তিস্তার পানি

আন্তর্জাতিক রীতিনীতির আলোকে বণ্টন হোক

প্রকাশ: জানুয়ারি ২২, ২০২২

তিস্তা দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি, মত্স্য খাদ্য ব্যবস্থার জন্য পানির বড়  আধার। বিশেষ করে অববাহিকাসংলগ্ন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য নদীর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক আইনি বিধি ব্যবস্থা অনুযায়ী একটি আন্তঃদেশীয় নদী হিসেবে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের অধিকার। কিন্তু সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারী আলোচকরা অভিযোগ করেন, দুই দশকের বেশি সময় ধরে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে নদী থেকে একচেটিয়া পানি প্রত্যাহার করে আসছে ভারত। ফলে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানিপ্রবাহ ক্রমে কমে গেছে। এতে তিস্তার পানির ওপর নিভর্রশীল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২টি উপজেলায় কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আবার বর্ষার পানি ছেড়ে দেয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা দেখা দিচ্ছে। বিদ্যমান সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ভারতকে বার্ষিক হাইড্রোলজিক্যাল মূল্যায়নে বসার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তিস্তা নদীর অববাহিকা ভারত বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই দুই দেশকেই এই সংকট সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। তিস্তা কৃষি, মত্স্য এবং খাদ্য ব্যবস্থার জন্য পানির প্রধান উৎস। পানি নদী শাসন, আঞ্চলিক বিরোধ জলবায়ু পরিবর্তন ধারাবাহিকভাবে জনগণের অধিকারকে প্রভাবিত করছে। তাই টেকসই দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের মাধ্যমে নদীকে রক্ষা করা জরুরি। তিস্তায় যখন পূর্ণমাত্রায় পানি আসত তখন শুষ্ক মৌসুমে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হতো। সাধারণভাবে ধান চাষ করলে যে ব্যয় হয়, সেচ প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে সেই ধান চাষ করলে ব্যয় হয় ২০ ভাগের ভাগ। রংপুরের মঙ্গা দূরীকরণে তিস্তা সেচ প্রকল্প অনন্য ভূমিকা পালন করছে এখন। সেই সেচ প্রকল্প কার্যত শুষ্ক মৌসুমে অচল। যে আট হাজার হেক্টর জমিতে রেশনিং সিস্টেমে পানি দিয়ে ধান চাষ করা হচ্ছে, তা নদীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই ছেড়ে দেয়া প্রয়োজন। তিস্তায় পানি না থাকার কারণে আরো অসংখ্য সমস্যা দেখা দেয়। উত্তরের জীবনের জন্য তিস্তার পানির কোনো বিকল্প নেই।

তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত আলোচনা অনেক পুরনো। দেশ স্বাধীনের পর পরই ১৯৭২ সালে তিস্তার পানি নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের দ্বিতীয় সভায় আলোচনা হয়। ১৯৮৩ সালে অন্তর্বর্তীকালীন একটি চুক্তিও হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ছিল ৩৬ শতাংশ, ভারত ৩৯ শতাংশ আর ২৫ শতাংশ পানি ছিল নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য। ১৯৮৫ সালে সেই অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ১৯৮৭ সালে মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। এরপর আর কোনো চুক্তি হয়নি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসঙ্গেই বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সফরের আগ মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর এলেন না। মনমোহন সিং সহজেই বললেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছাড়া তিনি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করবেন না। এরপর বর্তমান সরকারের সময়ও তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত হলেও স্বাক্ষর হয়নি।

১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনটি ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকে আইনে পরিণত হয়েছে। সেখানে উজানের দেশ থেকে ভাটির দেশে প্রবাহিত নদীর পানি কীভাবে ব্যবহূত হবে, তার দিকনির্দেশনা আছে। যে নদীর পানি যে খাতে প্রবাহিত হয়, সেই নদীর পানি সেই খাতে না রেখে খাত পরিবর্তন করলে তা নদীর জন্য কল্যাণের হবে না। ভারতের যেটি তোরসা নদী বাংলাদেশে তা দুধকুমার। ভারতের যেটি জলঢাকা, বাংলাদেশে তা ধরলা নদী। নদীতে এমন উল্লেখযোগ্য পানি থাকে না, যা দিয়ে তিস্তার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। আর দুটি নদীতে পানি থাকলেও তা দিয়ে তিস্তার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হতো না।

জাতিসংঘে গৃহীত কনভেনশনে পানিসম্পদ ব্যবহারবিষয়ক আর্টিকেল-- বলা হয়েছে, কোনো প্রবাহিত অভিন্ন বা আন্তর্জাতিক নদীর উপকূলবর্তী দেশগুলো ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পানিসম্পদ ব্যবহার করবে। সীমান্ত নদী কিংবা জলাধার ব্যবহারের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যা ভূমির পরিমাণ অনুযায়ী পানিসম্পদ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ আইনেও অভিন্ন নদী বা সীমান্তবর্তী জলাধারের যৌথ ব্যবস্থাপনা, ন্যায্য পানি বণ্টনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে বিভিন্ন দেশ অভিন্ন নদীর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করছে। এর মধ্যে দানিয়ুব নদীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। মধ্য পূর্ব ইউরোপের ১২টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর তীরবর্তী অঞ্চলকে পটে আঁকা ছবির মতো রক্ষণাবেক্ষণ করছে তারা। দানিয়ুবের তীরে গড়ে উঠেছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা, হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট, সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডসহ জার্মানি থেকে রুমানিয়ায় বিস্তৃত বিভিন্ন নয়নাভিরাম শহর-বন্দর। নর্থ সির তীর থেকে ব্ল্যাক সির তীর পর্যন্ত রয়েছে দানিয়ুবের নাব্যতা জাহাজ চলাচলের সব সুযোগ-সুবিধা। শুধু জাহাজ চলাচল সেচ ব্যবস্থারই সূত্র নয়, অঞ্চলে মিঠা পানির মাছ পানীয় জলের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে দানিয়ুব। এতটা কাল পারস্পরিক অঙ্গীকার, দায়িত্বশীলতা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির ভিত্তিতে নদীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেছে দেশগুলো। এটা আমাদের অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে শিক্ষণীয়।

তিস্তায় পানি সংকটের প্রভাব বিপুল। ধারাবাহিকভাবে পানিপ্রবাহ কমে আসায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদন করতে পারেনি তিস্তা-তীরবর্তী মানুষ। সন্দেহ নেই, তেমনটা হলে শক্তিশালী হতো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তা বলয় এবং একইভাবে বাড়াতে পারত অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা ওই অঞ্চলের কৃষকের আয়। তিস্তায় পানির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও আরেক ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। আর তা হলো পরিবেশগত ক্ষতি। পানির অভাবে নদী অববাহিকায় প্রতিবেশগত ভারসাম্য, প্রাকৃতিক কার্যাবলি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে; হুমকিতে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। আমরা দেখছি তিস্তার পানি না পেয়ে সেচের জন্য অনেক কৃষক ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছেন। এতে তাদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে, পরিবেশে পড়ছে বিরূপ প্রভাব।

নদী নিয়ে দুই রকম কমিশন আছে। একটি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন আর একটি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের যে আইন রয়েছে, তাতে ভারতের সঙ্গে আলাপ করার ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়নি। আর যৌথ নদী কমিশন বছরে চারবার করে সভা করার কথা থাকলেও একবারও বৈঠক হয় না। তাছাড়া তিস্তা প্রসঙ্গে যৌথ নদী কমিশনের কোনো কার্যক্রম আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। অবস্থা দেখে মনে হয়, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির সম্ভাবনা অনেকটাই ঝিমিয়ে গেছে। বড় চেষ্টা আসতে হবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেই। এক্ষেত্রে তিস্তা নদীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তত্পরতা সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি। আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি ভাগাভাগির ক্ষেত্রে চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চুক্তির মাধ্যমেই একটি দেশের পানির হিস্যা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হয়। তিস্তাসহ ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রতিটি নদীর পানি সমতা নীতির ভিত্তিতে বণ্টন হবে বলে প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারকে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫