পর্যালোচনা

নারী উদ্যোক্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই ঋণ সুবিধা

প্রকাশ: মার্চ ১৪, ২০২১

রুশিদান ইসলাম রহমান

নারীর ক্ষমতায়নের তাত্ত্বিক দিকের পর্যালোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে নারীর ক্ষমতায়ন অর্থ নারী-পুরুষের কার্যকর সক্ষমতার বিষয়ে ক্ষমতার দিকে অগ্রসর হওয়া। অমর্ত্য সেনের বিভিন্ন গবেষণা গ্রন্থের ভিত্তিতে বলা যায় যে নারীর ক্ষমতায়নের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সম্পদ, শক্তি এবং সে যা করতে চায় বা হতে চায় সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার স্বাধীনতা। এগুলো অর্জনের একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, যার অর্থ হচ্ছে উৎপাদন তা থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সম্পদ, শক্তি প্রেরণা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক অর্জিত হবে। কাজেই বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা যায়।

বাংলাদেশে এসব দিকে অগ্রগতি হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে পর্যালোচনা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নারী-পুরুষ সমতার বিষয়টি নির্ভর করবে তাদের উপার্জন কাজে নিয়োগের উদ্যোক্তা হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুযোগের ওপর। পরবর্তী আলোচনায় প্রধানত বিশ্লেষণ করা হবে নারী উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি। তবে সে তথ্য বিশ্লেষণের আগে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ শিক্ষায় অগ্রগতির কিছু দিক উল্লেখ করা হচ্ছে।

শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে গত কয়েক দশকে। কর্ম নিয়োজনে নারীর অংশ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। মোট কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পোশাক শিল্পের মতো শ্রমনিবিড় রফতানি খাতে নারী শ্রমিকের চাহিদাও এক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। কিছু আধুনিক খাত, যেমন আর্থিক সেবা বীমা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা উৎপাদন শিল্প খাতের তথ্য থেকে দেখা যায় মোট কর্মনিয়োজনে নারীর অংশ বেড়েছে।

গত ১০ বছরে নারী-পুরুষের মজুরিবৈষম্য হ্রাস পেয়েছে। এসব সাফল্যের দিকের সঙ্গে সঙ্গে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এখনো শ্রমবাজারে নারীর অবস্থানে যথেষ্ট দুর্বল দিক রয়েছে। নারীর কর্মসংস্থানের ৬০ শতাংশই হচ্ছে কৃষি খাতে এবং তার অধিকাংশই অবৈতনিক পারিবারিক কর্মী হিসেবে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক খাতে নারীর মোট কর্মনিয়োজনের অংশ বাড়েনি। পুরুষ শ্রমশক্তির ক্ষেত্রে পরিবর্তন দৃশ্যমান।


শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। অগ্রগতি প্রাথমিক মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি হারে নারী-পুরুষ সমতায় প্রতিফলিত হয়েছে।

উচ্চশিক্ষার পর্যায়েও অগ্রগতি হয়েছে, তবে এখনো নারী-পুরুষ পার্থক্য যথেষ্ট। ১৫ বছরের বেশি বয়সী নারীর ক্ষেত্রে শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় বিবাহিতাদের ক্ষেত্রে। পরিবারের আর্থিক সক্ষমতার একটি ইতিবাচক প্রভাব থাকে ক্ষেত্রে, যা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অসাম্য বাড়ায়।

সম্পদের ওপর নারীর অধিকার বেশ সীমিত। বিশেষত জমির (বা কৃষিজমিতে) মালিকানার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর অনুপাত অনেক কম।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ: নারী-পুরুষের পার্থক্য

দেশে ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগ বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। তদুপরি, সুষম উন্নয়ন সব ধরনের জনগোষ্ঠীতে এবং এলাকায় উন্নয়ন প্রবাহ প্রসারের ক্ষেত্রে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোগের ভূমিকাও স্বীকৃত। গুরুত্ব অনুধাবন করে এসব উদ্যোগে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই ঋণ সুবিধা চালু করেছে (বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০) সুবিধার আওতায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের শর্তাবলি সহজ করা হয়েছে। এখানে নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ঋণের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে তার আগে নারী ঋণগ্রহীতার ক্ষেত্রে কীভাবে শর্তগুলো সহজ করা হয়েছে সেটার একটু বর্ণনা থাকলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে।

২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (এসএমই) ক্রেডিট পলিসিজ অ্যান্ড প্রোগ্রামস প্রকাশ করে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয় সেগুলোর কিছু অংশ (অনুবাদ) নিচে উদ্ধৃত করা হলো: (নীতিমালার পৃ. থেকে):

. সমভাবে শিল্পায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্স প্রোগ্রামের আওতায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অন্তত ১৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকবে।

. নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে ঋণের সুদহার হবে শতকরা ১০ বা তার নিচে।

. ঋণ মঞ্জুরের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা নিজে বা যদি বেশির ভাগ উদ্যোক্তা নারী হন তবে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য শুধু ব্যক্তি জামানত হলেই চলবে, অন্য জামানত প্রয়োজন হবে না।

. ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু শাখায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ পরামর্শ সেবা প্রদান কেন্দ্র স্থাপন করবে এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক সেবা প্রদান নিশ্চিত করবে।

. ঋণ পাওয়ার উপযোগী প্রকৃত নারী উদ্যোক্তা শনাক্তকরণের জন্য ব্যাংকের শাখাগুলো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেবে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে বিএসসিআইসি, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিডব্লিউসিসিআই) নারী উদ্যোক্তাদের অন্যান্য সংগঠন।

নীতিমালার এসব বিশেষ ব্যবস্থা নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সুপ্রভাব রাখবে আশা করা যায়। তবে প্রকৃত ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরের ধারা পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে যে এক্ষেত্রে কতটা অগ্রগতি হয়েছে। সেসব তথ্য সারণিতে দেখানো হয়েছে।

২০১০ থেকে ২০২০ সালের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে মোট এসএমই ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে নারীর অংশ বাড়ছে, যা কিছুটা উৎসাহব্যঞ্জক। ২০১০ সালে অংশ ছিল শতকরা ., ২০১৪ থেকে অংশ বেড়েছে, ২০১৮-তে হয়েছে শতকরা  .৪। ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে তা শতকরা ১৩. হয়েছে, যদিও আশঙ্কা রয়েছে যে বছরের পরের নয় মাসে অংশ কভিড-১৯ মহামারীর কারণে আর না- বাড়তে পারে।

এখন দেখা যাক ঋণের মোট কত অংশ নারী উদ্যোক্তারা পেয়েছেন। মোট ঋণের মাত্র - শতাংশ তারা পেয়েছেন এবং পুরো সময়কালে এটা বাড়ার কোনো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না। অনুপাত সর্বনিম্ন ছিল ২০১৭-তে (. শতাংশ) আর সর্বোচ্চ ছিল (. শতাংশ), ২০১৪ সালে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল ১৫ শতাংশ ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য, তা এখনো সুদূরের বিষয় হয়ে রয়েছে।

মোট ঋণগ্রহীতায় নারীর অংশ বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও মোট ঋণে তাদের অংশ হ্রাস পাওয়া বা স্থবির থাকার অর্থ হচ্ছে যে গড়ে ঋণের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ২০১০ সালে নারী উদ্যোক্তাদের গড় ঋণ গ্রহণ ছিল ১৩ লাখ টাকা। তার পর থেকেই তা নিম্নগামী হয়ে ১০ লাখের নিচে নেমে আসে। অন্যদিকে পুরুষ ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ গড়ে ১৭ লাখ থেকে বেড়ে ২৪ লাখ পর্যন্ত উঠেছে। প্রবণতা নারী-পুরুষ বৈষম্যেরই প্রতিফলন। বড় ঋণের ক্ষেত্রে জামানত দেয়ার সমস্যাই এর একটি মূল কারণ।

সে সঙ্গে আরো দুটি সমস্যার উল্লেখ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়ক নীতিমালা গ্রহণ করলেও এটির পরিবীক্ষণের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কাজেই এসব নীতি বাস্তবায়নের গতি সাফল্য নির্ভর করবে যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই নতুন পদক্ষেপ নেয়ার জন্য যে ধরনের সচেতনতা পরিবেশ প্রয়োজন তার অভাব রয়েছে। নারী উদ্যোক্তারা সমাজে অনেক ইতিবাচক অবদান রাখতে পারেন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে। তারা যে অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনতে পারেন সেটা প্রচলিত ধ্যান-ধারণা থেকে পৃথক।

প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ধ্যান-ধারণার কারণে অনেক সময় নারী উদ্যোক্তারাও ঋণ গ্রহণ এবং ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে নিরুৎসাহিত বোধ করেন। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার অভাব, বাস্তব ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা এসে দাঁড়ায় তাদের ব্যবসা পরিচালনা প্রসারের পথে।

তাছাড়া এসব ছোট অংকের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সময় অন্যান্য ব্যয়ের তুলনায় তাত্ক্ষণিক লাভের দিকটি কম। দূরদৃষ্টি থাকলে এটা অনুধাবন করা সম্ভব যে দীর্ঘ মধ্যমেয়াদে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা এবং তাদের ঋণের চাহিদা অনেক বাড়বে। তারাই হতে পারে ব্যাংক আর্থিক খাতের অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতার একটি বড় অংশ। কাজেই শুরু থেকে যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে থাকবে সেগুলোর জন্য এটি একটি বড় সুযোগ হতে পারে।

সবশেষে এটি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নারীর কর্মনিয়োজন, উপার্জন এসব কিছু তার ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজন। তবে এগুলো কিন্তু সবক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে না। এগুলোর মাধ্যমে ক্ষমতায়ন হতে হলে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা স্বাধীনতা প্রয়োজন। বিভিন্ন গবেষণা জরিপলব্ধ তথ্য থেকে দেখা গিয়েছে যে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা এখনো অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত। একটি আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে যে নারীর শিক্ষার্জনের ফলে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা প্রসারিত হয়। তবে এটা ঘটে যখন নারীর শিক্ষাস্তর মাধ্যমিকের চেয়ে বেশি হয়। সুতরাং নারীর সামগ্রিক অবস্থান উন্নয়ন ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজন সবদিকে সুসমন্বিত প্রয়াস।

 

রুশিদান ইসলাম রহমান: অর্থনীতিবিদ; বর্তমানে সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের (সিডার) এক্সিকিউটিভ চেয়ারপারসন


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫