অপ্রতুলতা নিয়েই চলছে চট্টগ্রামের করোনা চিকিৎসাসেবা

প্রকাশ: এপ্রিল ০৯, ২০২১

রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম। নগরীর জনসংখ্যা আনুমানিক ৭০-৮০ লাখ। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীও বলা হয় একে। সে হিসেবে শহরটির চিকিৎসা ব্যবস্থা যেমন হওয়ার কথা ছিল, তার প্রায় কিছুই পায়নি বন্দরনগরীর মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যসেবার মান যে কতটা নাজুক, তা দৃশ্যমান হয়েছে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার পর।

নগরীর হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা গেছে, তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে যাওয়া রোগীকে দেয়া যাচ্ছে না নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ডায়ালাইসিস প্রয়োজন এমন কেউ কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হলে তার জন্য পরিস্থিতি জটিল হয়ে যাচ্ছে। রয়েছে ভেন্টিলেটর, হাই ফ্লো অক্সিজেন লাইন, অক্সিজেন মাস্ক ক্যানুলাসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব। কভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগেরই নেই কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা। সক্ষমতা না থাকায় ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে অনেক রোগীকে। চিকিৎসাসেবা পেতে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে তার স্বজনদের ঘুরতে হচ্ছে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক রোগীর মৃত্যুও ঘটছে।

গতকাল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছয়জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়। নিয়ে জেলায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৪০৬। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৪৭৩ জন রোগী শনাক্তসহ মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪৩ হাজার ১৮৮। তবে এর বাইরে কত রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

সারা বিশ্বেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সে অনুযায়ী চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মাহফুজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে আসলে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই, তদারকিও নেই। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে আমরা চট্টগ্রামের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়েছি। বরাদ্দ পেলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১০ শতাংশ হারে আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর কথা বলেছি। কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে উপজেলাগুলোতে ১০টি করে আইসিইউ বেড স্থাপন করা গেলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকায় বিদ্যমান অবকাঠামোও সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, বিদ্যমান অবকাঠামোও যদি আন্তরিকতা আর দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা যায়, তাহলেও পরিস্থিতি অনেকটা সামাল দেয়া সম্ভব।

চট্টগ্রামের কভিড-১৯ রোগীদের জন্য প্রথম যে হাসপাতালটি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, সেটি হলো জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতালটিতে কভিড-১৯ রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ১৪০টি। এতদিন সেখানে ১০টি আইসিইউ শয্যা ছিল, যার নয়টিতেই গতকাল দুপুর পর্যন্ত রোগী ভর্তি ছিলেন। রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় গতকাল আরো আটটি আইসিইউ শয্যা উদ্বোধন করা হয়। সব মিলিয়ে বিশেষায়িত হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা দাঁড়াল ১৮। যদিও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত হওয়ায় একই সময়ে সর্বোচ্চ ১০-১২ জনের বেশি রোগীকে সেবা দেয়া যাবে না।

জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ফোকাল পারসন ডা. মো. আব্দুর রব বণিক বার্তাকে বলেন, দফায় আক্রান্তের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউ সেবা প্রয়োজন এমন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতিদিন অন্তত ১০ জন রোগীর জন্য আইসিইউ সেবার ব্যবস্থা চেয়ে অনুরোধ আসছে। কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে বেশির ভাগকেই স্থান দিতে পারি না। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল আটটি আইসিইউ শয্যা বাড়ানো হয়েছে।

জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় ২০০ রোগীকে সেবা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১০টি, যা বেশির ভাগ সময়ই পূর্ণ থাকে। চমেক হাসপাতালে রোগীর চাপের তুলনায় শয্যা সংখ্যা খুবই কম বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে কভিড-১৯ রোগীদের জন্য ২০০ শয্যা থাকলেও প্রয়োজন পড়লে তারা একসঙ্গে ২৫০ জনকে চিকিৎসা দিতে পারবেন বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ন কবীর। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এটা ঠিক যে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা অপ্রতুল। ১০ শয্যাই গতকাল দুপুর পর্যন্ত পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু আপাতত সেবার পরিধি বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালের শয্যার সংখ্যা ৩২ থেকে বাড়িয়ে ৩৫টি করা হয়েছে। তবে হাসপাতালে কোনো আইসিইউ শয্যা নেই। বিআইটিআইডির পরিচালক ডা. এমএ হাসান চৌধুরী বণিক বার্তাকে জানান, তাদের হাসপাতালে আইসিইউ না থাকলেও হাইফ্লো অক্সিজেন সেবা দেয়া হয়। শিগগিরই কভিড-১৯ রোগীদের জন্য পাঁচটি আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হবে।

সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি চট্টগ্রামের বেশকিছু বেসরকারি হাসপাতালেও দেয়া হচ্ছে কভিড-১৯ রোগের চিকিৎসা। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে মোট ২১টি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বিশেষায়িত চট্টগ্রাম মা শিশু জেনারেল হাসপাতালে ৯২টি কভিড ডেডিকেটেড শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি আইসিইউ এইচডিইউ শয্যা। চাপ বেড়ে যাওয়ায় অতিরিক্ত শয্যা ব্যবহার করে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক তালুকদার জিয়াউর রহমান শরিফ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে মোট আইসিইউ শয্যা ১০টি। গতকাল পর্যন্ত নয়টিতেই কভিড-১৯ রোগী ভর্তি ছিল। একটি শয্যা আলাদা রাখা হয়েছে হাসপাতালে ভর্তি থাকা অন্য রোগে আক্রান্তদের জন্য। কারণ আইসিইউ খালি না থাকায় গতকালই হাসপাতালের একজন রোগীকে বাধ্য হয়ে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে আরো একটি হাসপাতালকে কভিড-১৯ রোগের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. আসিফ খান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সংক্রমণের হার বাড়তে থাকায় খুলশী এলাকার বন্ধ থাকা হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ইউনিট- হিসেবে কাজ করবে। সেখানে কেবল কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেয়া হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫