আফ্রিকার দেশগুলোয় কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের ব্যাপারে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে টাস্কফোর্স গঠন ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেও এতদিন সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়নি। এবার আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে জমি ইজারা নিয়ে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের সুযোগ কাজে লাগাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এভাবে চাষাবাদ শুরুর মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি আফ্রিকায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে বলেও আশা করা হচ্ছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে আফ্রিকার কঙ্গোয় শিগগিরই পাইলট প্রকল্প শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোয় পাইলট প্রজেক্ট গ্রহণের জন্য সেদেশে নিয়োজিত বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী কন্টিজেন্টের মাধ্যমে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদবিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের সম্ভাব্যতা ও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল শিগগির দেশটি সফরে যাবে। সভার কার্যপত্র সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থা, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে আফ্রিকায় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ সম্ভাবনার ওপর একটি সভার আয়োজন করা হবে। এছাড়া চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি মডেল খসড়া চুক্তি প্রণয়ন করবে। আফ্রিকার সম্ভাব্য দেশগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং অন্যান্য অঞ্চলে বাংলাদেশে শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে কঙ্গোয় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আফ্রিকার কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের লক্ষ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। কিছু কিছু দেশ আগ্রহও প্রকাশ করেছে। আগ্রহী দেশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পাইলট প্রজেক্ট গ্রহণ করা হচ্ছে।
সচিব জানান, এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে বেসরকারি উদ্যোক্তা শনাক্ত করে তাদেরকেই বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হবে। সরকার আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, জমি অধিগ্রহণ এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
জানা গেছে, বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, লেবানন, দক্ষিণ সুদান, সুদান (দারফুর), পশ্চিম
সাহারা, মালি, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রসহ আটটি দেশে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন আছে। এসব দেশের সঙ্গেই জমি ইজারা নিয়ে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের আলোচনা চলছে।
সভায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা বলেন, আফ্রিকার দেশগুলোয় ধাপে ধাপে ব্যাপক সংখ্যক বাংলাদেশীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। ইথিওপিয়ার পোশাক শিল্প খাত বাংলাদেশী শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করেই বিকশিত হয়েছে। আফ্রিকার অধিকাংশ দেশের জমি উর্বর। সে দেশের লোকবলসহ বাংলাদেশী অদক্ষ-অর্ধদক্ষ শ্রমিকের সমন্বয়ে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ শুরু করে উভয় দেশের ব্যাপক লাভবান হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র পরিসরে চাষাবাদ শুরুর পরামর্শ দিয়ে তারা প্রথমে এক মিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন।
এ প্রসঙ্গে মিসরে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনিরুল ইসলাম সভায় বলেন, আফ্রিকার দেশগুলো থেকে বেতন ও লভ্যাংশ দেশে পাঠাতে কোনো সমস্যা নেই। তাই এসব দেশে চুক্তিভিত্তিক বাণিজ্যিক চাষাবাদের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করার পরামর্শ দেন। স্বাগতিক দেশের জনবলসহ বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিয়ে প্রকল্প শুরুর ব্যাপারে তিনি দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই বিনিয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
কঙ্গো সম্পর্কে তিনি বলেন, দারিদ্র্য, অস্থিতিশীলতা, যুদ্ধবিগ্রহ, দুর্বল অবকাঠামো, অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সত্ত্বেও দেশটির আবহাওয়া, উর্বর মাটি, সেচসুবিধা, সুপেয় পানির সহজলভ্যতার কারণে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের জন্য এটি আদর্শ স্থান। দেশটিতে প্রচুর পরিমাণে কৃষিপণ্য উৎপাদন সম্ভব। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে পাশের দেশ রুয়ান্ডা ও উগান্ডায় পণ্য রফতানির সুযোগও রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে মাঝারি এবং ব্যক্তিগত শিল্প উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মো. আমিন হেলালী সভায় অংশ নিয়ে সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে জমি ইজারা গ্রহণের মাধ্যমে চাষাবাদ শুরুর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। টেকসই বিনিয়োগ ও ব্যবসার স্বার্থে দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ১০ শতাংশ নিজস্ব অর্থায়ন এবং সরকারের ৯০ শতাংশ প্রণোদনা ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এ ব্যবসায় উৎসাহিত করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে গত ২৩ নভেম্বর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের যৌথ সভাপতিত্বে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদে আফ্রিকার দেশগুলোয় জমি লিজ নিয়ে আরো একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভাশেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আফ্রিকার দেশগুলোতে জমি ইজারা নেয়ার মাধ্যমে চাষাবাদের সুযোগ পেলে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশীর কর্মসংস্থান হতে পারে। এজন্য আফ্রিকার দেশগুলোয় শান্তিরক্ষা মিশনগুলো চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের সুযোগ বিষয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে আফ্রিকার দেশগুলো বাংলাদেশকে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদের প্রস্তাব দিয়ে আসছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে খসড়াটি তৈরি করলেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আফ্রিকায় জমি ইজারা নেয়ার সুযোগ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করলেও তেমন সাড়া পায়নি। অথচ একই সময়ে চীন, মিসর, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ আফ্রিকায় চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ করে সফলতা পেয়েছে।