সাবমেরিন কেবল নিয়ে নতুন দ্বৈরথে বেইজিং-ওয়াশিংটন

প্রকাশ: মার্চ ০৬, ২০২১

বণিক বার্তা ডেস্ক

ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে সুদীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই বাস্তবায়নের পাশাপাশি ডিজিটাল যোগাযোগের অবকাঠামোও নির্মাণ করছে দেশটি। যার অংশ হিসেবে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে ইউরোপকে সংযুক্ত করার প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা। পিস কেবল নামে চীনের প্রকল্পটি চিরবৈরী ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের মধ্যে দ্বৈরথ আরো বাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। খবর ব্লুমবার্গ।

আগামী বছরেই চালু হতে যাচ্ছে চীনের হাজার ৫০০ মাইলের সুদীর্ঘ সাবমেরিন কেবল। এটি প্রথমে চীন থেকে যাত্রা শুরু করে পাকিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ফাইবার অপটিকের মাধ্যমে সংযুক্ত হবে। যেটিকে ডিজিটাল সিল্ক রুট হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এরপর রাওয়ালপিন্ডি, বন্দরনগরী করাচি গোয়াদর হয়ে এটি সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে ফ্রান্সের মার্সেই গিয়ে শেষ হবে। করাচি থেকে আরব সাগর হয়ে এটি হর্ন অব আফ্রিকার অঞ্চলকেও সংযুক্ত করবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিনের মাধ্যমে সংযুক্ত হওয়ায় প্রকল্পকে পাকিস্তান ইস্ট আফ্রিকা কানেক্টিং ইউরোপ বা পিস বলা হচ্ছে।

অন্যদিকে বৈশ্বিক ডিজিটাল অবকাঠামোয় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চীন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চীন এক্ষেত্রে প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়েকে নিয়ে সেই আকাঙ্ক্ষার অনেকখানিই বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। পাকিস্তান অংশের নির্মাণকাজেও হুয়াওয়ে ২৪ কোটি ডলারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আর সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে পিস কেবল নির্মাণ করছে চীনের হেংটং অপটিক ইলেকট্রিক কোম্পানি। সাবমেরিনটি এতটাই শক্তিসম্পন্ন হবে যে, নেটফ্লিক্সের ৯০ হাজার ঘণ্টার ডাটা এটি এক সেকেন্ডে পৌঁছে দিতে পারবে। এর ফলে চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য ইউরোপ আমেরিকায় তাদের ব্যবসাকে আরো মজবুত করবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।

ফ্রান্সের বহুজাতীয় টেলিকম প্রতিষ্ঠান অরেঞ্জ এসএর হেড অব ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্কস জ্যঁ লুক ভুইমি বলেন, ইউরোপ আফ্রিকার প্রযুক্তি খাতে চীন নিজেদের শক্তিশালী করার জন্যই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মূলত কোম্পানিটি ফ্রান্সের মার্সেইর ল্যান্ডিং স্টেশনটি পরিচালনা করবে।

বাণিজ্যযুদ্ধকে কেন্দ্র করে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলমান রয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক শীতল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা হচ্ছিল। যদিও পিস কেবলকে কেন্দ্র করে দেশ দুটির মধ্যে বিবাদ আরো বাড়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। আগামী বছরে চালু হওয়া সাবমেরিন কেবলটি বৈশ্বিক প্রযুক্তি জগতে চীনের অবস্থান আরো শক্ত করবে এমন আশঙ্কা এখন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর জেঁকে বসেছে। কারণ প্রকল্পের মাধ্যমে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে দেশ দুটির মধ্যে আবারো উত্তেজনার রসদ জোগাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

চীনা প্রযুক্তি বিশেষ করে হুয়াওয়ের উৎপাদিত প্রযুক্তির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকেই একাট্টা। দেশটি মনে করে হুয়াওয়ে প্রযুক্তি পণ্যের আড়ালে চীন সরকারের হয়ে কাজ করে থাকে, আর কারণেই হুয়াওয়েকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যা দিয়ে কোম্পানিটিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকি মিত্র দেশগুলোতেও হুয়াওয়ের ব্যবসার ক্ষেত্রে সবধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে যুক্ত ছিল হোয়াইট হাউজ।

আর এখন চীনের পিস কেবল নির্মাণের সঙ্গে হুয়াওয়ের সংশ্লিষ্টরা রয়েছে। নির্মাণে যুক্ত চীনা কোম্পানি হেংটং অপটিক ইলেকট্রিকের তৃতীয় বৃহত্তর শেয়ারহোল্ডার জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে পিস কেবলের ল্যান্ডিং স্টেশন সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যাওয়া ট্রান্সমিশন গিয়ার নির্মাণের সরঞ্জামাদিও সরবরাহ করবে হুয়াওয়ে। ফলে চীনের নতুন উদ্যোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোর বিরোধিতা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এমন উদ্বেগের পেছনে আরো গুরুতর কারণ রয়েছে। এর অন্যতম হলো বাণিজ্যিক কৌশলগত। বর্তমানে বৈশ্বিক ইন্টারনেট টেলিফোন ট্রাফিকের ৯৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে ৪০০টির মতো কোম্পানি। আবার এগুলোর বেশির ভাগের মালিকানা পরিচালনায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি, যা বৈশ্বিক ইন্টারনেট খাতে দেশটির আধিপত্য ধরে রেখেছে। ফলে চীনের এমন উদ্যোগ এসব কোম্পানির আধিপত্যের ভিত ভেঙে দেবে বলে আশঙ্কা করছে তারা। যদিও গুগল ফেসবুকের মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা পিস কেবলের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করবে না। কারণ তাদের এরই মধ্যে পর্যাপ্ত সক্ষমতা রয়েছে। আর যদি তারা কোনো কারণে ব্যবহারও করতে চায়, তাহলে সরকারের কঠোর মনোভাবের কারণে সেই উদ্যোগও মসৃণ হবে না।

যদিও পিস কেবল নিয়ে ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশ এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেবে না বলে সাফ জানিয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, তারা ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে চায় না। এজন্য তারা চীনকে ডিজিটাল অবকাঠামো থেকে কোনোভাবেই দূরে রাখবে না তার দেশ। একই ধরনের কথা বলেছেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলও। তিনিও বলেছেন প্রযুক্তির যুগে তার দেশ কোনোভাবেই চীনের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করবে না। বরং উদ্যোগের শামিল হওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫