সময়ের ভাবনা

জলবায়ু সম্মেলনও কি দূর করতে পারছে ‘ক্লাইমেট অ্যাংজাইটি’?

প্রকাশ: নভেম্বর ২৭, ২০২১

এমএম খালেকুজ্জামান

দ্য শক ডকট্রিন: দ্য রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম (২০০৭) বইয়ে  কানাডীয় তাত্ত্বিক নওমি ক্লেইন রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, নিওলিবারেল  মার্কেট ইকোনমির কাছে যেকোনো সংকটও অমিত সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়, হোক সে প্রাকৃতিক  কিংবা অর্থনৈতিক সামরিক বিপর্যয়। সেসব সংকট ব্যবহার করে তারা সম্পদ ক্ষমতার আরো বিস্তার ঘটায়। বছর বছর কপ সম্মেলনগুলোও তেমন রোডশো বললে দ্বিমত করার কী কিছু আছে?

ক্লাইমেট অ্যাংজাইটি আজকের প্রজন্মের তরুণদের নতুন দুশ্চিন্তার নাম। নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন, কলম্বো থেকে কায়রোসবুজ বাঁচানোর মিছিল প্রতিবাদে তাই তরুণদের এত বেশি উপস্থিতি। এক পরিহাস এবং এর মিল আছে তাপমাত্রা বৃদ্ধির খারাপ ট্র্যাজেডির সঙ্গে। এটি তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে, যারা তা সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে কম দায়ী কিংবা দায়ী নয়। দায়বদ্ধ থেকে দায় না মিটিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করাই যেন পৃথিবীর সহজ কাজ। কী প্যারিস কী গ্লাসগো সর্বত্র তারই মঞ্চায়ন।

দূরের বাদ্যি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় না। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় জলবায়ু সম্মেলনে যখন ধ্বংসের বয়ান চলছে, আলোচনা হচ্ছে ঘোর বিপদের কথা, এমনই পরিবেশের জলবায়ু সমাবেশে দিব্যি ঘুমিয়ে নিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত দুর্যোগকে স্রেফ গুজব বলে উড়িয়ে দিতেন, বাইডেনের ঘুমিয়ে পড়ার ঘটনার পর টুইটে লেখেন, সত্যিই যদি এর গুরুত্ব থাকত তাহলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়তেন না। আসলে গরিব বিশ্বের দুর্যোগ ধনী বিশ্বের ন্যূনতম মাথাব্যথারও কারণ নয়; ঘুমিয়েই আছেন ধনী বিশ্বের বাইডেনরা।

ইউএনএফসিসিসি বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে মানুষের বাছবিচারহীন উন্নয়নকর্মের ফল বলে মনে করে। উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত করে জলবায়ু পরিবর্তন। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের এক নির্দোষ শিকার। আর জলবায়ু পরিবর্তন শুধু প্রাকৃতিক কারণে নয়, বরং মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই হয়ে থাকে। কিন্তু পরিবর্তনের জন্য নীতি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে মানুষকেই।

এফএও, ডব্লিউএফপি, আইএফএডি, ইউনিসেফ ডব্লিউএইচওসবই  জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, যাদের যৌথ উদ্যোগে করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে ২০১৯ সালের তুলনায় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১১ কোটি ৮০ লাখ; বৃদ্ধির হার প্রায় ১৮ শতাংশ। মনে হতে পারে, করোনা মহামারীই এর কারণ। কিন্তু সমস্যার আরো কারণের মধ্যে যুদ্ধ-সংঘাত, জলবায়ুগত পরিবর্তন প্রাকৃতিক দুর্যোগও দায়ী, প্রতিবেদনের টেক্সট তা- বলে।

কার্বন নিঃসরণ প্রশ্নে ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল এবং লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল, নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে ছোট দেশ আর বড় দেশগুলো বরাবরই বিপরীতমুখী অবস্থানে। প্রতিশ্রুতি দেয়া দেশের সংখ্যা বাড়ছে ধীরে ধীরে এবং প্রতিশ্রুতি পূরণে সব দেশ সমান আন্তরিক নয়। প্যারিস চুক্তিতে শিল্পায়নজনিত বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকাতে উষ্ণায়ন বৃদ্ধির মাত্রা দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা ডেটলাইন দেয়া সময়ের মধ্যে অর্জিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা সে অর্থে নেই। জলবায়ু ইস্যুতে গত কয়েকটি কপ সম্মেলনে বিশ্বনেতারা একের পর এক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন এবং একের পর এক তা তারা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

তবে বাংলাদেশ পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি কাঠামো তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবে জলবায়ুসহিষ্ণু উন্নয়নের জন্য প্রতিবেশগত পদ্ধতি বা প্রকৃতিভিত্তিক স্থায়ী সমাধানের পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। জলবায়ু, প্রকৃতি উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক পুনরুদ্ধার যাত্রার শুরুর বিন্দুতে আছে।

প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার বৈশ্বিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সম্মতি দিয়ে কার্বন নিঃসরণ ১৫ শতাংশ কমানোর অঙ্গীকার করেছিল, শতাংশ স্থানীয় অর্থায়নে এবং ১০ শতাংশ বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তিসাপেক্ষ। কার্বন নিঃসরণ কমতে নিজেদের দেয়া কথা রাখতে পরিবেশ, বন জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় একটি পরিকল্পনাপত্র জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সংস্থার (ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভোশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা ইউএনএফসিসিসি) কাছে পেশ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এখন বছরে ১০০ কোটি ডলার বা সাড়ে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নিরুৎসাহিত করা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো, উপকূলীয় এলাকাসহ সারা দেশে বৃক্ষরোপণ, ইটভাটার আধুনিকায়ন ইত্যাদি উদ্যোগের কথাও তুলে ধরা হয়।

কার্বন নিঃসরণ না কমাতে সব দেশই কোনো না কোনো অজুহাত দেয়। ব্রাজিলের দাবি উন্নয়নের প্রয়োজনে অ্যামাজনে অবকাঠামো নির্মাণ সম্পদ আহরণ করা দরকার। এটি না করলে যে ক্ষতি হবে, তা বাকি বিশ্বকে পুষিয়ে দিতে হবে। হাস্যকরভাবে যে ব্রাজিল সরকার অ্যামাজন বন উজাড় করা বন্ধের শর্ত হিসেবে বিশ্বের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছে, সেই ব্রাজিলও বন উজাড়করণ বন্ধের বিষয়ে সমঝোতায় স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের ১৯ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা বনভূমিগুলোর ওপর নির্ভরশীল সরাসরিভাবে। কিন্তু নানা কারণে অস্তিত্ব সংকটে বনাঞ্চল। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৬) বিশ্বে বন উজাড়করণ বন্ধের বিষয়ে এক সমঝোতা ঘোষণা করা হয়। ১১৪টি দেশের নেতা বন উজাড় রোধে চুক্তিতে সই করেছেন; সেই তালিকায় বাংলাদেশ ছিল না, পরে পরিবেশবাদীদের চাপে স্বাক্ষর করে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছেন, তা ছিল এবারের সম্মেলনেও। জলবায়ু নেতিবাচক পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের দেশের একজন হিসেবে তার উত্থাপিত চার দফা দাবি পৃথিবীর জলবায়ু নিপীড়িত সব মানুষের মনের কথা হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্রত্যাশা, প্রাপ্তি সম্ভাবনা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।

ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উন্নত দেশগুলোর কাছে উন্নয়নশীল অনুন্নত দেশগুলোর জন্য তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়ে ইতিবাচক আলোচনার জন্ম দেন। সম্মেলনেও ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের দাবি করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনায় অর্থ অপ্রতুল কিন্তু সেটাও নিশ্চিত নয়। তবে ধরনের সাহায্য না পেলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ভীষণ কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের এক নিবন্ধে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক লিওনার্ড লেখেন, আন্তর্জাতিক সংহতি, আইন বিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলোয় গুরুত্বারোপ করার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ, পাওয়ার পলিটিকস বৈশ্বিক খবরদারির বিষয়ে দেশগুলো যদি অধিক গুরুত্ব দিতেই থাকে, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ অস্পষ্ট হতেই থাকবে।

নক আউট পর্বের খেলায় যেমন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মীমাংসা না হলে অতিরিক্ত সময়ে খেলা গড়ায়, এবার কপ সম্মেলনেও সমঝোতায় পৌঁছতে না পারায় সময় বাড়িয়ে ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে বরং বাড়তি কার্বন যোগ হয়েছে হাই প্রোফাইল স্টেট ডেলিগেটদের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করতে। শেষ বিচারে সে তো পরিবেশেরই ক্ষতি। একটাই আশার কথা, চিরবৈরী চীন যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনহাউজ গ্যাস কমানো বনাঞ্চল রক্ষার ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে একমত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো তা পরিবর্তন না হলেই ভালো। বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা জিইয়ে রেখে এবারো শেষ হয়েছে জলবায়ু সম্মেলন, ক্লাইমেট অ্যাংজাইটি যে কারণে দূর হচ্ছে না।

 

এমএম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫