দেশের বাজারে ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে লাগাম টানতে গত অক্টোবরে বেশকিছু পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সম্প্রতি বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে স্পট পণ্যবাজার ও ফিউচার মার্কেটের বুকিং দরে পতন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ায় এ পতনের গতি আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে অব্যাহত এ দরপতনের কোনো প্রভাব দেশের বাজারে পড়েনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার দাম নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে দেশের বাজারে পণ্যের দাম কমেনি। আবার বিশ্ববাজারে মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতার সময়ে বাড়তি দামে মজুদ করার কারণেও পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম কমছে না।
এর আগে বিশ্ববাজারে পণ্যের বুকিং বাড়লে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর জন্য আবেদন করেন মিল মালিকরা। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর একাধিকবার ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে হয়েছে সরকারকে। কিন্তু এখন বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করলেও দেশের বাজারে দাম কমানোর কোনো উদ্যোগই নেই মিল মালিকদের। সরকারিভাবে বেঁধে দেয়া মূল্যে ভোজ্যতেল বিপণন হওয়ায় বিশ্ববাজারে মূল্যের ওঠানামা দেশে প্রভাব ফেলছে না বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশে ভোগ্যপণ্যের দামে অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণপূর্বক যৌক্তিক হারে পণ্যের মিলগেট ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি দেখভাল করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মূল্য পর্যবেক্ষণ ও নির্ধারণ কমিটি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সাত দফায় ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়। আইন অনুযায়ী ১৫ দিন অন্তর সুপারিশের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণের কথা থাকলেও গত ১৭ অক্টোবরের পর দেশে ভোজ্যতেলের নির্ধারিত দামে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি।
খাতুনগঞ্জের ট্রেডিং ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক বণিক বার্তাকে বলেন, সরকার অক্টোবরে লিটারপ্রতি ৭ টাকা দাম বাড়িয়ে ভোজ্যতেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও ভোগ্যপণ্যের অন্যতম প্রধান এ পণ্যের দাম পুনর্নির্ধারণে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আবার বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ায় আমদানিকারকরা নিজ উদ্যোগে দাম কমানোরও প্রস্তাব করেননি। এ কারণে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে এর প্রভাব নেই। একইভাবে শুল্ক কমানোর পর দাম কিছুটা কমলেও চিনির সরকারি মূল্য সমন্বয় হয়নি, যার কারণে সরবরাহ চেইনে বিলম্ব আর মিল মালিকদের অনীহায় ভোগ্যপণ্যের বাজারে প্রত্যাশিত সমন্বয় হচ্ছে না।
ইনডেক্স মুন্ডি ডটকমের তথ্য বলছে, গত অক্টোবরে কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে ছিল বৈশ্বিক পণ্যবাজার। কিন্তু নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পর পণ্যমূল্য কমতে শুরু করে। সর্বশেষ গত কয়েক দিনে পণ্যের বুকিং মূল্য গত মাসের তুলনায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এর মধ্যে ২৮ নভেম্বর পাম অয়েলের বুকিং মূল্য ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ১৭৫ ডলার। যদিও অক্টোবরে অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৩০৬ ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে পাম অয়েলের বুকিং কমেছে ১৩১ ডলার। এছাড়া সয়াবিনের বুকিং মূল্য অক্টোবরে ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৪৮৩ ডলার। ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববাজারে সয়াবিনের বুকিং ১৬৭ ডলার কমে নেমে এসেছে টনপ্রতি ১ হাজার ৩১৬ ডলারে। এর মধ্যে গত মে ও জুনে বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। মে মাসে সয়াবিন ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৫৬৮ ডলার এবং জুনে ছিল ১ হাজার ৫১৮ ডলার। এ হিসাবে সয়াবিন ও পাম অয়েলের বুকিং দর রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধির পর দৃশ্যমান কমলেও দেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। এছাড়া অক্টোবরে গমের বুকিং দর ২৯৪ থেকে কমে ২৮ নভেম্বর ১৮৬ ডলারে নেমে এলেও দেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব এখনো পরিলক্ষিত হয়নি।
করোনার সংক্রামক নতুন ধরন শনাক্ত হওয়ার পর আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এরই মধ্যে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। ২০২০ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে প্রথম দফায় সব ধরনের পণ্যবাজারে ব্যাপক পতন শুরু হয়। যদিও টিকা আবিষ্কারের পর ভাইরাসের প্রকোপ কমে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী পতনের মুখে থাকা শেয়ারবাজার, জ্বালানি, ইস্পাত, ভোগ্যপণ্য, কেমিক্যালসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। নতুন করে পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী কনটেইনার সংকট ও পণ্য সরবরাহের শিপিং খাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এতে শিপিং চার্জ বেড়ে উৎপাদক দেশের বিক্রি হওয়া দামের চেয়েও আমদানিকারক দেশে পণ্যবাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি বৈশ্বিক পণ্যবাজারের ধারাবাহিক বৃদ্ধিকে উসকে দিয়েছিল। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে জ্বালানির দরপতনে পণ্যবাজারেও নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে কমলেও দেশীয় পণ্যবাজারে উল্লেখ করার মতো দাম কমেনি। বরং এক সপ্তাহ ধরে পাইকারি পর্যায়ে ডালজাতীয় পণ্যের দাম কেজিপ্রতি কয়েক টাকা করে বেড়েছে। ভোগ্যপণ্যের দেশীয় বাজারে প্রভাব বিস্তারকারী পণ্য ভোজ্যতেলের সরকারি বেঁধে দেয়া দামের কারণে বাজার ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় স্থিতিশীল রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া আগের মজুদ লোকসানে বিক্রিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনীহা রয়েছে। পাশাপাশি মিল মালিকদের পণ্য সরবরাহে দীর্ঘসূত্রতা ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে বলেও মনে করছেন তারা।
বিশ্ববাজারে দাম কমতে থাকলেও দেশের বাজারে প্রত্যাশিত প্রভাব না পড়ার কারণ জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক পর্যায়ের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ২০১০-১১ সালে বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে বেশি দামে পণ্য এনে অনেক ব্যবসায়ীকে লোকসানের মুখে পড়তে হয়। বর্তমানে যেভাবে দাম বেড়েছে তাতে বৈশ্বিক দরপতন দীর্ঘায়িত হলে দেশের বাজারেও আমদানিকারকদের বড় লোকসান হবে। ফলে কেউই এখন দাম কমানো বা সমন্বয়ে আগ্রহী হবে না। তবে বেশি দামে কেনা পণ্যের মজুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভোগ্যপণ্যের বাজারে এ অস্থিরতা থাকবে বলেও মনে করছেন তারা।
তবে চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বিষয়টিকে দেখছেন ভিন্নভাবে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ভোগ্যপণ্যের বৈশ্বিক ও দেশীয় বাজার নিকট অতীতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। মানুষের ক্রয়সীমারও বাইরে পণ্যবাজার চলে যাওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষ কষ্টে দিনযাপন করছে। সরকার সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে দ্রব্যমূল্য যতটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় সে বিষয়ে আন্তরিক। বেশকিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়ে বাজারকে নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
সরকারিভাবে নতুন করে দাম বেঁধে দেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ ভোক্তার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি ও লোকসানের বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া দরকার উল্লেখ করে মাহবুবুল আলম বলেন, বিশ্ববাজারে ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা চাইলে আসন্ন লোকসানের ভয়ে পণ্য আমদানি বন্ধ বা কমিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া ও দেশের স্বাভাবিক সরবরাহ ধরে রাখতে তারা ঝুঁকি নিয়ে হলেও পণ্য আমদানি অব্যাহত রেখেছিলেন। বর্তমানে নতুন করে ভোগ্যপণ্যের দাম কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভোগ্যপণ্য বাজারসহ এ খাতের সঙ্গে যুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, গত এক সপ্তাহে ভোজ্যতেলের মধ্যে পাম অয়েলের দাম মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ২০-৩০ টাকা কমে লেনদেন হচ্ছে ৪ হাজার ৯০০ টাকায়, সয়াবিনের দাম সমপরিমাণ কমে ৫ হাজার ৪০০ টাকায়, চিনির দাম একই অবস্থানে থেকে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৬৪০ টাকায়। তবে গমের দাম আগের মতোই মণপ্রতি ১ হাজার ১৩০ টাকা (ইন্ডিয়ান) এবং কানাডা থেকে আমদানি হওয়া গম বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৬০ টাকা দরে। অন্যদিকে ডাবলি (অ্যাংকর) বাড়তি অবস্থায় স্থিতিশীল দাম কেজিপ্রতি ৪৫ টাকায়, কানাডিয়ান মোটা মসুর ৮৭ টাকায়, চিকন মসুর ১০০ টাকায়, ছোলা ৬১-৬৩ টাকায়, মুগডাল ১১৩-১১৬ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।
গত ১৫ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পর পেঁয়াজ ও চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার ছাড়াও চিনির নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ৩০ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়। চিনির নতুন শুল্কহার কার্যকর থাকবে আগামী বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং পেঁয়াজের নতুন শুল্কহার কার্যকর থাকবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বৈশ্বিক বুকিং বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্কহার কমালেও বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের শুল্কহার কমানোর বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
এদিকে বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী ও বনস্পতি উৎপাদক সমিতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে সয়াবিনের লিটারপ্রতি বোতলজাত দাম ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে চিনির শুল্ক কমানো সত্ত্বেও চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের নির্ধারিত চিনির দাম কেজিপ্রতি ৬৬ টাকা হওয়ায় দেশের বাজারে এখনো চিনির বাজার সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসেনি। মূলত সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগের মাধ্যমে বর্ধিত ভোগ্যপণ্যের দাম সমন্বয় না করায় বিশ্ববাজারে দরপতন সত্ত্বেও দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ছে না বলেই মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
তবে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আফজাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, সরকার বেঁধে দিয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা দাম কমাতে পারছেন না—এ রকম কোনো তথ্য যদি থাকে তাহলে বিষয়টি অবশ্যই আমরা বিবেচনা করে দেখব।