কভিডে কর্মচ্যুত শ্রমিকদের নগদ সহায়তা প্রদানে ধীরগতি

দ্রুত অর্থ বিতরণে শ্রম মন্ত্রণালয়ের আরো সক্রিয় ভূমিকা কাম্য

প্রকাশ: মে ০৫, ২০২১

করোনার কারণে গত বছর লম্বা সময় বন্ধ রাখতে হয় দেশের অনেক শিল্প-কারখানা। তাতে কমে যায় রফতানি। অবস্থায় কোনো কোনো কারখানা মজুরি কমায়। আবার অনেক কারখানা শ্রমিক ছাঁটাইও করে। ফলে হঠাৎ করে কর্মহীন হয়ে পড়েন রফতানিমুখী পোশাক, চামড়াজাত পণ্য পাদুকা শিল্পের বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। কর্মহীন এসব শ্রমিকের আপত্কালে সহায়তার জন্য নেয়া হয় নগদ অর্থ প্রদানের কর্মসূচি। সরকারের পাশাপাশি উদ্যোগে এগিয়ে আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জার্মানি। সমন্বিত কর্মসূচিতে তহবিল আছে হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। দুর্ভাগ্যক্রমে আলোচ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। এখন পর্যন্ত তহবিলের অর্থছাড়ের হার মাত্র দশমিক শতাংশ বলে খবর মিলছে। বাস্তবায়নজনিত দীর্ঘসূত্রতায় ভালো উদ্যোগটির সুফল পাচ্ছেন না কর্মচ্যুত দুস্থ শ্রমিকরা। সুতরাং গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে গতি আনা এখন সময়ের দাবি।

কথা ছিল গত সেপ্টেম্বর থেকে কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন হবে। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে স্বতন্ত্র নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়। নীতিমালায় বলা হয়, ফেব্রুয়ারির পে-রোলে থাকা নামের ভিত্তিতে মার্চ থেকে কর্মহীন হওয়া দুস্থ শ্রমিকরা প্রতি মাসে হাজার টাকা করে পাবেন। মার্চ, এপ্রিল মে তিন মাসের জন্য শ্রমিকপ্রতি মোট দেয়া হবে হাজার টাকা করে। কিন্তু সরকারি প্রস্তুতিজনিত বিলম্বের কারণে কর্মসূচিটি শুরু হতে সময় লাগে ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রায় ছয় মাস অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন হার শতাংশের নিচে। বাস্তবায়নে ধীরগতির পেছনে কিছু প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা ত্রুটি কাজ করছে। নিয়ম অনুযায়ী কারখানাগুলো প্রথমে  শিল্প সংগঠনকে কর্মচ্যুত বা বেকার শ্রমিকের নাম জমা দেয়। শিল্প সংগঠন আবার সেই তালিকা পাঠায় শ্রম অধিদপ্তরে। সেখানে যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্তভাবে অর্থ ছাড় করা হয়। প্রায় ১২ হাজার আবেদন জমা পড়লেও এখন পর্যন্ত অর্থ বিতরণ করা হয় মাত্র ছয় হাজারের বেশি কর্মচ্যুত শ্রমিককে। এটা হতাশাজনক নৈপুণ্য বৈকি। 

নগদ অর্থ বিতরণে দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ কারখানা কর্তৃপক্ষের শৈথিল্য। দুস্থ শ্রমিকের নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, মোবাইল নম্বর, ব্যাংক বা এমএফএস হিসাবসহ প্রয়োজনীয় তথ্য কারখানাগুলোর কাছে আছে। কিন্তু এসব তথ্যসহ নির্বাচিত তালিকা যথাসময়ে তারা পাঠাচ্ছে না বলে খবর মিলছে। কাজের ব্যস্ততার অজুহাতে তালিকা পাঠাতে বারবারই দেরি করা হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে কিছু কারখানা বন্ধ। ধরনের কারখানার শ্রমিকের নাম চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে নাম পাঠানো হলেও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার সঙ্গে মিলছে না। ফলে সংশ্লিষ্ট তহবিল থেকে অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হচ্ছে। অবস্থায় বিদ্যমান প্রক্রিয়াগত ত্রুটি দুর্বলতাগুলো দূর করে বাস্তবায়ন কার্যক্রম বেগবান করার বিকল্প নেই।

অনেক দেশই কভিডের প্রভাবে কর্ম হারানো মানুষদের সহায়তা দিচ্ছে। কিছু দেশ খাতওয়ারি কর্মীদের জন্য আলাদা হটলাইন নম্বর চালু করেছে। ওই নম্বরে ফোন করলে নামসহ প্রয়োজনীয় তথ্য অনলাইনে নিবন্ধন করা হয়। পরে জাতীয় স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে যাচাই-বাছাইপূর্বক দ্রুত অর্থ ছাড় করা হয়। আমাদের রফতানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলো আজকাল ডিজিটালি এগিয়ে। জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারের সুবাদে জাতীয়ভাবেও একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু আছে। সেক্ষেত্রে কর্মচ্যুত শ্রমিকদের জন্য হটলাইন নম্বর চালু করলে বিদ্যমান প্রক্রিয়ার পাশাপাশি তারা সেখানেও ফোন করার সুযোগ পাবেন। এতে প্রাথমিক তালিকা থেকে চূড়ান্ত নির্বাচিত তালিকা প্রস্তুতের কাজটি আরো সহজ এবং অর্থছাড়েও অযাচিত বিলম্ব এড়ানো সম্ভব হবে। কাজেই উল্লিখিত বিষয়টি বাংলাদেশে আমলে নেয়া যেতে পারে।

নজিরবিহীন স্বাস্থ্য সংকটের সময়ে কর্মচ্যুত দুস্থ শ্রমিকরা কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। করোনার দ্বিতীয় প্রবাহে এখন চলছে লকডাউন তথা চলাচলজনিত বিধিনিষেধ। ফলে অনেকেই বিকল্প আয়ের সংস্থানও করতে পারছেন না। এমন অবস্থায় মাসে হাজার টাকা পাওয়াও তাদের জন্য বড় স্বস্তির বিষয়। অথচ গৃহীত সহায়তা কর্মসূচির অর্থ ছাড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বে তা- সম্ভব হচ্ছে না। অর্থ বিতরণে দীর্ঘসূত্রতার ক্ষেত্রে কারখানা কর্তৃপক্ষের দায় নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এর দায় শ্রম অধিদপ্তর পুরোপুরি এড়াতে পারে না। কেননা কর্মসূচিটি বাস্তবায়নের মূল ভূমিকায় আছে সংস্থাটি। কাজেই ব্যবস্থাপনাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়িয়ে কীভাবে অর্থ বিতরণ বেগবান করা যায়, তার উদ্ভাবনী উপায় সন্ধান করা জরুরি। এক্ষেত্রে চাই সংস্থাটির আরো সক্রিয় ভূমিকা। এখানে বিজেএমইএসহ সংশ্লিষ্ট শিল্প সংগঠনগুলোরও একটি ভূমিকা আছে।  যেসব কারখানা কর্মচ্যুত শ্রমিকের তালিকা প্রদানে দেরি করছে, তাদের চাপ দিতে পারে সংগঠনগুলো। যাতে প্রকৃত উপকারভোগীদের নির্বাচিত করা এবং দ্রুত অর্থ বিতরণ সহজতর হয়। 

দেশের প্রবৃদ্ধির প্রধান চালকের ভূমিকায় এখন রফতানিমুখী শিল্প খাত। কিন্তু কভিডের কারণে অনেকটাই বিপর্যস্ত খাত। বিশেষত শ্রমিকদের অবস্থা বেশি খারাপ। কর্মচ্যুত হয়েছেন অনেক শ্রমিক, ঝুঁকিতে আছেন অনেকে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে চলমান মহামারীর প্রভাবে এখন পর্যন্ত কতজন শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন, তার সঠিক তথ্য নেই সরকার বা মালিকপক্ষের কাছে। তবে শ্রমঘন শিল্প খাতগুলোয় ৩৬ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে শিল্প পুলিশের বরাতে। এটা খুব রক্ষণশীল হিসাব। সংখ্যা আরো বেশি হবে সংশ্লিষ্টদের মত। কাজেই কর্মচ্যুতির বিষয়টি সামনে আরো বড় ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অবস্থায় কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য গৃহীত কর্মসূচিটিকে পশ্চিমা দেশগুলোর আদলে স্থায়ী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় রূপ দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। এটা ইতিবাচক। সব পক্ষের সমন্বয়ে বিদ্যমান ত্রুটি চিহ্নিত করে একটি টেকসই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বিনির্মাণ করা হবে এক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত প্রয়াসে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা অবিলম্বে সহায়তা পাবেন বলে প্রত্যাশা।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫