কঠোর লকডাউনেও সচল রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা

শ্রমিকদের টিকা, স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন ও নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা হোক

প্রকাশ: আগস্ট ০১, ২০২১

লেখিকা অরুন্ধতি রায় তার দ্য প্যানডেমিক ইজ পোর্টাল শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন, লকডাউন অনেকটাই রাসায়নিক পরীক্ষার মতো আড়ালে থাকা সমাজের নিষ্ঠুরতা আর সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলো স্পষ্ট করেছে। শহরের সচ্ছল মানুষ যখন রীতিমতো লকডাউন উদযাপন করছে, শ্রমিকরা তখন পরিবার-পরিজন নিয়ে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে গ্রামে ফিরেছেন। ভারতের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আমাদের দেশেও। গত বছরের এপ্রিলের মতো এবারো আমরা দেখলাম চলমান লকডাউনের মধ্যে যানবাহনের ব্যবস্থা না করে বা -বিষয়ক কোনো নির্দেশনা না দিয়ে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা খোলার ঘোষণা দেয়া হলো। কারখানা সচল রাখা নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য স্বস্তিকর। তবে কভিড-১৯ পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনাও জরুরি। তাই সংক্রমণ রুখতে শ্রমিকদের টিকাদান, স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন কারখানায় আসা-যাওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে গিয়ে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। যা জনস্বাস্থ্য অর্থনীতির জন্য স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে।

রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল দুটি চালকের একটি। মহামারীর কারণে খাতটি গত বছর বেশ অনিশ্চয়তা ব্যবসায়িক মন্দার ভেতর দিয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে কারখানা খোলার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত প্রণোদনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। চলমান বিধিনিষেধ শুরু হওয়ার আগে অনেক কারখানাই ক্রয়াদেশ অনুসারে পণ্য রফতানি করতে সক্ষম হয়। ফলে জুনের তুলনায় জুলাইয়ে রফতানি পণ্য পরিবহনে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি ৫৯ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। তাছাড়া মিয়ানমারের চলমান অসহিষ্ণু পরিস্থিতির কারণে সেখানের অনেক রফতানি আদেশই আসছে বাংলাদেশে। এমন অবস্থায় আমরা যদি শ্রমিকদের টিকার আওতায় এনে স্বাভাবিকভাবে শিল্পের কাজ চালিয়ে যেতে পারি, তবে তা হবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে কারখানা-সংশ্লিষ্টদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

যদিও কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) পক্ষ থেকে চলমান লকডাউনে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা চালু রাখতে কী ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে তা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়নি। গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় তারা যে নির্দেশনা দিয়েছিল, তা মানতে বলা হয়েছে। যদিও ওই নির্দেশনায় শ্রমিকদের টিকা প্রদানসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় উল্লেখ নেই। এক্ষেত্রে তাদের সক্রিয়তা কাম্য। তাছাড়া গত বছর মালিকরা শ্রমিকদের যাতায়াতের যে ব্যবস্থা করেছেন, সেখানে সম্পূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি বলেই খবর মিলেছে। ক্রেতাদের চাপে কমপ্লায়েন্স কারখানাগুলোয় স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও নন-কমপ্লায়েন্স কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি না মানার কথাও উঠেছে। প্রায় দুই হাজার কারখানা আছে, যেগুলো বিজিএমইএ বিকেএমইএর সদস্য নয়। ফলে তাদের নজরদারির সুযোগ কম। এছাড়া ওয়াশিং, প্রিন্টিং কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তাই বিদ্যমান পরিস্থিতি সামলাতে মালিকরা যথাযথ সহযোগিতা করছেন কিনা, তা নজরদারির আওতায় আনতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানায় ত্রুটি হলে সেসব কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আলাদা একটি ভ্রাম্যমাণ দলের অধীনে নিয়মিত বিরতিতে কারখানাগুলো পরিদর্শনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

আশার কথা, ঈদের আগে গাজীপুরের পোশাক শ্রমিকদের করোনার টিকার আওতায় আনার সরকারি সিদ্ধান্ত হলে কারখানাগুলো থেকে ২৫ লাখ শ্রমিকের তালিকা দেয়া হয়। ঈদের আগে তৈরি পোশাকের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক হাজার শ্রমিককে টিকার আওতায় আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। অথচ দেশের ছয়টি শিল্প অধ্যুষিত এলাকার সাড়ে সাত হাজারের বেশি কারখানায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে শুধু ৩০ লাখ শ্রমিক রয়েছেন ঢাকার আশেপাশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোয়। ঢাকার পাশাপাশি অন্যান্য শিল্প অধ্যুষিত এলাকার শ্রমিকদের যেমন টিকার আওতায় আনতে হবে, তেমনি পোশাকের পাশাপাশি পাট, চামড়াসহ অন্যান্য রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের তালিকা তৈরির মাধ্যমে দ্রুত টিকাদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গত এক বছরেরও বেশি সময়ে আমাদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা অনেক। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের সরকার আন্তরিক সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান পরিস্থিতি সামলাতে সচেষ্ট। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কারখানাগুলোয় কার্যক্রম চালানো জরুরি। শ্রমিকদের আনা-নেয়ার জন্য মালিকদের নিজস্ব পরিবহনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তারা অসুস্থ হলে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন সেন্টারের পাশাপাশি প্রয়োজনে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা যেতে পারে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে উৎপাদন কার্যক্রম ধারাবাহিক রাখা সম্ভব হবে।

প্রতিদিন মৃত্যু শনাক্তের রেকর্ড হচ্ছে। টানা দুই সপ্তাহ ধরে দিনে দুইশর ওপর মানুষ মারা যাচ্ছে কভিডে। ভাইরাসটির সংক্রমণ রুখতে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। গত বছর - এপ্রিলে রাস্তায় নিম্ন আয়ের মানুষের ঢল নেমেছিল, শত শত কিলোমিটার হেঁটে কারখানায় এসে তারা জানতে পারেন যে তা আবার বন্ধ হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরতে ফের হাঁটা শুরু করেছিলেন তারা। এবারো চাকরি বাঁচানোর জন্য শ্রমিকরা শত কষ্ট সহ্য করে কর্মস্থলে ফিরছেন। পরিবহন ফেরিতে গাদাগাদি করে আসছেন তারা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে কারখানা খোলার ঘোষণা দেয়ায় শ্রমিকদের বিপত্তিতে পড়তে হয়েছে, যা কাম্য নয়। ভারতীয় এক অর্থনীতিবিদ যেমন লিখেছেন, ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় কঠোর ছিল ভারত সরকারের লকডাউন। তবে কর্তৃপক্ষ দেশটির দরিদ্র অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য কোনো বিধিবিধানের ব্যবস্থা না রাখায় শত শত মাইল পথ হাঁটা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো উপায় ছিল না। আর ওই ভুল পদক্ষেপের কারণে ছয় মাস ধরে প্রতিদিন ভারতে কভিড-১৯- আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। ভারতের ভুল থেকে আমরা নিশ্চয়ই শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫