ইইউর জিএসপি সুবিধা নেয়া বন্ধ করছে চীন

প্রকাশ: নভেম্বর ২৭, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইউরোপে পণ্য রফতানিতে অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) পেয়ে আসছিলেন চীনের রফতানিকারকরা। এজন্য এতদিন পণ্য রফতানির আগে চীন সরকারের কাছ থেকে সার্টিফিকেট অব অরিজিন (উৎসের সনদ বা সিও) সংগ্রহ করতে হয়েছে তাদের। সাম্প্রতিক এক ঘোষণায় চীন সরকার বলেছে, এখন থেকে দেশটিতে আর কোনো সিও ইস্যু করা হবে না। সনদ না থাকায় দেশটির রফতানিকারকরাও এখন আর ইইউ থেকে জিএসপি সুবিধা পাবেন না।

কাগজে-কলমে উন্নত বলা না হলেও গত কয়েক দশকে বহুদূর এগিয়েছে চীনের অর্থনীতি। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি হওয়ার প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে দেশটি। তথাকথিত স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এতদিন ইউরোপে জিএসপি সুবিধা পেয়ে এসেছে চীন। ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোয় সুবিধা প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। বিষয়টিতে সম্মতি রয়েছে বেইজিংয়েরও। এরই ভিত্তিতে স্থানীয় রফতানিকারকদের সিও ইস্যু করা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে দেশটির শুল্ক কর্তৃপক্ষ।

চীনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব কাস্টমসের (সিজিএসি) বরাতে দেশটির স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বর থেকে ইউরোপে জিএসপি সুবিধার বিপরীতে আর কোনো সিও ইস্যু করা হবে না।

বেইজিংয়ের নতুন ঘোষণাকে এখন এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর শিল্প খাতের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। তারা বলছেন, চীন থেকে বিভিন্ন দেশে শিল্প স্থানান্তরের কথা অনেক দিন ধরেই চলমান ছিল। নতুন ঘোষণাটি বাস্তবায়ন হলে বিনিয়োগ স্থানান্তর কার্যক্রম আরো গতিশীল হয়ে উঠবে। 

বাংলাদেশ ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো নতুন সিদ্ধান্তের ফলে লাভবান হতে যাচ্ছে। ভিয়েতনামে এরই মধ্যে বেশকিছু শিল্প-কারখানা স্থানান্তর হয়েছে। কিছুটা ধীরগতিতে হলেও বাংলাদেশে বিষয়টি এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হতে শুরু করেছে। নতুন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে বড় মাত্রায় বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা নিয়ে নতুন করে স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

তাদের ভাষ্যমতে, চীনে শ্রম ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশটিতে গড়ে ওঠা শিল্পগুলো অন্য দেশে সরে যাওয়া শুরু হয়েছিল। এসব শিল্প বিনিয়োগ বাংলাদেশে স্থানান্তরের সম্ভাবনাও আগেই দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সে সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে বড় অনেক বিনিয়োগ প্রকল্প বাংলাদেশে না এসে চলে গিয়েছে ভিয়েতনামে। তবে এখন চীন সরকার জিএসপির বিপরীতে সিও ইস্যু করা বন্ধ করে দেয়ায় পুরনো সম্ভাবনা নতুন করে ধরা দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, নতুন যে সিদ্ধান্তের তথ্য পাওয়া গিয়েছে, আমি মনে করি এটা আমাদের অনুকূলে আসবে। তবে সুযোগ এবং সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আমাদের শিল্প দক্ষতা বাড়াতে হবে। এছাড়া ভাবমূর্তি নষ্ট করে এমন যেকোনো কিছুকে দূরে রাখার বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে। কারণ ভাবমূর্তির মতো বিষয়ে কোনো ব্যাঘাত ঘটলে তাতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিমুখ হতে পারেন।

তিনি আরো বলেন, তবে আমরা তা কতটা নিতে পারব, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। এছাড়া ব্যবসার ব্যয় বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলোও আমলে নিতে হবে। কারণ এগুলো নিশ্চিত না হলে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব না। চায়না প্লাস ওয়ান হিসেবে বাংলাদেশের সম্ভাবনা আগে থেকেই থাকলেও তা আমরা ধরতে পারিনি, কিন্তু প্রতিযোগী দেশগুলো পেরেছে। কারণ সক্ষমতার বিষয়ে আমরা মনোযোগী হতে পারিনি।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যে দেখা যায়, বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ চীন। বৈশ্বিক পোশাক রফতানির বাজারে দেশটির অংশীদারিত্ব ৩১ দশমিক শতাংশ। গত বছর মহামারীর কারণে তা ২০১৯ সালের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে প্রায় শতাংশ। কভিডের মধ্যেই গত বছর ভিয়েতনামের পোশাক রফতানি কমেছে শতাংশ। তার পরও পোশাক রফতানির পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে বিশ্ববাজারে দেশটির অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। ওই সময় বাংলাদেশের পোশাক রফতানি কমেছে ১৫ শতাংশ। গত বছর দুই দেশেরই বাজার অংশীদারিত্ব ছিল দশমিক শতাংশ।

দেশের শিল্প খাতে চীনের বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। তাদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। বিশেষ করে দেশের বস্ত্র পোশাক খাতের জন্য বিনিয়োগ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খাতে কৃত্রিম তন্তুর মতো উচ্চমাত্রায় মূল্য সংযোজনকারী পণ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় শূন্য। প্রেক্ষাপটে হাই ভ্যালু বা উচ্চমাত্রায় মূল্য সংযোজনে সক্ষম বিনিয়োগ প্রকল্প এখন বাংলাদেশের জন্য সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।

বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, চীনের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ লাভবান হবে কথা পুরোপুরি ঠিক। সিদ্ধান্তে এটা স্পষ্ট যে তারা বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করছে। দেশটিতে এখন বিদ্যুৎ নিয়ে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারী শিল্পগুলোর ওপর প্রভাব না পড়লেও পড়ছে তুলনামূলক ছোট শিল্পগুলোয়। অর্থাৎ ভারী শিল্পের দিকে এখনো মনোযোগ রয়েছে চীনের। ছোটখাটো শিল্প অন্য দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে স্থানান্তর প্রক্রিয়া আরো গতি পাবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই বাংলাদেশের সম্ভাবনায় বাড়তি মাত্রা যোগ হবে। কারণ ইউরোপে জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্তিতে সনদ দেয়া বন্ধ করলে দেশটির রফতানি বন্ধ হয়ে যাবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পও বন্ধ হবে বা সরে যাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতা নেই বা কম আছে এমন খাতগুলোকে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন।

সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাই বর্তমান পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের জন্য বড় মাত্রায় লাভজনক করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চীন জিএসপির বিপরীতে সনদ দেয়া বন্ধ করলে দেশটি থেকে শিল্প সরে বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা আরো বাড়বে, কথা ঠিক। আমাদের ক্রেতারাও চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরিয়ে নিচ্ছে। সেগুলো যাচ্ছে ভারত, পাকিস্তানে। বাংলাদেশও ওই ক্রয়াদেশগুলো ধরতে পারবে, যদি সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকে। আমাদের জন্য সুযোগ নতুন করে আবারো ধরা দিতে চাচ্ছে। সুযোগ কাজে লাগাতে সরকার, ব্যক্তি খাতসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

এদিকে চীনের সরকারি প্রতিনিধিরাও বিশ্ববাজারে চীনা পণ্যের শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত বিষয়ে নিজস্ব অবস্থান তুলে ধরতে শুরু করেছেন। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর চায়না সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক এক্সচেঞ্জের ভাইস চেয়ারম্যান এবং প্রাক্তন বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়েই জিয়াংগু লিখেছেন, চীন তার বাণিজ্য উন্নয়নে স্বাতন্ত্র্য লাভ করতে পেরেছে। যেহেতু উন্নয়ন এমন এক পর্যায়ে বৃদ্ধি পেয়েছে যে উন্নত দেশগুলো আর চীনকে অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক সুবিধা দিতে পারবে না; সেহেতু দেশটির বাণিজ্য শিগগিরই একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করবে, যা উৎপাদনের পরিবর্তে উদ্ভাবনী খাতগুলোয় মনোনিবেশ করতে আরো সহায়তা করবে। এরই মধ্যে মেড ইন চায়না পণ্যগুলো বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। চীনও এখন শ্রমনিবিড় শিল্পের ওপর নির্ভর করা বন্ধ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে শ্রমের মূল্য অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। এজন্য বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হচ্ছেন। চীনে মুহূর্তে সবকিছুর দামে ঊর্ধ্বগতি রয়েছে। তাই বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশে পর্যাপ্ত জনবল আছে। তাদের এসব খাতের জন্য দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে অনেকটা কম খরচেই রফতানিমুখী এসব পণ্য উৎপাদন সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, চীন এখন পর্যন্ত এলডিসি মর্যাদাভুক্ত হলেও বাস্তবে তারা উন্নত দেশের কাতারে। প্রেক্ষাপটে ইউরোপের মতো বড় বাজারের জিএসপি পেতে চীন যদি সনদ দেয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে দেশটির রফতানিকারকরা শুল্ক সুবিধা পাবেন না। দেশটিতে স্থানীয়সহ বিপুল পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ আছে। শুল্ক সুবিধা বন্ধ হয়ে গেলে শিল্পগুলোর মুনাফার সুযোগ অনেক কমে যাবে। প্রেক্ষাপটে ভিয়েতনাম, ভারতের মতো দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশেও শিল্প সরে আসার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। তবে তা রাতারাতি হবে না। অবধারিতভাবেই শিল্পগুলোকে সরে আসতে হবে পর্যায়ক্রমে, যার প্রতিফলন দেখা যাবে বিনিয়োগ প্রবাহে।

দেশে বর্তমানে চীন থেকে বিদেশী বিনিয়োগের প্রবাহ (এফডিআই) বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে এফডিআই প্রবাহের পরিমাণ ছিল কোটি লাখ ডলারের কিছু বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে ৯৩ শতাংশ বেড়ে তা ১৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছর পর্যন্ত চীন থেকে বাংলাদেশে আসা এফডিআই স্টক বা পুঞ্জীভূত প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের আকার ছিল ১০৭ কোটি ৮৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। এফডিআই স্টক বিবেচনায় বাংলাদেশে শীর্ষ ২০ বিনিয়োগকারী দেশের মধ্যে চীনের অবস্থান সপ্তম। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চীনা এফডিআই স্টক এসেছে বিদ্যুৎ খাতে। তালিকায় পরের অবস্থানে থাকা অন্য খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বস্ত্র পোশাক, বাণিজ্য, নির্মাণ, চামড়া চামড়াজাত পণ্য এবং কেমিক্যাল-ফার্মাসিউটিক্যালস।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫