পোলট্রি মুরগির মাংস

ক্ষতিকর পাঁচ ধাতুর উচ্চমাত্রার উপস্থিতি বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

প্রকাশ: নভেম্বর ১৪, ২০২১

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

দেশে প্রোটিনের চাহিদা পূরণের বড় একটি উৎস পোলট্রি মুরগির মাংস। মূলত বাণিজ্যিকভাবে খামারে চাষ করা মুরগিই পোলট্রি মুরগি হিসেবে পরিচিত। এগুলো ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকায় সাধারণ মানুষের কাছেও বেশ জনপ্রিয়। আশঙ্কার কথা হলো দেশে এসব মুরগির মাংসে পাঁচটি ভারী ধাতুর উচ্চমাত্রার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পানি, দূষিত পরিবেশ নিম্নমানের পোলট্রি ফিডের কারণে মুরগির শরীরে এসব ধাতু প্রবেশ করছে, যা খাওয়ার ফলে তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

প্রবাবিলিটিস হেলথ রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট অব টক্সিক মেটালস ইন চিকেনস ফ্রম দ্য লারজেস্ট প্রডাকশন এরিয়া অব ঢাকা, বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণাটি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন গবেষক। এতে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।

গবেষণায় মুরগির মাংসের নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি এগুলোর পানীয় জল খাবার পরীক্ষা করা হয়। মাংস, পানি মুরগিকে দেয়া খাদ্যে লৌহ, তামা, দস্তা, আর্সেনিক, নিকেল, ক্রোমিয়াম, স্ট্রোনিসিয়াম, পারদ সিসার উপস্থিতি আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। সেখানে দেখা যায় মাটি, পানি, খাবার অন্যান্য উৎস থেকে মুরগির শরীরে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে।

গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, মুরগির মাংসে আর্সেনিক, নিকেল, ক্রোমিয়াম, পারদ সিসার মতো ভারী ধাতু ক্ষতিকর মাত্রায় উপস্থিত। মানবদেহে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১০৪ গুণ আর্সেনিক, দশমিক ৫৮ গুণ নিকেল, গুণ ক্রোমিয়াম, দশমিক গুণ পারদ দশমিক গুণ সিসা পাওয়া যায়। বিষয়টি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খুবই উদ্বেগের বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।

যেসব খামার থেকে মুরগির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলোর পোলট্রি ফিডের নমুনায়ও ক্ষতিকর মাত্রায় আর্সেনিক, নিকেল, পারদ সিসা পাওয়া গেছে। একইভাবে মুরগির পানীয় জলেও দূষণ পেয়েছে গবেষক দল। পানিতে অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকও পাওয়া যায়।

এসব ধাতুর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি মানবদেহে ক্যান্সার অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। গবেষকরা বলেন, এসব ক্ষতিকর ধাতু খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করলে মানবদেহে তাত্ক্ষণিক কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় না। তবে দীর্ঘদিন ধরে এগুলো শরীরে প্রবেশ করলে ২৫ শতাংশ ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি হয়। এছাড়া অন্যান্য রোগের ঝুঁকি থাকে ৪২ শতাংশ।

গবেষকরা বলছেন, বাজারে বিক্রির ৭২ ঘণ্টা আগে কোনো মুরগির শরীরে হরমোন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হলে তা খাওয়া মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এর পরও কোনো কোনো খামারি অতি মুনাফার লোভে পোলট্রি মুরগির ওজন বাড়াতে হরমোন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেন। তাছাড়া বিক্রির সময় মুরগিগুলোকে যেন সতেজ দেখায় সেজন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধও প্রয়োগ করা হয়।

ভারী এসব ধাতুর অসহনীয় মাত্রার ফলে মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হতে পারে বলে জানিয়েছেন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, একেক ধরনের ধাতু একেক ধরনের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। এগুলো মানবদেহে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। ফলে শরীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয় না। যদি একটা লম্বা সময় ধরে এসব ধাতু শরীরে প্রবেশ করতে থাকে, তাহলে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি হয়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুরগির মাংস দেশের প্রোটিনের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করে। এতে ভারী ধাতুর পরিমাণ বেশি পাওয়া গেলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। শুধু পোলট্রি নয়, ডেইরি, মাছ বা যেকোনো খাদ্য শতভাগ নিরাপদ হতে হবে। এসব ধাতু কিডনিকে চরমভাবে ক্ষতি করে। মুরগির শরীরে প্রবেশ করানো কিছু অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে। আবার পোলট্রি খাবারে পশুর হাড়ের গুঁড়ো দেয়া হয়। যেখানে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মিশ্রিত থাকে। এসব রাসায়নিকও মাংসের মাধ্যমে মানবদেহে যাচ্ছে। অনেক রাসায়নিক রয়েছে যা মানুষের পরিপাকতন্ত্র হজম করতে পারে না, ফলে সেসব কিডনিতে জমা হয়। কারণে একসময় কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কর্মক্ষমতা হারায়। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ না করলে কেবল ক্যান্সার নয়, গ্যাস্ট্রিকের মতো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও সৃষ্টি হয়।

শতভাগ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, যেকোনো খাবার বিশেষ করে যা দৈনন্দিন খাওয়া হয় তা শতভাগ নিরাপদ হতে হবে। এর জন্য জনসচেতনতা, নিরাপদ খাদ্য আইন প্রয়োগ খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মানসম্মত পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে। প্রথমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এরপর যথাযথভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। পরিকল্পনা করে এগিয়ে গেলে -১০ বছরের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।

চলতি বছরের মাঝামাঝি এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে। এতে ঢাকার সাভারের ১২টি বাণিজ্যিক খামার থেকে ৩৬টি মুরগি নমুনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

নমুনার মাধ্যমে সর্বজনীন ফল পাওয়া সম্ভব কিনা জানতে চাইলে গবেষণা দলের সদস্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক . শফি মোহাম্মদ তারেক বলেন, যে-সংখ্যক নমুনা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে তা যথেষ্ট। নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি আমরা খামারিদের সঙ্গেও কথা বলেছি।

গবেষক আরো বলেন, মূলত অপেক্ষাকৃত কম দামের খাবার খাওয়ানোর ফলেই এসব ধাতু মুরগির শরীরে ঢুকছে। ফিডগুলো তৈরি, মোড়কজাত বাজারজাত করার সময় শতভাগ সতর্কতা অবলম্বন করা হয় না। ফলে এগুলোয় ধাতুর উপস্থিতি রয়ে যায়, যা দিনশেষে মুরগির শরীরে প্রবেশ করে।

ফুড চেইন থেকেই পোলট্রি মুরগির শরীরে এসব ধাতু প্রবেশ করছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক . শারমিন রুমি আলীম। তিনি বলেন, যেসব খাবার মুরগিকে খাওয়ানো হয় তাতে নানা ধরনের ধাতু মিশে থাকে। আবার আমরা নিজেরা পানি পানের সময় আর্সেনিকের বিষয়ে সতর্ক থাকি। কিন্তু খামারের মুরগি কোন পানি পান করছে সেদিকে নজর দেয়া হয় না। ফলে পানিতে থাকা আর্সেনিক মুরগির শরীরে প্রবেশ করে। নিজেদের স্বাস্থ্যের স্বার্থেই এসব বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫