ব্রিটিশ সাহায্য বন্ধ, উদ্বেগে ব্র্যাক

প্রকাশ: জুন ১৬, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্র্যাকের সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তি (এসপিএ) থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে ব্রিটিশ সরকারের ফরেন কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) ফলে ব্রিটিশ সরকারের ২০ কোটি পাউন্ডের অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে ব্র্যাক। আকস্মিক চুক্তি বাতিলের ঘোষণা উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের। একই সঙ্গে ব্র্যাকের বাংলাদেশে চলমান বেশকিছু কর্মসূচি নিয়েও বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এফসিডিও ব্র্যাকের প্রধানতম উন্নয়ন সহযোগী অর্থায়নকারী সংস্থা। বর্তমানে এফসিডিওর অর্থায়নে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে গৃহীত সবচেয়ে বড় কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করছে ব্র্যাক। সংস্থাটির মোট বৈদেশিক অনুদানের গড়ে প্রায় ৪৫ শতাংশই আসে এফসিডিওর তহবিল থেকে। অনুদান কাজে লাগিয়ে দেশের বৃহত্তম অনানুষ্ঠানিক স্কুল কর্মসূচি পরিচালনা করছে ব্র্যাক। কর্মসূচিতে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে এক কোটিরও বেশিসংখ্যক শিশু।

এফসিডিওর ঘোষণায় ব্র্যাকের আরো কিছু কর্মসূচি নিয়ে এখন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে জরুরি নীতিনির্ধারণী সভায়ও বসেছে ব্র্যাক। সভায় বিকল্প অর্থায়ন করণীয় বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ব্র্যাকের কর্মকর্তারা বলছেন, এফসিডিওর চুক্তি বাতিলের ফলে যুক্তরাজ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের বড় একটি উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। তবে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে এফসিডিও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন না করলেও প্রকল্পভিত্তিক অর্থায়ন নতুনভাবে চালু করতে পারে। কারণে ব্র্যাকের জন্য সংস্থাটির অর্থায়নের পথ পুরোপুরি রুদ্ধ হয়ে পড়ছে না। তবে সে অর্থায়ন পাওয়া ব্র্যাকের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। কারণ বাংলাদেশ এরই মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নীত হলে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ওপর আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বিভিন্ন উৎসে পাওয়া তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ৪৫ কোটি পাউন্ডের কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন করেছে ব্র্যাক। অর্থায়নের মাধ্যম ছিল ব্রিটিশ সরকারের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি) সম্প্রতি বিভাগটিকে যুক্তরাজ্যের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের সঙ্গে একীভূত করে এফসিডিও গঠন করা হয়।

অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের জন্য অনুদানের পরিবর্তন অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও আকস্মিক নয়। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগেই দেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অনুদান নানাবিধ কারণে ক্রমান্বয়ে কমে এসেছিল। পৃথিবীতে যুদ্ধ সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক অনেক দাতা সংস্থা এখন সেদিকেই মনোযোগ দিচ্ছে। মহামারী সৃষ্ট পরিস্থিতি অনুদান হ্রাসের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। ধাক্কায় শুধু ব্র্যাক নয়, গোটা এনজিও খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাধাগ্রস্ত হবে দেশের কর্মসংস্থান আর্থসামাজিক উন্নয়ন।

তবে অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার তুলনায় ব্র্যাক প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য অনেকটাই প্রস্তুত জানিয়ে তিনি বলেন, ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, সোস্যাল এন্টারপ্রাইজ বাণিজ্যিক বিনিয়োগগুলোর বৃদ্ধি দরিদ্রদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করছে। তবে মহামারীর কারণে খাতগুলোও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন করে ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ায় মহামারীর প্রভাব দীর্ঘায়িত হচ্ছে হবে। একই সঙ্গে দারিদ্র্য সংকট বাড়ছে। পরিবর্তিত অর্থায়ন পরিস্থিতিতে আমাদের কার্যকরী ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেড়ে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে কর্মসূচি নতুন আঙ্গিকে সাজানোর দরকার হবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি অন্যান্য ক্ষেত্রে ফান্ড এনে কার্যক্রম পরিচালনার। তবে কাজটা কঠিন হবে। সরকারকে ভাবতে হবে কীভাবে তারাও উন্নত দেশের মতো সামাজিক খাতকে সহায়তা দিতে পারে।

দারিদ্র্য বিমোচনে এরই মধ্যে বড় ধরনের সফলতা দেখিয়েছে ব্র্যাক। আল্ট্রা পুওর কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের প্রায় ২০ লাখ পরিবারকে চরম দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে সংস্থাটি। দারিদ্র্য বিমোচনের সে মডেল এখন ইথিওপিয়া, ঘানা, ভারত, পাকিস্তান, হন্ডুরাস পেরুতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এফসিডিও চুক্তি থেকে সরে আসার অর্থ হচ্ছে ব্র্যাকের চলমান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, মানবিক সহায়তা সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিগুলোর ব্যাপ্তি নাটকীয়ভাবে কমে আসা। কোনো কোনোটি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এছাড়া অন্যান্য দেশেও ব্র্যাকের চলমান কর্মসূচির ব্যাপ্তি কমে আসতে পারে। কভিডের কারণে ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট কর্মসূচিগুলো ব্যাহত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন শিক্ষা কর্মসূচির ব্যাপ্তিও কমিয়ে আনা হচ্ছে। এখন স্কুল শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কর্মসূচিও বন্ধ বা ছোট করতে হতে পারে। সামনের দিনগুলোয় হয়তো নিয়ে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দুস্থ নাজুক জনগোষ্ঠীকে সহায়তার প্রয়াস থেকে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। প্রথমে সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে শাল্লা-দিরাইয়ের সহায়-সম্বলহীন ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে যাত্রা করে ব্র্যাক। শুরুতে ত্রাণ পুনর্বাসন কার্যক্রম দিয়ে যাত্রা  করলেও ১৯৭৪ সালে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করে সংস্থাটি। এরপর একে একে গ্রহণ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি কিংবা নারীর ক্ষমতায়ন লিঙ্গবৈষম্য রোধে বিভিন্ন কর্মসূচি। বিভিন্ন সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার আইনি সহায়তা, সোস্যাল এন্টারপ্রাইজ নারী কর্মসংস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে সেবা পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে ব্র্যাক। কার্যক্রমের দিক থেকে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বর্তমানে এশিয়া আফ্রিকার ১১টি দেশে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি মানুষের মাঝে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে সংস্থাটি। স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে। চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ব্র্যাকে আল্ট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন মডেল এখন অনুসৃত হচ্ছে বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫