শ্রদ্ধাঞ্জলি

একজন মানবাধিকার যোদ্ধার বিদায়

প্রকাশ: এপ্রিল ১১, ২০২১

রোবায়েত ফেরদৌস

সৈয়দ আবুল মকসুদের সঙ্গে আমি অনেক কাজ করেছি। সংখ্যালঘুদের নির্যাতন ইস্যুতে, মানবাধিকার প্রশ্নে তিনি সোচ্চার ছিলেন। পাবনার সাঁথিয়ায় হোক কিংবা রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হোক, যেখানেই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হয়েছে, সেখানেই আমরা যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তার সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেরিয়েছি। আমাদের একটা ম্যান্ডেট ছিল যে সংখ্যালঘুরা কতটা ভালো আছে তা দিয়ে একটা রাষ্ট্রকে মাপা যায়। মনে করা হয়, কোনো রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা ভালো থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠরা অবশ্যই ভালো থাকবে। দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে আমি আর মকসুদ ভাই সবখানে নির্যাতনের শিকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। তাকে দেখে লোকজন আস্থা পেয়েছে। তার পোশাকের মধ্যে একটা গান্ধীবাদী মেজাজ থাকায় মানুষ প্রশান্ত হতো, আস্থা খুঁজে পেত। যেখানে যেতেন, আমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। বলা চলে, কৃষ্ণের সঙ্গে যেমন বলরাম থাকত, তেমনি আমি থাকতাম মকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে। মকসুদ ভাই কৃষ্ণ হলে আমি বলরাম। এমনকি তিনি গান্ধীর জন্মদিন মৃত্যুদিনে যেসব অনুষ্ঠান করতেন, সেখানেও সবসময়ই আমাকে ডাকতেন।

শুধু আদিবাসী কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, অবহেলিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশেও তিনি সবসময়ই দাঁড়িয়েছেন। যেমন বিহারি জনগোষ্ঠীকে আমরা সবসময়ই অবহেলা করি। কিন্তু আমরা মনে করি, বহুদিন পেরিয়ে গেছে। উর্দুভাষী অনেক বিহারির জন্ম বাংলাদেশেই হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে তাদের বাংলাদেশের নাগরিক বলা হয়েছে। কাজেই তাদের আর অবহেলা করা ঠিক নয়। মিরপুরের ক্যাম্পে বেশ কয়েক বছর আগে দশজনকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমি আর মকসুদ ভাই তাত্ক্ষণিকভাবে সেখানে ছুটে গিয়েছিলাম। তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বলা চলে, যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, সেখানেই আমরা যুগলবন্দি হয়ে থাকার চেষ্টা করেছি। ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানিয়েছি, জনমত গঠনের চেষ্টা করেছি। সবসময় তা- করেছি। তাকে মানবাধিকার সুরক্ষার এক নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবেই দেখি।

মকসুদ ভাই খুব সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। তার সরলতা আমাকে খুব মুগ্ধ করত। আমি তার বাসায়ও নিয়মিত যেতাম। তিনি যেহেতু মাছ-মাংস সেই অর্থে খান না, তিনি ওটস খেতেন। যতবার বাসায় গেছি, আমি তার জন্য ওটস নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। মাঝেমধ্যে মজাও করতাম। গত বছর পেঁয়াজের দাম ২০০-২৫০ টাকায় উন্নীত হয়েছিল। ভারত যখন রফতানি বন্ধ করে দিয়েছিল তখন মজা করার জন্য তার বাসার পাশের দোকান থেকে দুই কেজি পেঁয়াজও নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি খুব অস্বস্তি বোধ করতেন। তিনি বলতেন, কেন এসব নিয়ে আসেন? আমি বলতাম, আপনাকে ভালো লাগে, ভালোবাসি। সেজন্য এসব নিয়ে আসি। একবার মনে আছে, ঈদের সময়। ভাবলাম, তাকে উপহার দেব। তিনি তো সাদা কাফনের কাপড় পরে থাকেন। দিলে তা- দিতে হবে। আমি নিউমার্কেটে গেলাম আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে। মকসুদ ভাইকে ফোন দিলাম। তাকে বললাম, কাপড়ের মাপ জানাতে। তিনি বললেন, কিছু্ই নিতে হবে না, আমার কাপড় লাগবে না। অনেক অনুরোধ করার পর অবশ্য মাপটা দিলেন। কাপড় কিনে আমি তাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম। আরেকটা স্মৃতি মনে পড়ে। আমার মা-বাবা, ভাই-বোন পরিবারের সবাই মিলে আরিচা রোডের পাশের একটা জায়গায় যাব, সেটি মকসুদ ভাইয়ের বাড়ির পাশে। কাজেই আমি মকসুদ ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। আমার ভাগনিও আমার সঙ্গে ছিল। তার সেদিন জন্মদিন ছিল। জন্মদিনে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে, কেক কাটা হচ্ছে। সন্ধ্যার সময় দেখলাম যে মকসুদ ভাই বাইরে চলে গিয়েছিলেন। এক ঘণ্টা পর এলেন। দেখলাম যে একটা কবিতা লিখে নিয়ে এলেন। তিনি কবিতাটি পাঠ করে শোনালেন। ভাগনির হাতে দিলেন। সে কবিতাটি বাঁধাই করে রাখলেন। এই যে আনন্দময় এক স্মৃতি, এখনো মনে পড়ে। যখন তিনি মারা গেলেন, আমি তা আম্মার সঙ্গে শেয়ার করলাম, ভাগনি সঙ্গে শেয়ার করলাম। শুধু কাজের সূত্রে নয়, পারিবারিকভাবেও আমাদের একটা গাঢ় বন্ধন ছিল।   

মকসুদ ভাইয়ের জীবন ছিল ৯টা-৫টা চাকরির মতো। আসলে তিনি তো চাকরি করতেন না। তাহলে কী করতেন? সকালে হয়তো বিহারিদের ক্যাম্পে, বিকেলে হয়তো গান্ধী আশ্রম নিয়ে কাজ করছেন, আবার সন্ধ্যায় হয়তো জাদুঘরে কোনো একটা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছেন। মনে হবে ২৪ ঘণ্টাই যেন লোকটি মানবাধিকার নিয়ে, মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করছেন। যাদের ভয়েস নেই, তাদের ভয়েস হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি। তরুণদের তিনি দারুণ ভালোবাসতেন। যে কারণে তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। আমার চেয়ে যারা বয়সে তরুণ, তাদেরও তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন। তাদের উৎসাহ দিতেন। এমবিবিএসে যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, তখন তিনি ছাত্রদের অধিকারের জন্য তাদের পাশেও গেছেন। তার খাওয়াদাওয়া, পোশাকে যে সরলতা, সেটি আমার মনে হয় মানুষকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত।

মকসুদ ভাই একটি গল্প করেছিলেন। তিনি একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। এয়ারপোর্টে নামার পরে ভারতীয় এক দম্পতি এসে তাকে প্রণাম করেছিলেন। ভেবেছিলেন সাধু-সন্ত কিংবা ঋষি কেউ হয়তো এসেছিলেন। দারুণ রসবোধ ছিল তার মধ্যে। তিনি মজার মজার জোকস বলতেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিল কলকাতায় যাব, একটু থাইল্যান্ড বেড়াতে যাব। সে জায়গাগুলোয় আর যাওয়া হয়নি। ভাবী, ছেলেমেয়েসহ পুরো পরিবারই বেশ অমায়িক। আয় হয়তো তেমন নেই কিন্তু আপ্যায়ন না করে কাউকে ছাড়তেন না। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে যখন লিখলেন, তিনি তখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। তাকে বলা হলো, ধরনের কিছু লেখা যাবে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করলেন। তার ভাষায়, কোপ খাইলেন হুমায়ুন আজাদ, পদত্যাগ করলাম আমি। তিনি আঞ্চলিক বাংলা মেশানো ভাষায় বক্তৃতা দিতেন। তার লেখা যেমন খুব শক্তিশালী, অন্যদিকে তার বক্তৃতা আবার বেশ গীতল। হুমায়ুন আজাদ বাংলা বিভাগে তার সহপাঠী ছিলেন। তাকে মারার কারণে তিনি চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন। রকম অনেক নজির আছে তার জীবনে।

মকসুদ ভাই বাংলাদেশের দরিদ্র, প্রান্তিক, যাদের কোনো ভয়েস নেই, তাদের কণ্ঠস্বর ছিলেন। তার জীবন থেকে এটিই আমাদের জন্য শিক্ষা। আমাদের কাজ হলো তার কাজকে এগিয়ে দেয়া। খুব বিস্ময়ের বিষয় হলো, মকসুদ ভাইয়ের মৃত্যুর খবর জানাতে তার ছেলে যখন ফোন দিচ্ছে, তখনও আমি মকসুদ ভাইয়ের দেখানো পথে প্রান্তিক মানুষের অধিকার রক্ষায় একটি প্রেস কনফারেন্স করছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি চাকমা মেয়েকে অপহরণ করা হলো, ধর্মান্তরিত করা হলো এবং শেষ পর্যন্ত তাকে মেরেই ফেলা হলো। মরদেহ ২৪ দিন হিমঘরে ছিল। টেকনাফের দক্ষিণ হ্নীলা বৌদ্ধ মন্দির মোহাম্মদ আলী আওয়ামী লীগের এক সাবেক এমপির লোকজন দখল করে রেখেছিল। তার প্রতিবাদে আমি কক্সবাজারে গেছি। আমাদের ১৫ জনের একটা দল ছিল। আমরা ডিসি, এসপি, র্যাবের সঙ্গে দেখা করে একটা প্রেস কনফারেন্সে বসেছিলাম। যে কাজগুলো মকসুদ ভাই করতেন, আমার মনে হয়, সেই কাজটি কীভাবে এগিয়ে নেয়া যায়, সেটিই ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে রিলের বিষয়টি আনা যায়। একজন দৌড় দেয়, আরেকজন রিলে করে তাকে এগিয়ে নেয়। আমাদের তা- করতে হবে, যা তিনি সারা জীবন করেছেন বা করতে চেয়েছেন। জীবন যেন এক রিলে রেস।

বাবার মৃত্যুর সংবাদ দেয়ার জন্য তার ছেলে যখন ফোন দিয়েছিল, তখন আমি প্রেস কনফারেন্সে ছিলাম। আমরা বৌদ্ধ মন্দির দখলের প্রতিবাদ করছি, মরদেহ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ করছি। এটা খুব ইন্টারেস্টিং। মকসুদ ভাই প্রান্তিক মানুষ, গরিব মানুষ, জাতিগত-ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং আদিবাসীদের ব্যাপারে একেবারে আপসহীন ছিলেন। তার প্রতি আদিবাসী সংখ্যালঘুদের একটা বিশ্বাসের জায়গা ছিল। তারা কিন্তু সহজেই কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ আমরা বাঙালিগোষ্ঠীই তো তাদের নির্যাতন করি। কাজের মধ্য দিয়ে মকসুদ ভাইয়ের প্রতি তাদের একটা বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়েছিল। নির্যাতিত মানুষের মনে মকসুদ ভাই একটা জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন। আদিবাসী, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানরা তাকে বিশ্বাস করত। তারা মনে করত এর ওপর নির্ভর করা যায়। বিশ্বাসের ধারাবাহিকতায় আমাদের একটু একটু বিশ্বাস করা শুরু করল।

আমরা ভেবেছিলাম মকসুদ ভাইকে আরো ২০ বছর পাব। মানবাধিকারের কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক, বৈষম্যমুক্ত এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন বাংলাদেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছেন, মকসুদ ভাই দেখেছেন এবং আমরা দেখেছি, এটি এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। কাজটি আমাদের শেষ করতে হবে। আমাদের কাজ হলো তার অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, টেনে নিয়ে যাওয়া। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করি।

তার মূল কাজ হলো, যেখানে সংখ্যালঘু নির্যাতিত হচ্ছে, আদিবাসীরা আক্রান্ত হচ্ছে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় উপসনালয় বেদখল হয়েছে, তাদের জমি দখল হচ্ছে, বাড়িতে আগুন লাগানো হচ্ছে, তারা মিথ্যা মামলার শিকার হচ্ছে কিংবা তাদের মেয়ে ধর্ষণ হচ্ছে, সেখানেই ছুটে যাওয়া। পাশাপাশি গবেষণা করা। গবেষণার জায়গা থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস লিখেছেন, প্রথম উপাচার্যকে নিয়ে বই লিখেছেন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ইতিহাস লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক চিন্তা নিয়ে বই লিখেছেন। একাধারে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন আবার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। সব মিলিয়ে তিনি খুব ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। সারাক্ষণ মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতেন, লিখতেন। সেই দিক থেকে তার জীবন সবার জন্য অনুসরণীয়। 

গীতার একটি শ্লোক আছে। সেটি হলো, হন্যতে হন্যমানে শরীর। তার মানে হলো, শরীরের পতন হয় কিন্তু মানুষের যে চেতনা, স্পিরিট, তার কোনো মৃত্যু নেই। কাজেই মকসুদ ভাইয়ের শরীরের যে অবয়ব, তা হয়তো নাই হয়ে গেছে, কবরে শায়িত আছেন তিনি, তবে তার যে স্পিরিট বা চেতনা, তা কোনো দিনই মুছে যাওয়ার নয়। ভুলে যাওয়ার নয়। তিনি এরই মধ্যে আমাদের মতো তরুণদের মধ্যে তা সংক্রমিত করতে পেরেছেন। তার রিলে পতাকাটা আমরা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব। এটিই মনে হয় মকসুদ ভাইয়ের প্রতি সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধা সম্মান জানানো হবে।

 

রোবায়েত ফেরদৌস: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ

সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫