আলোকপাত

কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা ও গুজবের অর্থনীতি

প্রকাশ: মে ০৪, ২০২১

ড. এ. কে. এনামুল হক

ঘটনাচক্রে হঠাৎ চোখে পড়ল একটি সংবাদ, দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাস বন্ধ রেখেছেন। কারণ? তারা বলছেন সরকারের কঠোর লকডাউনের ফলে তাদের পক্ষে অনলাইনে পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বলে একটি শব্দ জানা ছিল কিন্তু মর্মার্থ বুঝতে পারিনি। এটাও কি সম্ভব? লকডাউন কী করে অনলাইনের পাঠদানে অসুবিধা তৈরি করতে পারে? তাও আবার এমন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তা জানালেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশবাসী জানে প্রকৌশলীদের আঁতুড়ঘর হিসেবে। 

আরেকটি সংবাদ দিই। আমার এক আত্মীয় অসুস্থ বোধ করলে সবাই মিলে ভাবলাম কভিড টেস্ট করানো উচিত। আজকাল অসুস্থতা গুরুতর হওয়ার আগেই টেস্ট করে ফেলা ভালো। তাতে অন্তত যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। কিন্তু অঘটনটি ওখানেই ঘটল। যার অসুস্থতার জন্য কভিড টেস্ট করার কথা ভাবা হলো, তার বদলে তার স্ত্রীর কভিড ধরা পড়ল। একই সপ্তাহে দ্বিতীয়বার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম। মনে মনে ভাবলাম, নিশ্চয় কোথাও ভুল হয়েছে? যাকে তারা কভিড বলে শনাক্ত করল, তার কোনো লক্ষণ নেই। লক্ষণবিহীন কভিড বলে শুনেছিলাম কিন্তু তাও কি আমাদের পরিবারে? ভাবলাম দুজনের একসঙ্গে স্যাম্পল দেয়াতেই কি ভুল হলো? কী করা? ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে জানালেন অপেক্ষা করুন। আরো কিছু টেস্ট দিচ্ছি, তবে আপাতত আলাদা ঘরে তাকে রাখুন। আবার কিছু রক্ত পরীক্ষার পরামর্শ দিলেন। পরদিন সেই হাসপাতাল থেকে ফোন এল। হ্যালো, আপনাদের বাসায় আমরা কভিড পরীক্ষা করেছিলাম দুজনের। একজনের কভিড শনাক্ত হয়েছিল। আপনারা তাকে কী করেছেন? আবারো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এও কি সম্ভব? হাসপাতাল জিজ্ঞেস করছে রোগী কোথায়? চিকিৎসা শুরু করিয়েছেন? মনের মধ্যে খচ করে উঠল, তবে কি ইচ্ছে করেই তারা কাজটি করেছে? আর তাই হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। কভিড রোগী ভর্তি করা মানে অনেক আয়! আজকাল কভিড রোগীর ব্যবসা ভালোই চলছে। বলা হলো, আমরা বাসায়ই চিকিৎসা করাচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ।

পরদিন রক্ত পরীক্ষার ফল পাওয়া গেল। এখন পর্যন্ত সবকিছু্ই নরমাল মনে হচ্ছে। তবে ডাক্তারকে পেতে আরো একদিন অপেক্ষা করতে হবে। এদিকে সব টেস্টের মানে বোঝা ভার। তাই নিজেদের এক আত্মীয় ডাক্তারের দ্বারস্থ হতে হলো। তার কাছে সবকিছু জিজ্ঞেস করে যা বুঝলাম, তাতে মনে হলো, যিনি কভিড নেগেটিভ, তাকে নিয়েই চিন্তা করা উচিত। আর যিনি কভিড পজিটিভ, তার সবকিছুই বলা যায় নরমাল। কী করা যায়? কোথায় সাহায্য পাওয়া যায়? ততক্ষণে পরিবারের অনেকেই জেনে গেছে বিপদের কথা। আজকাল সংবাদ বাতাসের চেয়ে অধিক গতিতে ছড়িয়ে যায় বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ইন্টারনেটের সঙ্গে হোয়াটসআপ যোগ করলে কী হয়, তা জানি না। তবে তা যে বিদ্যুতের চেয়েও গতিময় কিছু হয়, তা বলা বাহুল্য। সঙ্গে সঙ্গে উপদেশ আসতে লাগল। আইভারমেট্রিকটিন শুরু করে দাও। রক্ত জমাট বাধা বন্ধ করার জন্য একটি ইনজেকশন আছে তা দাও। দেরি করা যাবে না। কিন্তু যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, তিনি হাসছেন। কী করে হলো বুঝতে পারছেন না। কেন তাকে সবার থেকে আলাদা থাকতে হবে, তাও বোঝানো যাচ্ছে না। রোগ বা অসুস্থতা শব্দের সংজ্ঞা বদলে গেছে যুগে। লক্ষণহীন রোগী কস্মিনকালেও শুনিনি। অন্যদিকে যার কভিড নেই, তার মনের অবস্থা ভালো নেই। কী হবে? কফ ছিল। জ্বর ছিল। কাশি ছাড়ছে না। রক্তের টেস্ট বলছে কিছু একটা হয়েছে। এখন কী করা? রাত তখন ১২টা। পরিবারের সবাই আবারো ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হলো। সবাই এখন সব জানতে পারে, সবকিছু। কিছু না জানলে গুগলকে জিজ্ঞেস করো। সবকিছুই এখন আঙুলের মাথায়। কখনো মনে হচ্ছে ভীষণ কিছু হতে যাচ্ছে। কখনো মনে হচ্ছে কভিড টেস্টের স্যাম্পল কি অদলবদল হয়ে গেল? অবস্থাকে কীভাবে বর্ণনা করবেন। আমার মাথায় একটিই শব্দ। কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পরিবারের সবাই কনফারেন্স কলে এসেছে কয়েকবার। কীভাবে কী করা। কভিড রোগীকে কি আলাদা করব? নাকি যার কভিড নেই, তাকে আলাদা করব? বাসার আয়তন এত ছোট নয় যে আলাদা কক্ষে একা থাকা যাবে না; কিন্তু বাথরুম? বাসায় মানুষ তিনজন। বাথরুম দুটো। কীভাবে কী করা। যাকে মনে হচ্ছিল কভিড, তাকে তো আগেই আলাদা করে দেয়া হয়েছিল। এবার? কথায় কথা বাড়ে। সবকিছু সবার মনেও থাকে না। রাত ২টায় একজন জানতে পারলেন হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছিল। তাকে হাসপাতালের ফোনের খবরটি জানাতে কারো মনে ছিল না। শুনেই বললেন, অবস্থা খুবই সঙ্গিন। হাসপাতাল মারাত্মক কোনো চিহ্ন না দেখে তো ফোন করেনি। কে ফোন ধরেছিল? তার কাছ থেকে বিশদ বিবরণ নেয়া দরকার। চলল অনেকক্ষণ জেরা। কুলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। জেরার ফলাফল শূন্য। কারণ বিশদ কিছু হাসপাতাল জানায়নি। কেবল জানতে চেয়েছে চিকিৎসা কোথায় চলছে? সেহরির সময় হতে চলল। কী করা যায়। পরিবারে কয়েকজন ডাক্তার আছেন। তাদের একজন ইন্টার্ন কিন্তু সে এরই মধ্যে কভিড বিশেষজ্ঞ। তার মা কভিড থেকে সুস্থ হয়েছেন কিছুদিন হলো। তার উপদেশএই এই টেস্ট করে ফেলেন। অক্সিমিটার দিয়ে ব্লাড অক্সিজেন মনিটর করেন। আলাদা করো। একই কক্ষে কখনই একসঙ্গে ১০ মিনিটের বেশি করেন না। রোগীকে মাস্ক পরতে হবে। যিনি খাবারদাবার সরবরাহ করবেন, তাকেও মাস্ক পরতে হবে। কাউকে কভিড রোগীর কক্ষে ১০ মিনিটের বেশি সময় থাকতে দেয়া যাবে না। তাতে সবার মঙ্গল। উপদেশগুলো আমাদের রোগী ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে সহায়ক ছিল। পরিবারের আরেক দল ভাবতে লাগল কোথা থেকে ঘরে করোনাভাইরাস প্রবেশ করল? মনে হচ্ছে কাজের লোকের হাত ধরে ঘরে ঢুকেছে। বাসায় চুরি হলে দোষ হয় কাজের লোকের। ডাকাতি হলেও তাই। এখন কভিড, তাতেও একই লোক প্রথমেই সন্দেহের তালিকায়। তাকে তো মাস্ক পরানোই যাচ্ছে না। সে বিশ্বাসই করে না কভিড বলে কিছু আছে!

প্রায় একই সঙ্গে খবর এল, আরো এক বাসায় কাজের লোকের শরীর খারাপ। সে থাকে এক বয়স্কা নারীর সঙ্গে। তার কাজের লোকের অসুস্থতা শুনে সবাই প্রমাদ গুনছে। কী হবে এখন। তাকে কি বাড়ি যেতে বলব? কেউ কেউ সেই চেষ্টাও করল। কেউ কেউ বলল, না, তাকে আলাদা ঘরে রাখো। চিকিৎসা অবশ্য ততক্ষণে শুরু করা হয়েছে। কিন্তু বাদ সাধলেন সেই বয়স্কা নারী, যার সঙ্গে তিনি থাকতেন। তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না তাকে। নারীই তার হাতের পাঁচ। তাকে নিয়েই চলে তার জীবন। বলা হলো, তাকে আলাদা করে রাখি আপাতত। একটি কক্ষ তাকে দেয়া যেতে পারে। না, তা হবে না। তার কিছু হয়নি। তাকে সেবা দিলেই ভালো হয়ে যাবেন। তার বিশ্বাস পরিশ্রমে তিনি অবশ্য শেষ পর্যন্ত ভালোই হলেন।

বাসায় এতক্ষণে অন্যদের অবস্থা কাহিল। উপদেশের পর উপদেশ আসছে। কী করা যায়। যারা উপদেশ দিচ্ছেন, তারা আমাদের ভালো চাচ্ছেন। কিন্তু তাদের উপদেশ মেনেই কি ওষুধ শুরু করে দেব? একজন বোঝালেন এই কভিড খুব তাড়াতাড়ি দুর্বল করে দেয়। সময় দেয় না। অতএব, রাত পোহানোর দরকার নেই। আমি যে ট্যাবলেটের নাম দিচ্ছি, তা এক্ষুনি চালু করে দেন। দরকার হলে আমি আসছি ওষুধ নিয়ে। ফোনের পর ফোন চলল। আলোচনা চলল। এদিকে দুজনই বয়স্ক। দুজনেই টিকা দিয়েছেন। তবে যেদিন কভিড ধরা পড়ল, সেই দিনই দুজনের টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার কথা ছিল। একজনের শরীর খারাপ দেখে আমরা তাকে নিষেধ করলাম টিকা নিতে। গায়ে জ্বর। টিকা পরে দেয়া যাবে।  কিন্তু যার কোনো জ্বর নেই, কোনো লক্ষণ নেই, তাকে টিকা নিতে পাঠানো হলো। অথচ রাতেই জানা গেল তারই কভিড পজিটিভ। কী অবস্থা ভেবে দেখুন।

যাহোক, এখন কিছুই সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। ওষুধ চালু করা কি ঠিক হবে? ওষুধ না দেয়া কি ঠিক হবে? খারাপ কিছু হলে তখন কী মনে হতে পারে? আবার ওষুধ দিয়ে খারাপ কিছু হলে বোকামির দায় কে নেবে? ডাক্তারের উপদেশ ছাড়া কী করা যায়। এখন তো পরামর্শ করার ডাক্তার পাওয়া যাবে না। তবে হাসপাতালে নিশ্চয় ডাক্তার থাকবে। তাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হোক। তাতে ঝুঁকি কমবে। সবই শুনছি।  একজন বললেন, কিন্তু এখন সব হাসপাতালে তাকে নেবে না, যেতে হবে কভিড হাসপাতালে। যার কোনো লক্ষণ নেই, তাকে কি কভিড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে? এমনও তো হতে পারে যে পুরো পরীক্ষাই ভুল। সেক্ষেত্রে তাকে কভিড হাসপাতালে নেয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পাঠানো হবে। থাকতে হবে কভিড রোগীদের মাঝে। সেখানে রোগীদের কষ্ট দেখে তার নিজের অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। কী করা যায়। আবারো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। 

পরদিন সকালে ডাক্তারকে রিপোর্ট পাঠানো হলো। তিনি কভিড পজিটিভ রোগীর রিপোর্ট দেখে তেমন কিছু করতে বললেন না। ভিটামিন ডি আর জিংক ট্যাবলেট দিলেন। বললেন, নিয়মিত অক্সিজেন পরীক্ষা করুন। আর বললেন অক্সিজেন লেভেল নেমে গেলে জানাবেন। কিন্তু যার কভিড নেগেটিভ, তাকে ওষুধ দিলেন। কিছু নতুন পরীক্ষাও দিলেন। বললেন, তাকেও অক্সিমিটারে অক্সিজেন লেভেল দেখবেন নিয়মিত। অতএব, একটি অক্সিমিটারে হবে না। দুটো লাগবে। একটি কভিড পজিটিভ রোগীর জন্য, অন্যটি কভিড নেগেটিভ রোগীর জন্য। সারা দিন সবাই ক্লাউড সভা করলেন। কী করা যায়। বাসায় দুই রোগী। তাও ভিন্ন প্রকৃতির। দুজনের দুই রকম অবস্থা। অবশিষ্ট এক ব্যক্তির অবস্থাও তথৈবচ। তার কভিড পরীক্ষা হয়নি। কিন্তু একা কী করে দুজনকে সামলাবেন। এদিকে যার কভিড পজিটিভ, তিনি রীতিমতো সুস্থ। বুঝতেই পারছেন না তার ওপর এই অত্যাচার কেন? সম্ভবত যাদের বাসায়ই কভিড এসেছে, তাদের অবস্থা একই রকম। বর্ণনা করছি কারণ যাদের বাসায় আসেনি, তাদেরকে প্রকৃত অবস্থা বোঝাতে।

এরই মধ্যে বিকালবেলা ফোন বাজল। হ্যালো। কে? আমরা জানতে পেরেছি আপনাদের বাসায় একজন কভিড রোগী আছেন। তার চিকিৎসার জন্য কী ব্যবস্থা হয়েছে? আমরা সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কথা বলছি। জি, কী জন্য? আমাদের কাছে তথ্য আছে আপনাদের বাসায় একজন কভিড রোগী আছেন। তার চিকিৎসার খোঁজ নিচ্ছি। আমাদের সরকারি ডাক্তার কিছুক্ষণ পর আপনার নাম্বারে কথা বলবেন। কী করতে হবে সেই উপদেশ দেবেন! প্রয়োজনে ডাক্তার রোগী দেখতে যাবেন। ভাবতেই পারছি না, আমরা বাংলাদেশে বসবাস করছি। এও সম্ভব বাংলাদেশে? সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে আবারো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বুঝতেই পারছেন প্রতিদিন কয়েক হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মতত্পরতা প্রশংসার দাবি রাখে। আমি ভাবছি কী করে অসম্ভব সম্ভব হলো? ঠিকই কিছুক্ষণ পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডাক্তার ফোন করলেন। জানতে চাইলেন কোনো সহায়তা লাগবে কিনা। ওষুধ লাগবে কিনা? আপনারা কী ভাবছেন জানি না, তবে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

কভিড শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় অক্সিমিটার দেখা হচ্ছে। কিন্তু কভিড রোগীর অবস্থার কোনো অবনতি হয়নি। তিনি নির্জনে বসে একাকী কবিতা লিখছেন। একা এক কক্ষে আলাদা থাকা সময়ের মোক্ষম ব্যবহার তিনিই করছেন। বাকি সবাই বাস করছে ভীতির মাঝে। কিছুই করার নেই। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো ১০ দিন। আশা করি সবাই ভালো থাকবে। আগেই বলেছি দুজনেই বয়স্ক। পরিবারের চিন্তা ওখানেই। কভিড নেগেটিভ রোগীর আরো পরীক্ষা করা হলো। জানা গেল তাকে বাসায় রাখা ঠিক হবে না। চিকিৎসা শুরু করতে হবে। সবার মাথায় বাজ পড়ল। রাতেই তাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। চিকিৎসা চলছে। অপেক্ষা করছি।

তবে ডামাডোলে আমাদের মাঝে একটি সত্য আবিষ্কৃত হয়েছে। চেনা পরিচিত, আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাই আমাদের নানা উপদেশ দিয়েছেন। তাদের আদেশ কিংবা উপদেশ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সমাজে বহুজন আপনাকে ভালোবাসে। তাদের উপদেশ আপনাকে হয়তোবা ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্ত করবে কিন্তু জানবেন তারা আপনাকে ভালোবেসেই উপদেশ দিচ্ছেন। তবে বিভ্রান্তির কারণে নিজে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করাই উত্তম। কারণ আমাদের সবার শরীর-মন যেমন এক নয়, তেমনি আমাদের সবার শরীরে সব ওষুধ সমান উপকারী না- হতে পারে। দেশে এমনিতেই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অনেক বেশি। অনেকেই ভীত হয়ে তা গ্রহণও করছেন বা ডাক্তারের ওপর নিজে ডাক্তারি করছেন। কখনো উপকার হবে কখনো হবে না। তবে জানবেন ওষুধ সঠিক মাত্রায় ব্যবহূত না হলে ভবিষ্যতে আপনার দেহে তার কার্যকারিতা হারাবে।

শেষ করার আগে আরেকটি ঘটনা বলি। মনে পড়ে কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের এক বেসরকারি বিমান কোম্পানির উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার কথা? তখন ইউটিউব কিংবা পত্রপত্রিকায় রব উঠেছিল বিমানবন্দরে দুর্ঘটনার কারণ ছিল বিমানবন্দরের টাওয়ার থেকে দেয়া ভুল বার্তা। সেই সম্পর্কিত ককপিট বার্তার একটি অডিও এখনো খুঁজে পাওয়া যাবে ইন্টারনেটে। দেশে সর্বত্র রব উঠেছিল তাদের ভুলে আমরা হারিয়েছি এতগুলো প্রাণ। বিতর্কের অন্ত ছিল না অনলাইনে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন। উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার ইনভেস্টিগেশন নিয়ে আমার কৌতূহল ছিল সবসময়। কোনো দুর্ঘটনার পর পরই রকম বার্তা এত তাড়াতাড়ি প্রচার করতে দেখিনি। কদিন আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একটি পর্বে সেই দুর্ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অবাক হয়ে দেখলাম তখনকার অনেক সংবাদই ছিল গুজব। কেউ গুজব তৈরি করেছিল। তবে গুজব ছড়িয়ে দেয়ার লোকের অভাব হয় না। আমরা গুজব ছড়াই না জেনে না বুঝে। দেখবেন গুজব যারা ছড়িয়েছিল তাদের অনেককেই আপনি বিশ্বাস করেন। ওই গুজব উড়োজাহাজটির তখনকার অধিকর্তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তাদের অবহেলার দোষ তারা ঢাকতে পেরেছিল। তদন্তের গতি অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার এমন নিখুঁত পরিকল্পনার পেছনে কারা ছিল তা এখন অন্তত আন্দাজ করা যায়।

তাই জানবেন ইন্টারনেটে অনেক গল্প ছড়ায়। সত্য-মিথ্যা নানা রকম। বিজ্ঞজন বলেন, আপনার তত্ত্বকথা সত্যি না মিথ্যা, তা যাচাইয়ের মাধ্যম হলো গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল। যেখানে বিজ্ঞজনেরা সুচিন্তিত মতামত দেবেন, চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন। আমজনতার মাধ্যমে কখনো বিশ্বে বৈজ্ঞানিক সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না। তবে গুজব তৈরি করে ব্যবসায় লাভ করা যায়। কভিড সম্পর্কিত নানা গুজবে কোনো কোনো ওষুধের চাহিদা বাড়ে।  স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ীরা তখন সেই ওষুধের মজুদ গড়ে তোলে। বাজারে দেখা দেয় সংকট। তাতে অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী দাম যায় বেড়ে। যার কাছেই ওষুধের মজুদ পাওয়া যাবে, তাকেই শাস্তির আওতায় আনার দাবি ওঠে আমজনতার মাঝে। সরকার বাধ্য হয় শক্ত হাতে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে। বাড়িয়ে দেয় নজরদারি। তাতে হিতে বিপরীত হয়। বাজার  থেকে ওষুধ উধাও হয়ে যায়। কারণ ভালো ব্যবসায়ীরাও ওই ওষুধ বিক্রি বন্ধ করে দেন। ভাবেনঅহেতুক ঝামেলায় কেন যাব? ওষুধ চলে যায় কালোবাজারে, লোভী কিছু ব্যবসায়ীদের হাতে। কালোবাজারি আর নেশাকারবারিদের নিয়ম এক। এমন অবস্থায় পণ্যটি কোথায় আছে তার প্রচার হবে অতি সংগোপনে।  চুপিসারে। কেউ একজন আপনাকে জানাবে, এই নাম্বারে ফোন করুন, এখানে মেসেজ করুন, কাউকে বলবেন না, ওষুধ পেয়ে যাবেন। এমন অবস্থায় আপনার জানার উপায় নেই ওষুধটি সঠিক নাকি ভেজাল। ফলে ভালো করতে গিয়ে বিপদও হয়ে যেতে পারে। তাই সবাই একটু ভাবুন। কেবল ডাক্তারই পারেন আপনাকে সঠিক ওষুধ দিয়ে সাহায্য করতে। গুজব ছড়িয়ে নয়। কেবল ডাক্তার আর নার্সরাই থাকবেন আপনার সঙ্গে। গুজব সৃষ্টিকারী কিংবা কালোবাজারি নয়। এত মৃত্যুর মাঝেও আমরা জেনেছি গত ২৮ দিনে দেশে ২১ জন ডাক্তার প্রাণ হারিয়েছেন। ডাক্তার নার্সরাই আমাদের এখনকার সংগ্রামের প্রকৃত যোদ্ধা। তাদের প্রতি আস্থা রাখুন। তাদেরকে সম্মান করুন। 

 

. . কে. এনামুল হক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা

পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫