জাহাজ ভাঙা শিল্প

দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলেই আমদানি নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত

প্রকাশ: ডিসেম্বর ০৫, ২০২১

দেবব্রত রায়, চট্টগ্রাম ব্যুরো

শ্রমিক কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হলেই আমদানি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে জাহাজ ভাঙা শিল্পে। ইয়ার্ডগুলোতে একের পর এক শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ায় পদক্ষেপ নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয় যদিও সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি তুলেছেন ইয়ার্ড মালিকরা।

শ্রম আইনের ৭৮() ধারা অনুযায়ী শিপইয়ার্ডের ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়টি মালিকপক্ষ থেকে নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি শিপইয়ার্ডে সেফটি কমিটি গঠন পরিচালনা করতে হবে। হাতেগোনা দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকছে বলে উঠে এসেছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্তে।

চট্টগ্রাম কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক (সেফটি) মাহমুদুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডের শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্তকারী দলের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেখানে নিরাপত্তা ইস্যুতে বেশকিছু বড় ধরনের অসংগতি আছে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। মালিকপক্ষ সাধারণত খরচ কমানোর চিন্তা করে থাকে। ধারাবাহিক দুর্ঘটনা তার একটি অন্যতম কারণ। আমরা ইয়ার্ডগুলোকে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকার বিষয়টি সামনে আসায় ইয়ার্ডগুলোকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে অভিযুক্ত ইয়ার্ড মালিকদের বড় অংকের জরিমানাসহ স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিতে তিন থেকে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ১০টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাসহ জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে গত ১৪ সেপ্টেম্বর সীতাকুণ্ডের মাদার স্টিল শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে শ্রমিকরা একটি ট্রাক থেকে অক্সিজেনের বোতল নামানোর সময় অক্সিজেন সিলিন্ডারের মুখ ফসকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মো. নাজিম নামের এক ব্যবসায়ীর মাথার ওপর পড়লে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে চমেকে ভর্তি করা হলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনার পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী দল তদন্তে ইয়ার্ডে সেফটিতে নানা ধরনের অসংগতি খুঁজে পেলে গত ১৬ নভেম্বর মাদার স্টিল শিপব্রেকিং ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষকে লাখ টাকা জরিমানা এবং নির্দেশ দেয়ার চার মাস পর্যন্ত সব ধরনের স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শিল্প মন্ত্রণালয়।

এর আগে গত ১৯ জুন সীতাকুণ্ডের মাদামবিবিরহাট এলাকায় মেসার্স এসএন করপোরেশন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে রিপন চাকমা (২৬) নামের এক শ্রমিক গ্যাস বিস্ফোরণে মারা যান। সময় আরো তিনজন গুরুতর আহত হন। তদন্তে ইয়ার্ডটির গাফিলতি প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিতে লাখ টাকা জরিমানাসহ তিন মাসের জাহাজ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এদিকে ২৯ সেপ্টেম্বর পুরনো জাহাজ ভাঙার সময় কাজ করতে গিয়ে কেএসআরএমের মালিকানাধীন মেসার্স খাজা শিপ ব্রেকিং লিমিটেডে মারা যান মো. তছলিম উদ্দিন (৪০) নামে এক শ্রমিক। পরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ইয়ার্ডের গাফিলতার প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকেও লাখ টাকা জরিমানাসহ চার মাসের জন্য সব ধরনের জাহাজ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠান দুটিকে আগেও ধরনের শাস্তির আওতায় এনেছিল মন্ত্রণালয়।

এদিকে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানির নিষেধাজ্ঞা মানতে রাজি নন ইয়ার্ড মালিকরা। সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চেয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়কে ২০ নভেম্বর চিঠি দিয়েছে জাহাজ ভাঙা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইকেলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) চিঠিতে বিএসবিআরএ বলছে, দেশের উন্নয়নে জাহাজ ভাঙা শিল্প বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু অন্য কোনো শিল্প খাতে রকম জরিমানা এবং আমদানির নিষেধাজ্ঞার মতো ঘটনা ঘটেনি। ফলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করা যুক্তিসংগত নয়।

সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট পিএইচপি শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম রিংকু প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, সম্প্রতি জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডের বিরুদ্ধে যে জরিমানা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের অন্য কোনো শিল্প খাতে তেমন নজির নেই। আমরা শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছি না। এজন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। এভাবে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়লে জাহাজ ভাঙা শিল্প খাত টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে।

শ্রমিক আইনের ৭৮() ধারায় বলা আছে, শিপইয়ার্ডের ব্যক্তিগত সুরক্ষার বিষয়টি মালিকপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি শিপইয়ার্ডে সেফটি কমিটি গঠন পরিচালনা করতে হবে। মালিক পক্ষের তিনজন এবং ওই ইয়ার্ডের শ্রমিক পক্ষের তিনজন মিলিয়ে মোট ছয় সদস্যবিশিষ্ট সেফটি কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি প্রতি মাসে অন্তত একবার মাসিক আলোচনা সভার আয়োজন করবে। সভায় শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিতে রেজিস্টার ব্যবহার, সেফটি ইস্যুতে শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, কর্মঘণ্টা অনুযায়ী বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়েছে কিনা, শ্রমিকরা কাজের সময় নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করাসহ নানা বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে সেফটি কমিটি।

তবে ভুক্তভোগী শ্রমিকরা বলছেন, শিপইয়ার্ডগুলোতে শ্রমিকদের সুরক্ষায় ইয়ার্ডগুলোতে নামমাত্র ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে দু-একটি ইয়ার্ডে সেফটি কমিটি আছে। দু-একটি সেফটি কমিটির উদাহরণ দিয়ে সব ইয়ার্ডে সেফটি কমিটি আছে বলে দেখানো হয়। প্রতি মাসে মাসিক যে আলোচনা সভা করার নিয়ম আছে, সেটাও মানা হয় না। শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য যেসব পোশাক দরকার, সেগুলো ব্যবহারের উপযোগী নয় বলে বেশির ভাগ সময়ই শ্রমিকরা তা পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তাছাড়া অনেক ইয়ার্ড মালিকেরা তাদের কাজ ঠিকাদারির মাধ্যমে করে থাকে। যার কারণে ঠিকাদারদের তাদের অন্তর্গত শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা থাকলেও তারা করছেন না।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা নিয়মিত। তবে সম্প্রতি শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটার পর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তদন্তে গিয়ে আমাদের প্রতিনিধি দল সেখানে নানা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছেন। তদন্তাধীন শিপ ইয়ার্ডগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা, ইয়ার্ডে দক্ষ প্রশিক্ষিত শ্রমিক না থাকা, সেফটি অফিসার এবং ইয়ার্ড ম্যানেজারের কাজে গাফিলতি পাওয়া গেছে। যার কারণে এখন অভিযুক্ত প্রমান হলে পাঁচলাখ জারিমানাসহ অভিযোগের গুরুত্ব বুঝে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জাহাজ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে। অনুরূপ ঘটনা আবারো যদি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়বে প্রতিষ্ঠানগুলো বলে জানান কর্মকর্তারা।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়া) মো. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডগুলোকে জরিমানা এবং নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সঠিক হলেও আমি বিষয় নিয়ে এখনই মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইয়ং পাওয়ার ইন সোস্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী শাহিন বণিক বার্তাকে বলেন, জাহাজ ভাঙা শিল্পে শ্রমিক মৃত্যু কমানো এবং ইয়ার্ডের সেফটি নিশ্চিত করতে কাজ করছে সরকার। বারবার শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় দেশে বিদেশে খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। মালিকপক্ষ তাদের শিপইয়ার্ডগুলো গ্রিন শিপইয়ার্ডে পরিণত করলে শ্রমিক মৃত্যু কমে যাবে। সরকারের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে মালিকপক্ষের কাছে আবেদন থাকবে তারা যেন শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করে ইয়ার্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫