ঔপনিবেশিক ভীতি থেকে বেরিয়ে আসছে ভারত

প্রকাশ: মে ১৯, ২০২১

সি. রাজা মোহন

চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মধ্যে এক ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর ঠিক পর পরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতাদের সঙ্গেও এক যৌথ সভা হয় নরেন্দ্র মোদির। ঘটনা দুটিকে স্রেফ উচ্চপর্যায়ের সাধারণ বৈঠকও বলা চলে না। কারণ এর মধ্য দিয়েই প্রথম বোঝা যায়, ইউরোপ নিয়ে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় মাত্রায় পরিবর্তন আসছে। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ভারতসহ এশিয়ার বেশির ভাগ অংশেই -জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্য দেখা গিয়েছে বেশি। তবে বর্তমানে চীনের ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে অচল ঔপনিবেশিক শক্তিবিরোধী ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে নয়াদিল্লি। ব্যাপক কৌশলগত পরিবর্তনের মাধ্যমে কাছে টেনে নিয়েছে ইউরোপকে।

ভারত বর্তমানে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য উদারীকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পাশাপাশি ইন্দোপ্যাসিফিকের নিরাপত্তা ফ্রেমওয়ার্কে যুক্তরাজ্য ইইউর সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর ওপরও জোর দিচ্ছে দেশটি। এক্ষেত্রে ভারতের নতুন লক্ষ্য হলো নিজ অর্থনীতিকে চীনবিচ্ছিন্ন করে তোলা।

নয়াদিল্লি এখন এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য আনার পাশাপাশি চীনের নেতৃত্বাধীন মহাদেশীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে। এরই ধারাবাহিকতায় ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করে তুলছে ভারত। বিষয়টি বিশ্বব্যাপী অনেককেই অবাক করে তোলার মতো। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূলে ছিল জোটনিরপেক্ষতা বিশ্বভ্রাতৃত্বের উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো। এছাড়া একসময় চীন রাশিয়ার মতো অপশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে বৈশ্বিক মেরুকরণের বহুমাত্রিকতার পক্ষেও জোর প্রচার চালিয়েছে ভারত।

কিন্তু নয়াদিল্লি সবসময় ঔপনিবেশিক শক্তি পশ্চিমাবিরোধী থেকেই যাবে, ধারণা বরাবরই ছিল অতিকথনের নামান্তর। গালগপ্প ছড়িয়েছিলেন ভারতের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এবং ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা চালানো পশ্চিমা পণ্ডিতরা। ভারতের স্বাধীনতার পর দীর্ঘ কয়েক দশক নয়াদিল্লি দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখেছে, কথা সত্য। কিন্তু তা যে চিরস্থায়ী অপরিবর্তনশীল থেকে যাবে, এমনটি মনে করার কোনো কারণও ছিল না। পরিস্থিতি সবসময় দ্রুত পরিবর্তনশীল। এর সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে সবচেয়ে গভীরে জেঁকে বসা নীতিমালায়ও পরিবর্তন আনতেই হবে।

স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব নিয়ে ভারতের আচার-আচরণে একটু একটু করে পরিবর্তন এসেছে। ধীরে ধীরে ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে মার্কিন ইউরোপীয় মূলধন প্রযুক্তি। বিশ্বের শীর্ষ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে নতুন করে সম্পর্ক বাড়ানোর পাশাপাশি বৈচিত্র্য আনতে চেয়েছে নিরাপত্তা সম্পর্কের দিক থেকেও।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্কের বিকাশ শুরু হয়েছে একুশ শতকে এসে। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার পুনরুজ্জীবিত কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগে এসে তা পরিণতি পেয়েছে। কিন্তু উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ থাকলেও ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক তেমন একটা এগোচ্ছিল না। পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয় মোদি সরকারের অধীনে। নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্র উপদেষ্টারা ভারতের সঙ্গে ইউরোপের সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে অনেকটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

এক্ষেত্রে সম্ভাবনার প্রথম ক্ষেত্র ছিল ফ্রান্স। ওয়াশিংটনের মতো প্যারিসও দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণে প্রস্তুত ছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের আঞ্চলিক বিরোধের ক্ষেত্রে অনেকটা নয়াদিল্লির দিকে ঝুঁকে ছিল প্যারিস। এছাড়া ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইন্দোপ্যাসিফিক ফ্রেমওয়ার্কে নিজের লাভবান হওয়ার জায়গাগুলোও দ্রুত চিহ্নিত করতে পেরেছে। এতে নয়াদিল্লির সঙ্গে রাজনৈতিক নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়িয়ে তুলেছে প্যারিস।

এছাড়া বেইজিংয়ের সৃষ্ট হুমকিগুলো নিয়ে ওয়াশিংটন প্যারিসের দৃষ্টিভঙ্গিও নয়াদিল্লির মতোই। অন্তত হুবহু না হলেও তা মোটা দাগে একই। লন্ডন ব্রাসেলসের মধ্যে এতদিন কিছুটা ঔদাসিন্য থাকলেও এখন চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি। জার্মানি নেদারল্যান্ডসও এখন ইন্দোপ্যাসিফিক নিয়ে তাদের নিজস্ব কৌশল সাজিয়েছে। নিয়ে তারা এখন ভারতের দিকে নতুন করে তাকাতেও প্রস্তুত।

মোদির অধীন নয়াদিল্লি লন্ডন ব্রাসেলসের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে সব ধরনের দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে বরাবরই প্রস্তুত। এক্ষেত্রে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক সম্পদের সম্ভাবনা খতিয়েও দেখছে ভারত।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করের ভাষায়, ভারত এখন চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক করতে, চীনকে বাগে আনতে, ইউরোপ থেকে লাভবান হতে, রাশিয়াকে নিশ্চয়তা দিতে এবং জাপানকে খেলায় নামাতে।

সম্ভবত এবারই প্রথম ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যুক্তরাজ্যসহ গোটা ইউরোপকে ভূরাজনৈতিক অংকের অংশ হিসেবে দেখছে।

তবে মোদি তার উপদেষ্টাদের যুক্তরাজ্য ইইউর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারা এক বিষয় আবার বিষয়ে রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তা বোঝাতে পারাটা আরেক বিষয়। সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি যুক্তরাজ্যকে নিয়ে এক ধরনের অসন্তোষ এখনো নয়াদিল্লিতে বিদ্যমান। ভারত পাকিস্তান নিয়ে লন্ডনের সমদৃষ্টিভঙ্গিপূর্ণ নীতি, কাশ্মীর প্রশ্নে অবস্থান ভারতের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন বিষয়ে নাক গলানোর প্রবণতা অনেকটা অনিবার্যভাবেই ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করে রেখেছে।

কয়েক বছর ধরেই অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে স্থানীয়দের যুক্তরাজ্যের কৌশলগত গুরুত্বের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করছেন জয়শঙ্কর। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, রাজনৈতিক নিরাপত্তা পরিমণ্ডলে যুক্তরাজ্যের গুরুত্বকে সামনে নিয়ে আসছেন তিনি। নয়াদিল্লি দেখেছে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলানোর বিষয়ে যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন রক্ষণশীলদের আগ্রহ সাবেক লেবার পার্টি সরকারের চেয়ে অনেক কম। বরং তারা অভিবাসনসহ অনেক ইস্যুতেই ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া করার ক্ষেত্রে আরো অনেক বেশি উদার।

নয়াদিল্লির মধ্যে এখন আর সাবেক ঔপনিবেশিক অতীত নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের প্রবণতা নেই। পাকিস্তানের প্রতি ব্রিটিশদের অনুমিত সমর্থন বা কাশ্মীর ইস্যুতে অবস্থান নিয়ে অভিযোগ তোলার প্রবণতাও নেই। বরং লন্ডনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে অনেকটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মোদি সরকার। একই সঙ্গে ভারতের জাতীয় উন্নয়নে ব্রিটিশ শক্তিকে কাজে লাগানো এবং ব্রেক্সিট-পরবর্তী বিশ্ব নিয়ে লন্ডনের উচ্চাভিলাষেরও সুযোগ নিতে চায় নয়াদিল্লি। পাশাপাশি যুক্তরাজ্যে বিপুলসংখ্যক ভারতীয় অভিবাসীর অবস্থানের ফলে জটিল হয়ে ওঠা পরিস্থিতিকে আরো বাস্তবসম্মতভাবে মোকাবেলারও পথ খোঁজা হচ্ছে।

লন্ডনের ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির সংকট যেমন অতিঘনিষ্ঠতা ঐতিহাসিক বিবাদ, ব্রাসেলসের ক্ষেত্রে তেমনি সমস্যা হলো দূরত্ব ঔদাসিন্য। দীর্ঘদিন ধরে নয়াদিল্লি ইউরোপকে দেখেছে হয় লন্ডন, নয়তো মস্কোর চোখে। গত কয়েক বছরে নয়াদিল্লি ইউরোপ নিয়ে রাজনৈতিক ঔদাসিন্য থেকে সরে এসেছে। একই সঙ্গে ইইউর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নেও মনোযোগ দিয়েছে। অন্যদিকে ইইউর ২০১৯ সালের ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজি বলছে, ভারত নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে ব্রাসেলসেরও।

মোদির সঙ্গে ইইউর নেতাদের ভার্চুয়াল সম্মেলন শেষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে উভয় পক্ষের এক উচ্চাভিলাষী ফ্রেমওয়ার্ক প্রকাশ হয়। বাণিজ্য, কানেক্টিভিটি, বাণিজ্যিক সরবরাহ চেইন, জলবায়ু পরিবর্তন ডিজিটাল রূপান্তরসহ অনেক কিছুই ফ্রেমওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

চীন, ইন্দোপ্যাসিফিক এবং আঞ্চলিক বৈশ্বিক পর্যায়ে ভারতের সম্ভাব্য অবদান নিয়ে যুক্তরাজ্য ইইউর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিই এখন ইউরোপের সঙ্গে ভারতের অংশীদারির মূল ভিত্তি। তবে ভারত এটাও বুঝতে পারছে, উভয় পক্ষের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভিত্তিটি বেশ দুর্বল। সবকিছুর পরও লন্ডন ব্রাসেলসের কাছে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকারের বিষয় হলো বাণিজ্য।

চীনা নেতৃত্বাধীন এশিয়াভিত্তিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপে যোগ দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে ভারত। এর পরিবর্তে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গভীর করার বিষয়ে আগ্রহ বেড়েছে নয়াদিল্লির। বর্তমানে দেশটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আলোচনা বাড়ানোয় আগ্রহী হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন থমকে থাকা বাণিজ্য উদারীকরণ নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে ইইউকেও তাগাদা দিচ্ছে দেশটি। এক্ষেত্রে ভারতের খাতসংশ্লিষ্ট আমলাদের যুক্তরাজ্য ইইউর সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে কৌশলী চিন্তাভাবনা করানোর বিষয়েও নরেন্দ্র মোদিকে প্রয়াস চালাতে হয়েছে।

(ফরেন পলিসিতে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে অনূদিত সংক্ষেপিত। লেখক ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক)


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫