দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগও জানিয়েছিল, রমজান ও গ্রীষ্মে দেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট থাকবে না। বেশির ভাগ জেলায় তা কমেছেও। যদিও বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে রংপুর ও সিলেটে। দুটি জেলাতেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে জেলা দুটিসহ আশপাশের কিছু এলাকার প্রায় ৩৫ লাখ গ্রাহক এখন মারাত্মক ভোগান্তিতে দিন পার করছেন।
রংপুর-সিলেটের গ্রাহকদের অভিযোগ, রোজা ও তীব্র গরমের মধ্যে প্রতিদিন সব মিলিয়ে অন্তত ১০-১২ বার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শিকার হতে হচ্ছে তাদের। কখনো কখনো বিদ্যুৎ আসতে সময় লাগছে আধ ঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা। বিদ্যুতের ঘন ঘন বিভ্রাটের কারণে এসব এলাকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কল-কারখানাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে হাতে নেয়া পণ্য উৎপাদন কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।
অন্যদিকে এসব এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুতের চাহিদায় কোনো ঘাটতি নেই। তবে পুরনো বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, দুর্বল বিতরণ লাইন ও সংশ্লিষ্ট এলাকার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
রংপুর বিভাগে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো) এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। নেসকো বলছে, জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ পরিবাহী ট্রান্সফরমার অকেজো হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। অন্যদিকে আরইবি বলছে, রংপুর অঞ্চলে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনগুলো বহু পুরনো। পিজিসিবি ওই এলাকায় গ্রিড লাইনের কাজ করছে। ফলে বিদ্যুতের সরবরাহে ব্যাঘাত হচ্ছে।
নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সাবস্টেশন নষ্ট হওয়ার কারণে আমরা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ভুগছি। সেটি মেরামতের কাজ চলছে। এ ধরনের জটিলতায় পড়তে হতো না যদি বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি চালু থাকত। তাছাড়া যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে সেটি লো-ভোল্টেজের সমস্যা। এটা পিজিসিবির আওতায়, আমাদের কিছু করার নেই।
তথ্যমতে, রংপুর ও দিনাজপুরে নেসকো এবং পল্লী বিদ্যুতের মোট গ্রাহক প্রায় ২০ লাখ। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে নেসকোর গ্রাহক রয়েছেন সাত লাখের মতো। তাদের দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ২০০-২৮০ মেগাওয়াট। এ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সরবরাহ করা হচ্ছে জাতীয় গ্রিড থেকে নিয়ে। কিন্তু উপকেন্দ্র ও পিজিসিবির লাইন নির্মাণের কারণে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না নেসকো। একই অবস্থা পল্লী বিদ্যুতেরও। সংস্থাটির ১৩ লাখ গ্রাহকও এখন চরম বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শিকার।
রংপুর নগরীর আলমনগর এলাকার বাসিন্দা মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, তীব্র গরমে-তাপদাহে অতিষ্ঠ নগরবাসী। এর মধ্যেই আবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে ঘন ঘন। দিনে এমন করে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটছে ১০-১২ বার। কখনো আধা ঘণ্টা কখনো ১ ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বেশি। এর মধ্যে শুধু পিক আওয়ারেই চাহিদা উঠেছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। বিতরণ কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের দাবি, প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুতের চাহিদামাফিক সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও রংপুর ও সিলেটে তা কোনোভাবেই সামাল দেয়া যাচ্ছে না।
স্থানীয় গ্রাহকরা জানালেন, সিলেট জেলায় উপকেন্দ্র ও বিতরণ লাইন সংস্কারের কথা বলে প্রতিদিনই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হচ্ছে ৮-১০ ঘণ্টা। গত এক সপ্তাহে প্রায়ই সকাল ৬টা থেকে শুরু করে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকছে। এর বাইরে সন্ধ্যা ও রাতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে এখানকার গ্রাহকদের মধ্যেও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিক্রয় ও বিতরণ) বণিক বার্তাকে বলেন, জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের কারণে বিশেষত বিদ্যুতের ফিডারের উন্নয়নে সিলেট শহরের বহু জায়গায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। ৬৮ এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছে গত কয়েকদিনে। তবে আশা করছি, দ্রুত এ সংকটের সমাধান হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জরুরি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য গত এক মাসে অন্তত ৮-১০ বার বিদ্যুৎ সরবরাহ আধা ঘণ্টা করে বন্ধ রাখা হচ্ছে। এ কারণে সিলেট শহরের শিবগঞ্জ, সেনপাড়া, টিলাগড়, লামাপাড়া, সবুজবাগ, হাতিমবাগ, রাজপাড়া, তেররতন, নাইওরপুল, ধোপাদিঘিরপাড়, সোবহানীঘাটসহ বহু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে।
এক গ্রাহকের অভিযোগ, সংস্কারকাজের বিলম্বে মাসের পর মাস বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ভুগছে নগরবাসী। কোনো সমাধান নেই। কোনো কারণ ছাড়াই যখন-তখন ঘোষণা দিয়ে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
তবে শুধু রংপুর বা সিলেট নয়, দেশের অন্যান্য ছোট-বড় শহরেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায়ও বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। তবে এখানকার ভোগান্তি দেশের অন্য অনেক শহরের চেয়ে কম। অন্যদিকে রোজার আগে বিদ্যুৎ বিভাগও ঘোষণা দিয়েছিল, এবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হবে না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুেসবা নিশ্চিতে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। যদিও দেশের অনেক জেলায়ই এর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ চাহিদা রয়েছে, তা আমরা উৎপাদন করছি। বেশকিছু এলাকায় বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে, সেগুলো মূলত পুরনো লাইন। এ অবস্থায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে উপকেন্দ্র মেরামতসহ নানা কারণে সমস্যা হচ্ছে। এগুলো মেরামতের কাজ চলছে, আশা করি তা দ্রুত নিরসন হবে।
তবে পরিস্থিতি যে এমন দাঁড়াতে পারে সে বিষয়ে আগেই জানিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। এ বিষয়ে বিভাগটির বক্তব্য ছিল, পুরনো লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও উপকেন্দ্রের সরবরাহ দুর্বল হওয়ায় বিদ্যুতের ভোল্টেজে সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর ফলে বিদ্যুতের সরবরাহেও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।
বিদ্যুৎ খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, এ অবস্থা যে তৈরি হবে তা আমরা আগেই বলেছিলাম। রংপুর অঞ্চল নিয়ে আমরা আলাদাভাবে দেখিয়েছি, কোথায় কী সমস্যা হবে। তবে এ বছর ওই এলাকায় বিদ্যুতের লাইন ও উপকেন্দ্রের কাজ হয়ে গেলে আগামীতে আর সমস্যা হবে না।