মুশতাকের কুমির খামারের মালিক এখন পলাতক পিকে হালদার

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১

জেসমিন মলি

ক্যাডেট কলেজ পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন মুশতাক আহমেদ। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য যান ইংল্যান্ড। প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন তিনি। ২০০২ সালেই স্বপ্ন দেখেছিলেন বন্যপ্রাণী নিয়ে কিছু করার। কুমিরের প্রতি আলাদা আগ্রহ ছিল তার। শেষ পর্যন্ত বাণিজ্যিক খামার কুমির রফতানি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন মুশতাক। পরে সেই খামারের মালিকানা হারান আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের কাছে! কুমির চাষের সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে বইও লিখেছেন তিনি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় দীর্ঘদিন কারাবন্দি মুশতাক আহমেদ বৃহস্পতিবার বন্দিদশাতেই মারা যান। ময়মনসিংহের ভালুকায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার করেন তিনিই। তখনো বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষের ধারণাটি বাংলাদেশে একেবারে নতুন। দেশের আন্তর্জাতিক আইন মেনে ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর যাত্রা করে মুশতাক আহমেদের রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। ভালুকা উপজেলা সদর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে হাতিবেড় গ্রামে ১৩ একর জমিতে খামারটি গড়ে তোলেন তিনি।

জানা যায়, শুরুতে মালয়েশিয়া থেকে ৭৪টি কুমির আমদানি করে মুশতাকের খামারের যাত্রা হয়। ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো দুটি কুমির ৬৯টি ডিম দেয়। তবে মাত্র তিনটি ছানার জন্ম হয়। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের ব্যবধানে মারা যায় সবকটি। কিন্তু মুশতাক আহমেদ তাতে হতাশ হননি। পরের বছরই তার খামারে ৬০০টি ডিম থেকে জন্ম নেয় ১৪১টি কুমিরছানা। বর্তমানে খামারটিতে হাজারের বেশি বিভিন্ন বয়সী কুমির রয়েছে।

যে স্বপ্ন থেকে মুশতাক আহমেদ কুমিরের খামার শুরু করেছিলেন, ২০১০ সালে প্রথম রফতানির দিন থেকেই সেই স্বপ্ন ফিকে হতে থাকে। এক পর্যায়ে প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের কাছে খামারের মালিকানা হারান মুশতাক আহমেদ।

রেপটাইলস ফার্মের বিষয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানার চেষ্টা করেছে বণিক বার্তা। জানা গেছে, খামারটি যখন গঠন করা হয়, তখন ৩৬ শতাংশ শেয়ার ছিল মেজবাহুল হকের, যিনি সম্পর্কে মুশতাক আহমেদের আত্মীয়। ১৫ শতাংশ শেয়ার ছিল মুশতাক আহমেদের। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ প্রকল্পের ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। সে হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শেয়ার ছিল ৪৯ শতাংশ। মেজবাহুল হক মুশতাক আহমেদ ছিলেন উদ্যোক্তা পরিচালক আর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি ব্যাংক কর্মকর্তা প্রিতিশ কুমার সরকার ছিলেন পরিচালক।

যাত্রা শুরুর পর থেকেই প্রকল্পটিতে অর্থ সংকট দেখা দেয়। কারণ ধরনের প্রকল্প থেকে অর্থ উপার্জন কিছুটা সময়সাপেক্ষ। ওই সময় কুমিরের খাবার, বাচ্চা প্রজনন পরিচর্যার কাজে বড় অংকের বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়ে। তবে অর্থের ব্যবস্থাপনা নতুন বিনিয়োগের জোগান নিয়ে ক্রমেই মেজবাহুল হক মুশতাক আহমেদের মধ্যে মতপার্থক্য বাড়তে থাকে। যা বাংলাদেশ ব্যাংক আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

২০১১ সালের জুন-জুলাইয়ের দিকে প্রিতিশ কুমার সরকারের পক্ষ হতে মুশতাক আহমেদকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, তাকে ৩০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের শেয়ার কিনে নেয়ার জন্য টাকা জমা দিতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ শেয়ারের পুরোটাই মেজবাহুল হকের নামে হস্তান্তর করা হবে। সেক্ষেত্রে কোম্পানিতে মেজবাহুল হকের মালিকানা দাঁড়াবে ৮৫ শতাংশে।

তখনই দৃশ্যপটে আসেন প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার। জানা যায়, খামারের পরিচালক প্রিতিশ কুমার সরকারই পিকে হালদারের সঙ্গে মেজবাহুল হক মুশতাক আহমেদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন। ২০১২ সালে মুশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন পিকে হালদার। সে সময় পিকে হালদার ছিলেন রিলায়েন্স সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের এমডি। ওই সময় পিকে হালদার খামারের শেয়ার কিনে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অর্থ সংকটে থাকলেও মুশতাক আহমেদ শুরুতে খামারের মালিকানা ছাড়তে আগ্রহী ছিলেন না।

ওই সময় পিকে হালদার মুশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে জানিয়েছিলেন, কোম্পানির সব শেয়ার কিনে নেয়ার জন্য মেজবাহুল হকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি। কোম্পানিটি কিনে এটিকে পিকে হালদার স্টক মার্কেটে নিয়ে যাবেন। প্রথমে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মুশতাক আহমেদ। কিন্তু পরে নিজের অর্থ সংকটের কারণে একপর্যায়ে শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

ওই সময় তার নামে থাকা শেয়ার লিখে দেয়া হয় ওরিয়েল লিমিটেডের অঙ্গ মোহন রায়ের নামে। মেজবাহুল হকের কাছ থেকে অঙ্গ মোহন রায়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নেন। এর কয়েক বছর পর খামারটির ওয়েবসাইটের তথ্য হালনাগাদ করা হয় ২০১৯ সালের আগস্টে। এতে দেখা যায়, রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন রাজীব সোম নামে এক ব্যক্তি। চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন রাজীব সোমের স্ত্রী শিমু রয়।

এদিকে গত বছরের জানুয়ারি পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে দুদক। মামলার এজাহারে হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা পাচারেরও অভিযোগ আনা হয়। দুদকের তদন্তে উঠে আসে, আটটি কোম্পানিতে নিজের নাম এবং নিকটাত্মীয় কর্মচারীদের নাম ব্যবহার করে ৬৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪৪ হাজার ১৯৯ টাকা বিনিয়োগ করেছেন পিকে হালদার। এসব বিনিয়োগের সপক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো বৈধ আয়ের উৎস দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা খুঁজে পাননি। এর মধ্যে রেপটাইলস ফার্মে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, রাজিব সৌম্য তার স্ত্রী শিমু রায়ের নাম ব্যবহার করে কোটি ৬৯ লাখ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন পিকে হালদার। ওই খামারের জমি জব্দ করতে এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশনা পেয়েছে দুদক।

পিকে হালদারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ময়মনসিংহের ভালুকায় রেপটাইল ফার্ম আশপাশের বেশকিছু জমির দলিল উদ্ধার করা হয়েছে। সেসব জমি জব্দ করার নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।

এদিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী রফতানি না হওয়ায় এরই মধ্যে খামারটিতে কুমিরের সংখ্যা বেড়ে আবাসস্থল খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, ব্যবস্থাপনায় সামান্য ঘাটতি থাকলেও ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা। ফলে খামারটি এখন জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চেয়ে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবু সায়েম মোহাম্মদ আরিফের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫