আফগান যুদ্ধ শুরুর দুই দশক পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছরেই। আর কিছুদিনের মধ্যেই সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে আনার ঘোষণা দিয়েছে ওয়াশিংটন। এ যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো সাফল্য মেলেনি যুক্তরাষ্ট্রের। যদিও মার্কিন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বলছে, এ যুদ্ধের কারণে এখন পর্যন্ত প্রাণহানি হয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তির। অন্যদিকে ২০ বছর ধরে ক্রমাগত চাপ পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারেও। শুধু এ যুদ্ধ চালাতে গিয়েই গত ২০ বছরে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
আফগান যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ও বোস্টন ইউনিভার্সিটির পারডি সেন্টারের এক যৌথ গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। দ্য কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট শীর্ষক এক প্রকল্পের অধীনে এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় অনুযায়ী শুক্রবার এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, এ যুদ্ধে জীবন ও সম্পদের হানি হয়েছে অনেক। এখন পর্যন্ত এ যুদ্ধে প্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আফগান ও পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিক রয়েছে ৭১ হাজার ৩৪৪ জন। দেশ দুটির নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মারা গিয়েছে ৭৮ হাজার ৩১৪ জন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ২ হাজার ৪৪২ সৈন্য ও প্রতিরক্ষা বিভাগের ছয় বেসামরিক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। মার্কিন বাহিনীর সামরিক ঠিকাদার মারা গিয়েছে ৩ হাজার ৯৩৬ জন। যুদ্ধে মার্কিন মিত্র অন্যান্য দেশের ১ হাজার ১৪৪ জন সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ নিহত হয়েছে ৮৪ হাজার ১৯১ জন।
এছাড়া এ যুদ্ধ চলাকালে ১৩৬ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী এবং ৫৪৯ জন মানবাধিকারকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে আরো বলা হয়, এ তালিকায় শুধু যুদ্ধকালীন সহিংসতায় মৃতদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে যুদ্ধসৃষ্ট খাদ্য ও পানীয়র অভাব, অবকাঠামো ধ্বংস, রোগব্যাধি ইত্যাদিসহ পরোক্ষ প্রভাবে মৃতদের এ তালিকায় আনা হয়নি। বেশ কয়েকটি প্রাথমিক উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুই দশক ধরে মার্কিন অর্থনীতির জন্য অনেক বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আফগান যুদ্ধ। এর পেছনে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের, তা উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোর কয়েক বছরের মোট জিডিপির সমান। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় দুটির হিসাবও সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। এ হিসাব অনুযায়ী, এ যুদ্ধের পেছনে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতি বাংলাদেশের মোট জিডিপির কয়েক গুণ বেশি ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে এ ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় আঞ্চলিক বৃহৎ দেশ ভারতের এক বছরের মোট জিডিপির কাছাকাছি।
প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপির পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ২৫৭ কোটি ডলারের সমপরিমাণ। অন্যদিকে ভারতের অর্থনীতির আকার ছিল প্রায় ২ লাখ ৮৭ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ। সে হিসাবে শুধু এ যুদ্ধ চালাতে গিয়েই গত ২০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় সাড়ে সাত গুণ অর্থ খরচ করে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক ছিলেন বোস্টন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নেটা ক্রফোর্ড। তার ভাষ্যমতে, এ যুদ্ধ চালাতে গিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগকে শুধু আফগানিস্তানেই ব্যয় করতে হয়েছে ৯০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। যুদ্ধের খরচ নিরূপণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এ ব্যয়কে শুধু ‘আইসবার্গের উপরিভাগই’ বলা চলে।
প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, শুধু এ যুদ্ধের সহায়ক ঘাঁটিগুলো পরিচালনা করতে গিয়েই পেন্টাগনের ব্যয় হয়েছে ৪৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। এছাড়া যুদ্ধফেরত ও আহতদের চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা বাবদ ২৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলার, ঋণের সুদ হিসেবে ৫৩ হাজার কোটি এবং পররাষ্ট্র বিভাগের মাধ্যমে ৫ হাজার ৯০০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।
নেটা ক্রফোর্ডের বক্তব্য, আফগানিস্তান যুদ্ধের মূল্য শুধু এসবেই সীমাবদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ পাকিস্তানেও ছড়িয়েছে। বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থী হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। সামরিক-বেসামরিক প্রাণ ও মার্কিন যুদ্ধফেরতদের সেবার প্রয়োজনীয়তাকেও এর মধ্যে ধরতে হবে।
আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানে পাকিস্তান যোগ দেয় ২০০১ সালে। দেশটির আফগানিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। পাকিস্তান থেকে আফগান সীমান্তের ওপারে যুদ্ধরত মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের সহায়তা চালাতে গিয়ে নিজ সীমান্তে প্রায়ই অভিযান চালাতে হয়েছে ইসলামাবাদকে। কোয়ালিশন সাপোর্ট ফান্ডের মাধ্যমে এসব অভিযানের ব্যয়ও বহন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
কস্ট অব ওয়ার প্রকল্প থেকে জানানো হয়েছে, হিসাবকৃত ব্যয় ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলারের মধ্যে অনেক কিছুই বিবেচনায় আনা হয়নি। মার্কিন যুদ্ধফেরতদের ব্যয়ভার সারা জীবন বহনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ওয়াশিংটন। সেটি এখানে হিসাব করা হয়নি। যুদ্ধ পরিচালনায় নেয়া ঋণের ভবিষ্যতে প্রদেয় সুদও এ হিসাবে আনা হয়নি। এছাড়া এ হিসাব এখনো পুরোপুরি চূড়ান্ত করা যায়নি।
কস্ট অব ওয়ার প্রকল্পের সহপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বোস্টন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ক্যাথেরিন লাত্জ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেছেন, আফগান এবং মার্কিন সৈন্য ও নাগরিকদের এ যুদ্ধের জন্য যে ভয়ংকর মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে, ভয়াবহ এসব সংখ্যা তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। এ মুহূর্তে যুদ্ধ থামানোটাই একমাত্র মানবিক ও যৌক্তিক কাজ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত সপ্তাহেই ঘোষণা দিয়েছেন, আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন তিনি। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে হামলার দুই দশক পূর্ণ হচ্ছে। এর মধ্যেই আফগানিস্তানে নিয়োজিত সব সৈন্যকে প্রত্যাহার করে আনা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। ঘোষণাকালে ‘অনন্তকাল ধরে চলমান এ যুদ্ধ শেষ করার সময় এসেছে’ উল্লেখ করে বাইডেন জানান, আগামী ১ মে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হবে।