অভিমত

প্রসঙ্গ: করোনাকালে শিক্ষার আধুনিকীকরণ

প্রকাশ: জুন ০৯, ২০২১

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী

শিক্ষার ব্যাপারে আমাদের একটা বিষয় বুঝতে হবে তাহলো, ২০২০ সালের আগের শিক্ষা ব্যবস্থা আর থাকবে না। ২০২০ সালের পর থেকে যে নতুন শিক্ষার ধরন শুরু হয়েছে, সেটা আমরা যত দ্রুত আয়ত্ত করতে পারব ততই মঙ্গল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ দ্রুতই নতুন ধারার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। অবশ্যই ব্যাপারটা নিখুঁত হয়নি এখনো, কিন্তু মার্চ ২০২০-এর তুলনায় মে ২০২১- অবস্থা অনেকটাই ভালো।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাস-অ্যাসাইনমেন্ট-পরীক্ষা সবই নিয়েছে। প্রথমের দিকে ছাত্রদের ডিভাইসের সমস্যা-ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির সমস্যা হলেও ধীরে ধীরে ছাত্র-শিক্ষক-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় তা কাটিয়ে উঠেছে প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে। যারা ভাবেন যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরাই পড়ে, তারা প্রকৃত চিত্র থেকে অনেক অনেক দূরে আছেন। আমরা যারা তাদের সঙ্গে জড়িত, তারা জানি আসলে তাদের গল্পটা কী। তারাও অনেকে প্রাইভেট পড়িয়ে, পার্টটাইম কল সেন্টারে সারা রাত কাজ করে নিজের খরচের টাকা জোগাড় করে, পরিবারকে চালায়। তাদের অনেকেরই প্রয়োজনীয় ডিভাইস ছিল না। ছাত্র-শিক্ষক-বিশ্ববিদ্যালয়ের চেষ্টায় সেই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে অনলাইনে চলছে সব। বৈশ্বিক মানের একদম সমকক্ষ না হলেও (আমাদের শিক্ষা খাতে কোনটিই বা বৈশ্বিক মানের সমকক্ষ!!) খুব খারাপও বলা যাবে না। আমি যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি, তাদের সীমিত ক্ষমতার মাঝেও তারা কীভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তা দিয়েছে দেখেছি। আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সাহয্যের কথা আমি জানি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাজারো সীমাবদ্ধতার মাঝেও তারা এটি করতে পারলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর না পারার কোনোই কারণ নেই। অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নিয়েছে এবং সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ যেকোনো প্যারামিটারে ফিজিক্যাল ক্লাসের চেয়ে কম নয়। তাদের প্রশ্ন-উত্তর পর্বও বেশ স্বাভাবিক। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিভাইস সংযোগ সমস্যাও প্রায় সমাধান হয়ে গেছে। এর পরেও যদি কোথাও কিছু সমস্যা থাকে, তা ছাত্র-শিক্ষক-বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সমাধান করতে পারবে না, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ইউজিসিও অনলাইনে পরীক্ষা নিতে বলেছে। যদিও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়েছে। তার পরেও সিদ্ধান্ত এসেছে। সেটাকে বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

বিশ্বের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা চলছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ক্যাম্পাসে থাকলেও তাদের ফিজিক্যাল ক্লাসে নেয়া হচ্ছে না। ফিজিক্যাল পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে না। অনলাইনে হচ্ছে সব। ল্যাব যেগুলো কোনোভাবেই সম্ভব নয় অনলাইনে, তা পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে অথবা -১০ জন করে নেয়া হচ্ছে। আন্ডারগ্রেড থেকে পিএইচডি পর্যন্ত সবকিছুতেই তা চলছে। আমেরিকা থেকে মালয়েশিয়াসব বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একই। স্কুলেও প্রায় একই অবস্থা।

আমাদেরও অনলাইনের ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হতে হবে। শিক্ষকদের হতে হবে, ছাত্রদেরও হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কেও হতে হবে। হতেই হবে।

অনেকে বলতেই পারেন, দেশে দোকান খোলা, পরিবহন খোলা, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে সমস্যা কোথায়? দোকানে যাওয়া, পরিবহন ব্যবহার করা ঐচ্ছিক ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া ঐচ্ছিক নয়। একজনের জীবনও ঝুঁকিতে ফেলা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়, যেখানে আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা আছে। আবার বলতে পারেন যে কয়েক লাখ ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে হয়তো আক্রান্তের শতাংশ অনেক কম হবে। মৃত্যু আরো কম। কিন্তু একজনও অযৌক্তিক ঝুঁকির ফলে মারা গেলে, যে মারা গেল তার জন্য কিন্তু সেটা শতভাগের মৃত্যু। অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু। যে মৃত্যুকে চাইলেই হয়তো আটকানো যেত। এখন রাস্তার যে অবস্থা (গাড়িঘোড়া সব চলছে না), তাতে চোখ বন্ধ করে পার হলেও প্রতি ১০ বারের মাঝে হয়তো অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা হয়তো দুবার। তাই বলে কি আমরা চোখ বন্ধ করে রাস্তা পার হব? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারটাও তা-ই। ঝুঁকি কমানোর জন্যই বন্ধ রাখা হয়েছে। 

আমাদের করোনার শনাক্ত মৃত্যুর হার আবার বাড়তে শুরু করেছে। এটি আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশের দেশ শুধু করোনাকে মহামারী ঘোষণা করেনি, সঙ্গে কিছু রাজ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস-কেও মহামারী ঘোষণা করেছে। প্রতিদিনের সরকারি হিসাবে মৃত্যু চার হাজারের বেশি। আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর হাজারো মানুষ চিকিৎসা নিতে যে দেশে যেত, সেই দেশ করোনায় কীভাবে নাজেহাল হয়েছে, সেটা আমরা দেখেছি। সঙ্গে দেখেছি মৃত্যু পথযাত্রীদের বাঁচার আকুতি, তাদের স্বজনদের আহাজারি দেখেছি। ভারতের অর্ধেকও যদি আমাদের এখানে সংক্রমণের তীব্রতা হয় তাহলে আমরা যে সেটা সামলাতে পারব না, এটা তো মনে হয় আমরা সবাই বুঝি।  

আমরা এমনিতেই আইন না মানা জাতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে চলাচল আরো বাড়বে। সামাজিক দূরত্ব মানা অসম্ভব। সব মিলিয়ে ঝুঁকি বাড়বে। সঙ্গে হয়তো মৃত্যুও। অসুস্থ হলে চিকিৎসা খরচ বাদই দিলাম। করোনার চিকিৎসা ব্যয় যে কত বেশি এবং এটি যে কতটা নতুন নতুন অসুস্থতার কারণ হয়, যা চিকিৎসা খরচকে প্রায় আকাশচুম্বী বানিয়ে ফেলে। এটার জন্য অনেক পরিবারকে রাস্তায় নামতে হতে পারে।

আমার মতে, সরকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বলেতে শারীরিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ না। শারীরিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্ত একদমই ঠিক আছে।

যেটা ঠিক নেই সেটা হলো, বিকল্প ব্যবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করার পদ্ধতি। টেলিভিশনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো যদিও অনেকের কাছে পৌঁছানোর একটা মাধ্যম কিন্তু এটি আসলে একমুখী শিক্ষাদান। অর্থাৎ শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে আলোচনা সম্ভব না। তাতে ইন্ট্রাকশন হয় না। ইন্ট্রাকশন শিক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। থেকে উত্তরণের রাস্তাও খুব সহজ।  প্রয়োজনীয় ডিভাইস এবং ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি নিশ্চিত করা।

এখনো যাদের প্রয়োজনীয় ডিভাইস নেই, তাদের জন্য ডিভাইসের ব্যবস্থা করা। এটি খুব বড় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন  কোম্পানির সিএসআর আর সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই স্কুল পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সহজেই তা সম্ভব। আর ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য স্বল্পমূল্যের ইন্টারনেট সংযোগ একটা নির্বাহী আদেশের দূরত্বে অবস্থিত। এটি মোবাইল কোম্পানিগুলোকেও ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির মুখে ফেলবে না।

ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর ডিজিটালকরণে ধীরে চলো অথবা কী দরকার মনোভাব আমদের ছেলেমেয়েদের বিশ্ব থেকে পিছিয়ে দিচ্ছে। আমাদের পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি, চাকরির পরীক্ষার পদ্ধতি, ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি বদল করতে হবে। এগুলো যত দ্রুত আমরা করতে পারব ততটাই আমাদের জন্য মঙ্গল। নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে যত দ্রুত আমরা খাপ খাওয়াব ততই আমাদের উন্নতি দৃশ্যমান হবে। কবে হল খুলবে, কবে হলে সবাই আসবে, কবে পরীক্ষা হবেএসব অনিশ্চয়তায় আমাদের বন্দি হয়ে থাকলে হবে না। হল খুলে পরীক্ষা শুরু হওয়ার পরে হলে মাত্র দুজনের করোনা হওয়ার কারণে সেখান থেকে অন্যদের সংক্রমণের ঝুঁকিতে আবার হল বন্ধ করে পরীক্ষা পিছিয়ে দিলে কি আমাদের কোনো উপকার হবে? না, হবে না। বাস্তবতা হলো, দুজনের করোনা হতেই পারে এবং পরীক্ষা অনলাইনে হলে শুধু দুজনই পরীক্ষা দিতে পারত না। তাদের জন্য হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের পরীক্ষা বন্ধ হতো না।

অনলাইনে কীভাবে কত ভালোভাবে পরীক্ষা নেয়া যায়, সেটা অন্য আলোচনা। অনেক ধরনের উপায় আছে। বহু বছর ধরে জিআরই পরীক্ষা অনলাইনে হচ্ছে। এখন আইইএলটিএস পরীক্ষাও অনলাইনে হচ্ছে। পুরো পৃথিবীতে তাদের ফলাফল গ্রহণযোগ্য। ভালোভাবে পরীক্ষা নেয়া কোনো সমস্যাই না। ভাইভা বলে একটা ব্যাপার আছে। যেটায় যে কাউকে বেশ ভালোভাবে পরীক্ষা করা যায়। মূল ব্যাপারটা হলো, প্রথমেই আমাদের মানতে হবে যে আমরা অনলাইনে পরীক্ষা নেব। এটি আমাদের নিতে হবে।  

কারণ আমরা ২০২০-এর আগে যে শিক্ষা ব্যবস্থা দেখে এসেছি, পৃথিবী সেখানে আর কখনোই ফিরে যাবে না। কখনোই না।

 

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, ফাইন্যান্স, ডিপার্টমেন্ট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫