কেমিকো ফার্মার বিরুদ্ধে প্লেসমেন্ট শেয়ারের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

প্রকাশ: জুন ১৬, ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক

মূলধন বাড়ানোর জন্য ২০১৯ সালে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েছিল ওষুধ খাতের কোম্পানি কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। এরপর বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর কাছে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে টাকাও নিয়েছে কোম্পানিটি। তবে সম্প্রতি কোম্পানিটির একজন বিনিয়োগকারী নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বিএসইসির কাছে অভিযোগ করেছেন, দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি কোনো শেয়ার পাননি। কোম্পানিটির নীতিনির্ধারক মধ্যস্থতাকারীদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ প্রতারণার অভিযোগ তুলে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছেন তিনি।

প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে নির্ধারিত পরিমাণ পরিশোধিত মূলধন থাকার বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে যেসব কোম্পানির নির্ধারিত পরিমাণ মূলধন থাকে না, তারা মূলধনের শর্ত পূরণের জন্য প্রাইভেট অফারের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার ইস্যু করে মূলধন সংগ্রহ করে। পদ্ধতিতে মূলধন সংগ্রহের বিষয়টি প্লেসমেন্ট শেয়ার নামে পরিচিত।

আইপিওতে আসার উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএসইসির কাছ থেকে মূলধন বাড়ানোর অনুমোদন পায় কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালস। সে সময় কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ছিল কোটি ৮০ লাখ টাকা। কোম্পানিটি নতুন করে ৪৮ কোটি ৮১ লাখ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর জন্য বিএসইসির কাছ থেকে অনুমোদন নেয়। এর মধ্যে ১৩ কোটি ৮১ লাখ হাজার টাকা বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে বাকি ৩৫ কোটি টাকা বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের বাইরে অন্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করার কথা ছিল।

বিএসইসির কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর কোম্পানিটি বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের শুরুর দিকে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার, তার ছেলে ওয়ালিদ ইবনে ইসলাম মেয়ে আনিকা ইসলামের কাছ থেকে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি বাবদ ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা নেয়া হয়। ছয় মাসের মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ নিয়েছিলেন কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান এমএ কালাম। কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত আইপিওর আবেদনই করতে পারেনি কোম্পানিটি। এমনকি নজরুল ইসলাম মজুমদার তার ছেলে-মেয়ের কাছ থেকে নেয়া অর্থের বিপরীতে কোম্পানিটি কোনো ধরনের শেয়ারও ইস্যু করেনি।

অবস্থায় কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের কাছ থেকে টাকা আদায়ে আইনি পথে হাঁটছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। এরই মধ্যে বিষয়টির নিষ্পত্তি চেয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের নীতিনির্ধারক মধ্যস্থতাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতারণা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় জিডি করেছেন।

বিষয়ে নজরুল ইসলাম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, প্লেসমেন্ট শেয়ার দেয়ার কথা বলে কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান এমএ কালাম আমার কাছ থেকে মোট ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেলেও কোম্পানিটি আজ পর্যন্ত আমাকে কোনো শেয়ার দেয়নি। এমনকি বারবার যোগাযোগ করলেও কোম্পানির নীতিনির্ধারকরা সাড়া দেননি। এজন্যই বাধ্য হয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যানের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ থানায় জিডি করেছি। আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার কথা বলে কোম্পানিটি আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

থানায় দায়ের করা জিডির বিষয়ে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। পাশাপাশি তারা দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি নিষ্পত্তির চেষ্টা করছেন। জানতে চাইলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিপ্লব কিশোর শীল বণিক বার্তাকে বলেন, নজরুল ইসলাম মজুমদারের সাধারণ ডায়েরিটি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। ঘটনাটি তদন্তে একজন পুলিশ পরিদর্শককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যস্থতায় কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালস নাসা গ্রুপের কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। সেখানে উভয় পক্ষ নিজ নিজ বক্তব্যের পক্ষে নথিপত্র জমা দিয়েছেন। আশা করছি, দ্রুতই বিরোধের নিষ্পত্তি হবে।

যদিও কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের দাবি তারা এরই মধ্যে সবাইকে শেয়ার ইস্যু করেছে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তারা আরো আগে আইপিওতে আসার প্রস্তুতি নিয়েছিল। প্রথম দফায় ২০২০ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের আইপিওতে আসার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু দেশব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তাদের সেই পরিকল্পনায় ব্যাঘাত ঘটে। এরপর ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সময়ের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইপিওতে আসার পরিকল্পনা নেয় কোম্পানিটি। তবে গত বছরের ১৯ নভেম্বর কোম্পানির তত্কালীন চেয়ারম্যান মারা যাওয়ার কারণে আইপিওর আবেদন আবারো বিলম্বিত হয়। চলতি বছরের ৩১ মার্চ সময়ের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইপিও আবেদন জমা দেয়ার পরিকল্পনা করছে কোম্পানিটি। এসবের মধ্যে গত ২০ এপ্রিল কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মারা যান।

প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিচালক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মো. ফজলুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার অংশ হিসেবে বেশকিছু উদ্যোক্তার কাছে কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করা হয়েছিল। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসসহ বিভিন্ন কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী আইপিও আমরা আনতে পারিনি। প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি বাবদ যাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছিল, তাদের নামে এরই মধ্যে শেয়ার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নজরুল ইসলাম মজুমদারের অনুকূলে শেয়ার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তিনি হয়তো ভুল বুঝছেন। তার প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা তাকে শেয়ার বরাদ্দের নথিপত্র দিয়েছি। আশা করছি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে।

আইপিওতে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, কোম্পানির চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইপিওর জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে পরিচালনা পর্ষদে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করছি, বছরের মধ্যে আমরা আইপিও নিয়ে আসতে পারব।

দীর্ঘদিন ধরেই তালিকাভুক্ত অতালিকাভুক্ত দুই ধরনের কোম্পানির মূলধন উত্তোলনে বিষয়টি বিএসইসির অধীনে ছিল। তবে প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম, প্রতারণা দুর্নীতির কারণে ২০১৯ সালের মে মাসে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মূলধন বাড়ানোর বিষয়ে কমিশনে অনুমোদন নেয়ার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী শুধু রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) অনুমোদনের ভিত্তিতেই অতালিকাভুক্ত কোম্পানি মূলধন বাড়াতে পারবে। এর ফলে অতালিকাভুক্ত কোম্পানি মূলধন বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জটিলতা কিংবা সমস্যা হলেও সেখানে বিএসইসির কোনো আইনি কর্তৃত্ব নেই।

বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালস এখনো আইপিওর জন্য আবেদন করেনি। অতালিকাভুক্ত কোম্পানিসংশ্লিষ্ট কোনো অভিযোগ সাধারণত কমিশন বিবেচনা করে না। কোম্পানিটি যখন আইপিওর জন্য আবেদন করবে, তখন যদি আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসে তাহলে সেটি খতিয়ে দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিশ্বব্যাপী কোম্পানিগুলোর ওষুধ বিক্রি নিয়ে নিয়মিত জরিপ পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা আইকিউভিআইএ। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে কোম্পানিটি মাত্র কোটি ৯৫ লাখ টাকার ওষুধ বিক্রি করেছে। যদিও কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনে ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ১০৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বিক্রির তথ্য দেয়া হয়েছে। একই সময়ে কোটি ৪১ লাখ টাকা নিট মুনাফা দেখিয়েছে কোম্পানিটি। কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর সেগুনবাগিচায়। রাজশাহীর টিকাপাড়ায় অবস্থিত কারখানায় ১৯৮৮ সালে উৎপাদন শুরু করে কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালস।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫