতির জাগরণে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম যে অসামান্য অবদান রেখেছেন, তা দেশবাসী গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান শিক্ষক, যিনি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যে পথ বেয়ে পরবর্তীকালে আমাদের সব জাতীয় আন্দোলন প্রভাবান্বিত হয়েছে এবং ধীরে ধীরে স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধের সাহস জুগিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম হয়েছেআমরা এই অসাধারণ ব্যক্তির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ করা হলে জাতি হবে গর্বিত।

 

. এম আকতারুজ্জামান: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫