ফকির আলমগীর স্মরণে

‘তোমার চোখেতে দেখি স্বপ্ন-মিছিল’

প্রকাশ: জুলাই ২৫, ২০২১

রুহিনা ফেরদৌস

তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, মৃত্যুবরণ করলেন ২৩ জুলাই ২০২১ ঠিক ৭১ বছর বয়সে। আন্দোলন-সংগ্রাম-মুক্তি তার জন্ম মৃত্যুর সঙ্গেই যেন গাঁথা। কাঁধ ছড়ানো ঝাঁকড়া চুলে গান গাইতে গাইতে মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে ছুড়ে দিতেন ভীষণ প্রতিরোধে, গাইতেন গণমানুষের গান। সুরে, গানে প্রতিবাদ করে গেছেন। অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে জোর কণ্ঠ ছেড়েছেন। গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীরবঞ্চিত-অসহায় মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের অধিকারের কথা ছড়িয়ে দিয়েছেন।

করোনা একে একে কেড়ে নিয়েছে অনেককে। মহামারী তার আরো একটি আঁচড় বসিয়ে দিল দেশের সংগীতাঙ্গনে। গত শুক্রবার রাত ১০টা ৫৬ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গণমানুষের গায়ক। 

প্রতি বছর মে দিবস এলে ফকির আলমগীরের গাওয়া জন হেনরি গানটি যেন নতুন করে বাংলার নিপীড়িত মানুষের সংগীত হয়ে ওঠে। চে গুয়েভারার ছবি আঁকা কালো টি-শার্ট গায়ে ফকির আলমগীর গেয়ে চলেছেন, প্রতি মে দিবসে গানে গানে/ নীল আকাশের তলে দূর/ শ্রমিকের জনগণ কান পেতে শোনো ওই/ হেনরির হাতুড়ির সুর। হেমাঙ্গ বিশ্বাস অনূদিত সুরকৃত জন হেনরি বা নাম তাঁর ছিল জন হেনরি শিরোনামের আধুনিক বাংলা গণসংগীতটি সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ফকির আলমগীরের ভূমিকার কথা বলতেই হয়। একটু বলে রাখছি, আমেরিকান লোকগাথার কিংবদন্তি জন হেনরিকে নিয়ে গল্পগাথার জন্ম হয়েছিলে আফ্রিকান-আমেরিকান দিনমজুরদের মধ্যে। হাতুড়ি দিয়ে পাথর কাটা ছিল তার কাজ। লোকগাথায় বলা হয়, জন হেনরি যন্ত্রের সঙ্গে হাতুড়ি হাতে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন, যন্ত্রকে হারিয়ে জয়ীও হয়েছিলেন। জয়ী হতে গিয়ে নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে হয় হেনরিকে। এর পর থেকে কিংবদন্তিতে পরিণত হলেন তিনি। তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে গান, প্রামাণ্যচিত্র, এমনকি কার্টুন ছবিও। তবে ফকির আলমগীরের কণ্ঠে জন হেনরি ছড়িয়ে পড়ে বাংলার গ্রামে, নগরে। 

দ্রোহী আর সংগ্রামী মানুষদের সঙ্গে এক অদৃশ্য বন্ধন খুঁজেছেন শিল্পী। তার গাওয়া কালো কালো মানুষের দেশে, কালো মাটিতে/ রক্তের স্রোতের শামিল/ নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি অমর কবিতার অন্ত্যমিল তোমার চোখেতে দেখি স্বপ্ন-মিছিল/ অগুনতি মানুষের হূদয়ের মিল গানটি কে না শুনেছে। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলেনের পুরোধা নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিনকে উপলক্ষ করে গান গেয়েছিলেন তিনি। গানটি লিখেছেন সেজান মাহমুদ। ফকির আলমগীর গানটি গেয়েছেন ১৯৮৯ সালে। ১৯৯৭ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি ঢাকায় এলে ফকির আলমগীর তার সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণ পান। সময় তাকে কালো কালো মানুষের দেশে গানটি শুনিয়েছিলেন তিনি।

ফকির আলমগীরের গাওয়া কিছু গান চিরস্মরণীয় হয়ে আছে, থাকবে। তবে সবচেয়ে মুখে মুখে ফেরা গানটি বোধ হয় সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে গানটি লিখেছেন আলতাফ আলী। সুর দিয়েছেন গায়ক নিজেই। ফকির আলমগীরের সখিনা কোনো একক সত্তা নন। সখিনা গ্রামবাংলার প্রতিনিধি। তাকে মা, সহোদরা, কন্যাকত রূপে চিত্রিত করা যায়। শ্রেণীসংগ্রাম, বৈষম্য, আকাল, হাহাকার আর বেদনার নাম যেন সখিনা। ১৯৮২ সালে বিটিভির ঈদ আনন্দমেলায় গানটি প্রচারের পর দর্শকের মাঝে রীতিমতো সাড়া পড়ে। সখিনাকে উপজীব্য করে ফকির আলমগীর নিজে পরবর্তী সময়ে লেখেন চল সখিনা দুবাই যাব, দ্যাশে বড় দুঃখরে প্রথম গানটির মতো গানটিতেও তিনি গ্রামবাংলার বঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কথাই বলে গেছেন; তার গাওয়া, মায়ের একধার দুধের দাম গানটি যেমন। নব্বইয়ের দশকের গান আজও সমানভাবে মানুষের অনুভূতিতে জায়গা করে নেয়।

গানে গানে যেমন সবাইকে উজ্জীবিত করেছেন এবং অধিকার আদায়ের পথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন, তেমনি দ্রোহদিনে সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছেন। ষাটের দশক থেকেই গণসংগীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সম্পৃক্ত হন বাম ধারার ছাত্র রাজনীতিতেও। ১৯৬৯ সালে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী গণশিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে গণঅভ্যুত্থানে যোগ দেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল সময়গুলোয় তিনিও তার কণ্ঠ আর সুর নিয়ে শামিল সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় ফকির আলমগীরকে।

দ্রোহী কণ্ঠ, স্বতন্ত্র গায়কি আর দরদমাখা সুরের শিল্পী ফকির আলমগীর চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলার মানুষের মনে, অন্তস্তলে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫