বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ

সচেতনতা বৃদ্ধি ও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা হোক

প্রকাশ: আগস্ট ০৪, ২০২১

মায়ের বুকের দুধ নবজাতকের আদর্শ খাদ্য। এর উপকারিতা বিপুল। শৈশবকালীন অনেক সাধারণ রোগের প্রাকৃতিক প্রতিষেধক এটি। মাতৃদুগ্ধ পানে শিশু যেমন সুস্থ-সবলভাবে বেড়ে ওঠে, তেমনি উপকৃত হন প্রসূতি নিজেও। কিন্তু নানা কারণে বিশ্বের অনেক শিশু মাতৃদুগ্ধ পানের সুযোগ লাভে ব্যর্থ হয়। প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর পালিত হচ্ছে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। অন্য দেশের মতো বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১০ সাল থেকে এটি জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। অতীতের ধারাবাহিকতায় এখন চলছে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা অন্য সহযোগী সংস্থাগুলোর উদ্যোগে উদযাপিত হচ্ছে এটি। মাতৃদুগ্ধ অধিকতর সচেতনতা বাড়াতে আলোচ্য সপ্তাহ সহায়ক হবে বৈকি।

একসময় বিশ্বব্যাপী মাতৃদুগ্ধ ছিল শিশুর অপরিহার্য প্রাকৃতিক খাদ্য। ফর্মুলা দুধের আবির্ভাবের আগে সব মা- অন্তত দুই বছর পর্যন্ত নিজের বুকের দুধ খাওয়াত শিশুকে। কিন্তু ফর্মুলা দুধ বা খাদ্য উদ্ভাবন বিপণনের পর অনেকেই বড় বড় শিশুখাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানির অপপ্রচারে প্রভাবিত হয় এবং মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে অনেক শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে শুরু করে। এটি শুধু বৈশ্বিক নয়, বাংলাদেশেরও চিত্র। তদুপরি দেশের আর্থসামাজিক পটভূমিতে নানা বদল ঘটেছে। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে বিপুলসংখ্যক নারী। অর্থকরী পেশায় যুক্ত হয়েছে অনেকে। কর্মজীবী বা শ্রমজীবী এসব নারীর পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে শিশুকে অবিচ্ছিন্নভাবে ছয় মাস দুধ পান করানো সম্ভব নয়। অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও প্রতিকূল পরিবেশে শিশুকে যথাযথভাবে মাতৃদুগ্ধ পান করানো যায়ও না। বলা চলে, নানা কারণে দেশে অনেক শিশুই মায়ের বুকের দুধ খাওয়া এবং এর বিপুল সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কাজেই শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে সবখানে মাতৃদুগ্ধ দানে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা জরুরি।

দেশে শিশু বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান তিনটি সমস্যা হলো খর্বত্ব, কৃশকায়ত্ব এবং ওজনস্বল্পতা। এগুলো পুষ্টিহীনতারই মূর্ত প্রকাশ। এর সঙ্গে মাতৃদুগ্ধ পানে ঘাটতির সংযোগ রয়েছে। বলা হচ্ছে, মায়ের বুকের দুধ প্রথম জীবনে শিশুর বেড়ে ওঠার সব ধরনের শক্তি পুষ্টি জোগাতে সহায়ক। এককভাবে ছয় মাস মাতৃদুগ্ধ পানের সঙ্গে পরবর্তী সম্পূরক খাবার যে এসব সমস্যা মোকাবেলায় কার্যকর, তা এরই মধ্যে নানা গবেষণায় প্রমাণিত। শিশুদের সঠিকভাবে মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চিত করলে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর ব্যাপকতা অনেকখানি কমে আসবে বৈকি। তথ্য বলছে, বাংলাদেশে এককভাবে মায়ের দুধ পানের হার (ইবিএফ) ৫৫ শতাংশ। স্তন্যদানে সঠিক উপায় এবং অবিচ্ছিন্নভাবে নির্ধারিত সময়ব্যাপ্তি অনুসরণ না করায় অনেক শিশুই মায়ের দুধের সর্বোচ্চ সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং দুধ পানের লক্ষণীয় মাত্রায় উন্নীত করা এবং সঠিক কায়দায় মাতৃদুগ্ধ পান নিশ্চিতে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বেড়েছে। ফর্মুলার চেয়ে মায়ের দুধ কতটা ভালো, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে। এসব প্রচেষ্টার ফলে অনেক দেশে মাতৃদুগ্ধ পানের হার (ইবিএফ) বেড়েছে। ইবিএফ হারে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্রোয়েশিয়া ৯৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, রুয়ান্ডা ৮৬ দশমিক ৯৩, চিলি ৮৬ দশমিক ৫০, বুরুন্ডি ৮২ দশমিক ৩৫ এবং শ্রীলংকা ৮২ শতাংশ। দেশগুলো ঘর থেকে কর্মক্ষেত্র সব ক্ষেত্রে শিশু মায়ের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ ব্রেস্টফিডিং কর্নার স্থাপনসহ শিশুকে মায়ের কাছাকাছি রাখার সুব্যবস্থা করেছে। উল্লিখিত দেশগুলোর নীতি অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে আমাদেরও জুতসই পদক্ষেপ নেয়া চাই।

দেশে চলমান মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহে করোনাকালে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। লক্ষ্যে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য আইনের বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ প্রয়োগ করা; শিশুর খাবার পুষ্টিবিষয়ক কার্যক্রমের পরিধি অর্থের বরাদ্দ বৃদ্ধি করা; মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য কোম্পানিগুলোর ডিজিটাল বাজারজাত কৌশল চিহ্নিত নিয়ন্ত্রণ করা; ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে মাতৃদুগ্ধদানে সহায়ক পরিবেশ মাতৃত্ব সুরক্ষা (ছুটি, বেতন ভাতা, স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভবতী প্রসূতি মায়েদের ভাতা প্রদান) নিশ্চিত করা; মাতৃদুগ্ধদানের সুরক্ষা, প্রচার সমর্থনে সমাজের বিভিন্ন স্তরের সমন্বয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ; স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর কাউন্সেলিং মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশুখাদ্য আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে মাতৃদুগ্ধ বিকল্প শিশুখাদ্য আইনের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে, তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এগুলোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে ব্রেস্টফিডিং কর্নার স্থাপন করতে হবে। শিশুর পরিচর্যায় চাকরিতে কর্মরত নারীদের কাছাকাছি পর্যাপ্ত ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যেমন এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়ও এসব উদ্যোগ বাড়াতে হবে। গ্রামে অনেক সময় কোনো মা অসুস্থ হয়ে শিশুকে দুধ পান করাতে না পারলে সমসাময়িক সময়ে মা হওয়া কেউ ওই শিশুকে দুধ খাওয়ানোর চল রয়েছে। এটিকে সনাতনী দুধ মা ব্যবস্থা বলা হয়। শহরে সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে ইউরোপের ব্যবস্থা দৃষ্টান্তযোগ্য। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণের জন্য অনেক ব্যাংক গড়ে উঠেছে। পর্যাপ্ত দুধ উৎপাদন হওয়া একজন মা সেসব ব্যাংকে মাতৃদুগ্ধ জমা দিতে পারেন কিংবা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করতে পারেন। ফলে দুগ্ধদানে অসমর্থ কোনো মা সেখান থেকে দুধ সংগ্রহ করে নিজের শিশুকে পান করাতে পারে। এতে ফর্মুলা দুধের প্রতি নির্ভরশীলতা কমে আসে এবং শিশুর বিকাশ নির্বিঘ্ন হয়। তাই ব্যবস্থাটি দীর্ঘমেয়াদে দেশে গড়ে তোলা যেতে পারে।      

মাতৃদুগ্ধ নবজাতক শিশুর বেঁচে থাকা, পুষ্টি, শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য মাতৃস্বাস্থ্যের প্রাণকাঠি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শিশুকে মায়ের দুধ না খাওয়ালে নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যু, ডায়রিয়ায় মৃত্যু, শিশুদের অপুষ্টি অন্যান্য কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পায়। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, শুধুই মাতৃদুগ্ধ পান করালে বছরে আট লাখের বেশি শিশুর জীবন রক্ষা পায়। যে শিশুদের বেশির ভাগেরই বয়স ছয় মাসের কম। শুধু শিশুর উপকারিতা নয়, মাতৃদুগ্ধ পান করালে মায়েদের স্তনে ক্যান্সার, ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার, টাইপ- ডায়াবেটিস হূদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়। সন্দেহ নেই, শিশুদের মাতৃদুগ্ধ দানে সচেতনতা আগের চেয়ে বেড়েছে। শিশুখাদ্য কোম্পানির অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। এখন দরকার শিশু প্রসূতিবান্ধব পরিবেশ। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্টরা আরো সক্রিয় হবে, এটিই প্রত্যাশা।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫