চালের বাজারে প্রভাবক হয়ে উঠছে করপোরেটগুলো

প্রকাশ: ডিসেম্বর ২৭, ২০২১

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। দেশের প্রধান উৎপাদিত শস্যও এটি। মূলত প্রাচীন আধুনিক পদ্ধতির মিশেলে দেশে ধানের চাষ হয়। এরপর স্থানীয় মিল চাতালের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত ধান রূপান্তরিত হয় চালে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সংগ্রহ পদ্ধতির মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণীর হাত ধরে এসব চাল পৌঁছে যায় গ্রাম বা শহরের হাট, খুচরা, পাইকারি বাজার, সুপারশপ মুদি দোকানে। দীর্ঘদিন ধরে খুচরা বিক্রেতারাই সাধারণ ভোক্তাদের কাছে চাল পৌঁছে দিয়েছেন। তবে সময়ের সঙ্গে চালের বিপণন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। এখন বড় করপোরেট গ্রুপগুলো চাল ব্যবসায় আগ্রহী হচ্ছে। চাল সংগ্রহ বিপণন প্রক্রিয়ায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত হওয়ায় পরিবর্তন আসছে ভোক্তা চাহিদা বাজার ব্যবস্থাপনায়ও। ফলে চালের বাজারে বেশ প্রভাব রাখতে শুরু করেছে এসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান।

দেশের প্রায় শতভাগ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটিতে বড় ব্যবসার সুযোগ রয়েছে। তাই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে দেশের বড় শিল্প গ্রুপগুলো। সম্প্রতি ধান থেকে চাল রূপান্তর বিপণন খাতে দেশের বেশ কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপ বিনিয়োগ করেছে। খাতে বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে আরো কয়েকটি গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠান চালকে তাদের অন্যান্য কনজিউমার পণ্যের মতোই বিবেচনা করছে। সেভাবেই সাজানো হচ্ছে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা। পাইকারি বাজারগুলোয় নিয়োগ দেয়া হয়েছে চৌকস দক্ষ বিপণন কর্মকর্তা। যারা ছোট-বড় দোকান ঘুরে ক্রয়াদেশ নিচ্ছেন এবং নিজেদের ব্র্যান্ডের চাল নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দিচ্ছেন। দেশের যেকোনো প্রান্তে মিলছে সুদৃশ্য মোড়কজাত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চাল। ফলে চাল কিনতে এখন আর মোকাম, আড়ত কিংবা পাইকারি বাজারে যেতে হচ্ছে না খুচরা বিক্রেতাকে। যেহেতু পাইকারি বাজারে গিয়ে যে দামে তারা চাল কিনে আনতেন, সেই একই দামেই চাল পেয়ে যাচ্ছেন, তাই খুচরা বিক্রেতার বরং লাভই হচ্ছে।

অন্যদিকে মধ্য উচ্চবিত্ত ক্রেতার একটি অংশ অনলাইনেই চাল পেয়ে যাচ্ছেন। সুগন্ধি চালের ক্ষেত্রে এক, দুই বা পাঁচ কেজির মোড়কে চাল বিপণন করলেও এখন পাটের বস্তায় ১০ কেজি, ২৫ কেজি ৫০ কেজির চাল বিপণন করছে এসব বড় কোম্পানি। মিনিকেট, নাজিরশাইল বা কাটারিভোগ যেটাই ক্রেতার প্রয়োজন, সেটাই পাওয়া যাচ্ছে হাতের নাগালে।

১৯৯৭ সালের দিকে দেশে প্রথম মোড়কজাত সুগন্ধি চাল বাজারজাত করে প্রাণ। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সুগন্ধি চাল মোড়কজাত করে বিপণনে নামে। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানগুলো সুগন্ধি চালের পাশাপাশি রোজকার ভাতের জন্য বিভিন্ন গ্রেডের চালও মোড়কজাত করে বিক্রি করতে শুরু করে। মোড়কজাত এসব চালের দাম কিছুটা বেশি হলেও নিজস্ব বিপণন কৌশলের কারণে ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে এদের চালের বাজার। মুহূর্তে দেশের বাজারে রয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপের ব্র্যান্ড পার্বণ, স্কয়ার গ্রুপের চাষী, টিকে গ্রুপের পুষ্টি, এসিআই গ্রুপের পিওর, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রাণ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল গ্রুপের রূপচাঁদা, আকিজ গ্রুপের এসেনশিয়াল, সিটি গ্রুপের তীর, মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ, র্যাংকস গ্রুপের নবান্ন।

সব বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানই এখন চাল খাতে বড় বিনিয়োগ করছে। এছাড়া একাধিক মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান উত্তরবঙ্গভিত্তিক চালের চাতাল মিল পর্যায়ে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রধান খাদ্যপণ্যের বাজারে নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে।

দেশের পাইকারি বাজারে চাল বিপণন পদ্ধতি হচ্ছে উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন মিল চাতালের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিনের নির্ধারিত বাজারমূল্যে চাল কিনে নেয়া। বাকি বা নগদ দামে কিনে নেয়া এসব চাল আড়তে এনে বাজারমূল্য অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে বিক্রি করা হয় ছোট পাইকারি খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। পদ্ধতিতে চালের দাম চাহিদা সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল থাকে। সরবরাহ বাড়লে দাম কমতে থাকে। আর সরবরাহ কমতে শুরু করলে দামও বেড়ে যায়। কিন্তু বড় শিল্প গ্রুপগুলো চাল বিপণনে আসায় বাকিতে চাল কেনার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। ফলে সংকটকালে দেশের সরবরাহ চেইনকে স্থিতিশীল রাখা যাবে কিনা সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এছাড়া ধানের উত্তোলন মৌসুমে দেশের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ব্যবসার জন্য আলাদা করে চাল সংগ্রহ শুরু করলে চালের সংকট তৈরি হতে পারে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়ে চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ওমর আজম বণিক বার্তাকে বলেন, করপোরেট কোম্পানিগুলোর চাল বিপণন কার্যক্রমের সুফল হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন ক্রেতাও মোড়কজাত ব্র্যান্ডের চাল সংগ্রহ করতে পারছেন। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ না, তাই বড় প্রতিষ্ঠানগুলো খাতে আগ্রহী হওয়ায় চাল নিয়ে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ তৈরি হতে পারে, যা দেশের স্বাভাবিক সরবরাহ চেইনের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এমনিতেই গ্রামগঞ্জে মিল চাতাল মালিকদের ধান সংগ্রহকালে অর্থাৎ মৌসুমের শুরুতে চালের দাম বেড়ে যায়। বড় কোম্পানিগুলো ধান সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করলে সরকার চাহিদা অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারবে না। ফলে দেশের বাজারে চালের দাম বেশ বেড়ে যাবে। কিন্তু এর সুফল আবার মাঠের কৃষক পাবেন না। অথচ ভোক্তাদের ঠিকই বেশি দামে পণ্যটি কিনতে হবে। এসব সংকট মোকাবেলায় বড় কোম্পানিগুলোর চাল বিপণন কার্যক্রমের জন্য সরকারি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে যেকোনো উৎপাদিত, মোড়কজাতকৃত বা আমদানির মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্যের একচেটিয়া বিপণন, কারসাজিসহ অতিমুনাফা রোধে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হয়। প্রতিযোগিতা আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা। কমিশনের কার্যাবলির প্রধানতম শর্ত হচ্ছে বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী অনুশীলন নির্মূল করা, প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা বজায় রাখা। পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যায়ে প্রতিযোগিতা কমিশনকেই বাজার নিয়ন্ত্রণ বড় কোম্পানিগুলোর চাল বিপণন ব্যবস্থার দিকে নজর দেয়া উচিত।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক . মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের প্রধানতম শস্য ধান বা চাল। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন না থাকায় বছর বছর পণ্যটির দাম বাড়ে। সনাতনী পদ্ধতির চাল উৎপাদন, সংগ্রহ কিংবা বিপণন কার্যক্রমেও চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়। গত -১০ বছরে দেশের বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো চাল বিপণন কার্যক্রমে বড় বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। অতীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বড় বিনিয়োগের রিটার্ন বা অতিমুনাফার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের কারসাজির আশ্রয় নেয়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা করে দেয়া না হলে কিংবা প্রতিযোগিতা কমিশনকে কাজে লাগানো না হলে ভবিষ্যতে দেশের সবচেয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যটির বাজারে সংকট দেখা দিতে পারে। তেমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই চালের বাজারে বড় শিল্প গ্রুপের বিনিয়োগের তদারকি নিয়ন্ত্রণ জরুরি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫