কাভিড পরবর্তী স্নায়ুরোগ জটিলতা ও করনীয়

প্রকাশ: জুলাই ১০, ২০২১

ডাঃ এ টি এম হাছিবুল হাসান

কোভিডের ভয়াল থাবায় পুরো পৃথিবী আজ বিপর্যস্ত। থমকে গিয়েছে জনজীবন, ব্যবসা বানিজ্য। একের পর এক নতুন স্ট্রেইন আর তার সংক্রমনে নতুন ঢেউয়ে বেসামাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। প্রতি নিয়তই বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা। যম আর চিকিৎসকের যুদ্ধের মধ্যে অনেকেই সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু গবেষনা বলছে, হাসপাতাল থেকে সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফেরা কিংবা মৃদু সংক্রমনের পর বাসায় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হবার পর অনেকেই নতুন করে স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছেন। এই হার কোভিড থেকে সুস্থ্য হয়ে ওঠা জনগোষ্ঠির প্রায় অর্ধেক। আর এই জটিলতায় ফুসফুস, হার্ট,স্নায়ু সহ অনেক অঙ্গ-প্রতঙ্গই আক্রান্ত হচ্ছে। বৃটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা বলেছে, কোভিড থেকে সুস্থ্য হয়ে ওঠা প্রতি দশ জনের একজন, ছয়মাসের মধ্যে মৃত্যুবরন করেছেন। মাঝারি থেকে তীব্র কোভিডে আক্রান্ত বয়স্ক ও মহিলাদের ক্ষেত্রে এ ঝুকি সবচেয়ে বেশি। কোভিড থেকে সুস্থ্য হওয়া প্রতি তিন জনে একজন স্নায়ু জটিলতায় ভুগছেন।

কেন হয় ?

যে কোন ভাইরাসজনিত রোগ থেকে সেরে ওঠার পরে এ ধরনের জটিলতা অস্বাভাবিক নয়। এর আগেও মহামারি রুপে দেখা যাওয়া MERS or SARS COV-1 ভাইরাস পরবর্তী সময়ে এ ধরনের রোগ দেখা গিয়েছে। এ জটিলতা তৈরীতে সরাসরীভাবে ভাইরাস দায়ী না হলেও ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অবতীর্ন আমাদের রক্ত কণিকার কর্মকান্ডের ফলাফল হিসেবেই এমনটা হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়।

পোস্ট কোভিড নিউরোলজিক সিনড্রোম

অতি সম্প্রতি গবেষকগন লক্ষ করেছেন যে, কোভিড থেকে সেরে উঠার পর কেউ কেউ অস্বাভাবিক দূর্বলতা, নিদ্রাহীনতা, হতাশা সহ নানা রকম মানসিক অস্থিরতায় ভুগছেন। এ ধরনের লক্ষনসমূহকে তারা পোষ্ট কোভিড নিউরোলজীক সিনড্রম হিসেবে নাম দিয়েছেন।

পোস্ট কোভিড ফ্যাটিগ

কোভিডের পর প্রায় ৫০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ দূর্বলতা শরীরে মাংস পেশীতে ব্যাথা (রোগীরা বলেন গা ম্যাজ ম্যাজ করে), অনিদ্রা, কাজে অনাগ্রহ, অবসাদ গ্রস্থতায় ভোগেন। এমন সমস্যা কখনো কখনো ছয় মাসে বা আরোও অধিক সময় স্থায়ী হয়।

স্ট্রোক

কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে পরবর্তী স্ট্রোকের ঝুকি বাড়ে। এর মধ্যে মস্তিস্কে রক্তক্ষরনের ঝুকি প্রায় ২.৫ গুন এবং রক্তনালী ব্লক হয়ে স্ট্রোকের ঝুকি প্রায় দ্বিগুন। হাসপাতালে কোভিড নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে এই ঝুকি সবচেয়ে বেশী। বিশেষ করে সেসব রোগীদের ক্ষেত্রে যাদের আই.সি.ইউ প্রয়োজন হয়েছিল।

পারকিনসনিজম

মস্তিস্কের দুরারোগ ব্যাধীগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীর, হাত- পা কাপে, চলাচলে ধীরগতি ও অসুবিধা তৈরী হয়। সাধারন মানুষের তুলনায় কোভিডের পর এ ধরনের জটিলতার ঝুকি প্রায় দেড়গুন।

ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম

কোভিড থেকে সুস্থ্য হওয়া বয়স্ক রোগীদের প্রতি তিন জনে একজন ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রমে আক্রান্ত হন। এ ধরনের রোগীদের পরিবারের লোকজন এসে বলেন যে, তাদের বাবা/মা/সঙ্গী কোভিডের সময় স্বাভাবিক থাকলেও ইদানিং অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছেন। ঠিকভাবে মানুষের নাম মনে রাখতে পারেন না বা নামাজ পড়তে গেলে সূরা ভুলে যাচ্ছেন। চশমা,ঘড়ি কোথায় রেখেছেন বলতে পারছেন না। অনেক বেশী আবেগ প্রবন হয়ে গিয়েছেন। তবে তার অনেক পুরনো, ছোটবেলার স্মৃতি ঠিকই মনে আছে।

অনিদ্রা

প্রায় তিরিশ শতাংশ রোগী বলেন, কোভিডের পর তাদের ঘুম কমে গেছে। কেউ কেউ সারা রাত জেগে থাকেন। ঘুম আসে না , আবার কারো কারো ঘুম আসলেও তা ভেঙ্গে যায়।

মনযোগে  সমস্যা

অনেকই এসে বলেন যে, ডক্টর আমি কোন কাজে মনযোগ দিতে পারছি না, অস্থির লাগে। প্রতি বারো জনে একজনের কোভিড পরবর্তী সময়ে এ ধরনের মনযোগের সমস্যায় ভুগতে পারেন।

মাথা ব্যাথা ও মাথা ঘুরানো

প্রায় ১৫% রোগীর ক্ষেত্রেই মাইগ্রেনের মতো সমস্যা হতে পারে। কারো কারো আবার মাথা ভার বা স্ট্রেস জনিত মাথা ব্যাথাও হয়। অনেকেই বলেন তাদের মাথা ঘোরায়। বিশেষত বসা থেকে দাড়াতে গেলে বা হাটতে চলতে গেলে এ সমস্যা হয়। তারা উদাহরন দিয়ে বলেন যে ভূমিকম্প হলে যেমন অনুভূত হয়, তেমনি লাগে।

স্বাদ ও ঘ্রাণহীনতা

কোভিডে আক্রান্তের অন্যতম লক্ষন হলো এই স্বাদ ও ঘ্রানহীনতা। এটা কোভিডের পর নতুন করে খুব বেশী মানুষের না হলেও, যাদেও কোভিডের শুরুতে এ ধরনের লক্ষ ছিল তাদের ৫-৬% রোগীর ক্ষেত্রে এ সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। কারো কারো তা ছয়মাস বা আরো বেশি সময় থাকতে পারে।

কি করনীয় ?

সত্যি বলতে গেলে এধরনের সমস্যাগুলোর কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে আশার কথা হলো এধরনের সমস্যা সব ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যদিও  এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে মন্তব্য করার জন্য বিভিন্ন গবেষনায় প্রাপ্ত ফলাফল পর্যাপ্ত নয়। তবে সাধারনভাবে বলা যায় যে কোন ভাইরাসের সংক্রমনের পরে এমন জটিলতা হওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।  এ নিয়ে ভয় পেলে বা আতংকিত হলে চলবে না। সাধারনভাবে বেশীর ভাগ সমস্যাই দুই বা তিন সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় না। নিম্নোক্ত কাজগুলো করলে এসব সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হতে পারে।

১.   প্রতিদিন সুষম খাদ্য গ্রহন।

২.   প্রচুর পরিমানে পানি ও তরল খাবার খেতে হবে

৩.   শাক-সবজি, ফলমূল খেতে হবে।

৪.   চা, কফি, ধুমপান পরিহার করতে হবে।

৫.   অতিরিক্ত মোবইল ফোনে আসক্তি কমাতে হবে।

৬.   প্রতিদিন সঠিক সময়ে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

৭.   প্রতিদিন সকালে কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাটা ও ব্যায়ামের চেষ্টা করতে হবে।

সর্বোপরি এ ধরনের লক্ষন দেখা দিলে নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। 

ডাঃ এ টি এম হাছিবুল হাসান
সহকারী অধ্যাপক, নিউরোলজী
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস এন্ড হাসপাতাল


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫