গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মের কৃষিজমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল নয়

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক

কৃষিজমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্পের অর্থনৈতিক কোনো সম্ভাবনা প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু গাইবান্ধার পলাশবাড়ী সদর থানার মাঝামাঝি অবস্থিত সাকোয়ায় অর্থনৈতিক অঞ্চলের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তাই গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মের কৃষিজমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্প সরিয়ে সাকোয়ায় করা যেতে পারে। গতকাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) এবং বণিক বার্তার উদ্যোগে আয়োজিত গোবিন্দগঞ্জ বাগদা ফার্মের সাঁওতালসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র নাগরিকদের করণীয় শীর্ষক অনলাইন বৈঠকে বক্তারা দাবি জানান। 

বক্তারা বলেন, সরকার শতাধিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। উন্নয়নের জন্য সরকার ধরনের পদক্ষেপ নিতেই পারে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাবরই প্রাণ, প্রকৃতি জীবনে এক দুঃসহ যন্ত্রণা তৈরি করেছে। তাহলে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসনের চিনিকলের জন্য রিকুইজিশন করা জমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব কেন দিতে হবে। প্রধানত সাঁওতাল আদিবাসী অন্যান্য দরিদ্র শ্রেণীর মানুষকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অন্যায় সিদ্ধান্ত।

অনলাইন বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মানবাধিকার কর্মী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। আলোচক  ছিলেন নিজেরা করির সমন্বয়ক এবং এএলআরডির চেয়ারপারসন খুশী কবির, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি কমরেড পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত গাইবান্ধা জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। বৈঠকে সূচনা বক্তব্য রাখেন বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।

সভাপতির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, দুঃখের কথা হলো, যখনই আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি হোক সেটা নারী, হিন্দু সম্প্রদায় কিংবা আদিবাসী অধিকারপ্রত্যেকবার একই কথা বলতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার পর যেভাবে এগোনোর কথা ছিল, আমরা সেভাবে এগোতে পারিনি। এতদিন নানা বিষয় নিয়ে আমরা মৃদুভাষায় কথা বলেছি, এখন আমাদের চিত্কার করা ছাড়া উপায় নেই।

তিনি বলেন, আজকের আলোচনায় মোটা দাগে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো, সাঁওতালদের কৃষিজমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, জমিটি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। মামলা চলমান রয়েছে এমন জমিতে অন্য কোনো পরিকল্পনা নেয়া কতটা আইনসম্মত, তা ভেবে দেখতে হবে। এখানে আদালত অবমাননা হচ্ছে কতটুকু তাও খতিয়ে দেখা দরকার। 

এর আগে সূচনা বক্তব্যে বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মের কৃষিজমিতে ইপিজেডের কোনো সম্ভাবনা আছে বিষয়ে এখনো সরকারি কোনো নথিপত্র আমাদের চোখে পড়েনি। যদিও জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চলের পক্ষে একটি প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু গোবিন্দগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাবনার ব্যাপারে ঐতিহাসিক প্রমাণ পর্যন্ত নেই। তাই বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে, এখানে আসলেই অর্থনৈতিক অঞ্চল করাটা কতটা যৌক্তিক।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, কৃষিজমিতে ইপিজেড স্থাপনের প্রকল্প বাতিলের পাশাপাশি আমাদের দাবি হলো জমিটি নিয়ে চলমান মামলাগুলোর নিষ্পত্তি সাপেক্ষে রিকুইজিশন পূর্ববর্তী জমির মালিক সাঁওতালদের উত্তরাধিকারী পরিবারগুলোকে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হোক। 

নারী নেত্রী খুশী কবির বলেন, সংবিধানের আলোকে সব শক্তির উৎস জনগণ। রাষ্ট্র যা- করে তা জনগণের সুবিধার জন্যই করে। মুষ্টিমেয় কারো সুবিধার জন্য করে না। কিন্তু কৃষিজমির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। একদল ব্যবসায়ী রাষ্ট্র, সংবিধান, জনগণ, আইন সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখানে ইপিজেড করছে। আমি প্রশ্ন করতে চাই, নাগরিকের ন্যূনতম অধিকার তথা বাঁচার অধিকার যদি দিতে না পারি, তাহলে আমরা কীসের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি? মানুষের যদি জীবন-জীবিকারই নিরাপত্তা না থাকে, তাহলে অর্থনৈতিক জোন দিয়ে কী হবে? এসব কার জন্য হবে?

পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা আসলে বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলছি। আমাদের দাবি তুলতে হবে, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও আমাদের কথা শুনতে হবে। আমাদের মূল বক্তব্য এখন একটাই। নয়তো দেখা যায়, একটি বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলার পর হয়তো সেটার সমাধান হয়েছে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে আরো জটিল সমস্যা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কয়টা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারব আমরা? সমস্যা তো দিনকে দিন বেড়েই চলছে। তাই আমাদের একটাই দাবিরাষ্ট্রকে আমাদের কথা মূল্যায়ন করে এগোতে হবে। নয়তো এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলে খুব একটা লাভ আছে বলে মনে হয় না।

কমরেড পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, মিলটি স্থাপনের সময় যে চুক্তি হয়েছে, ইক্ষুজমি চাষ না হলে এবং অন্য ফসল চাষ হলে করপোরেশনের জমি সরকারের কাছে ফেরত যাবে এবং সরকার প্রকৃত মালিকদের জমি ফেরত দিতে পারবে। আমি চুক্তির বাস্তবায়ন দেখার দাবি জানাচ্ছি।

অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, আদিবাসীদের ওপর যারা নির্যাতন করেছে, হত্যা করেছে, অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছেপিবিআই সিআইডির চার্জশিটে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে দেখানো হয়েছে। কতটা ভয়াবহ ব্যাপার, আসামিরা সাক্ষী হয়ে গেছে, আরা আমরা বিচার পাচ্ছি না হলো অবস্থা।

আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং বলেন, আমাদের রাষ্ট্র এগিয়েছে। কিন্তু আদিবাসীদের জীবনে হাহাকার ছাড়া তো আর কিছুই দেখছি না। তাদের হত্যা করে ফেলা হচ্ছে কিন্তু বিচার হচ্ছে না। তাহলে এটা কেমন উন্নয়ন? সংখ্যালঘুদের জীবন ধারণই তো কঠিন হয়ে পড়ছে, রাষ্ট্র এদের নিয়ে কবে আন্তরিক হবে!


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫