ভাঙন থেকে জোড়া লাগছে সৌদি আরব-পাকিস্তান সম্পর্ক

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১

বণিক বার্তা ডেস্ক

পরম মিত্র ডোনাল্ড আবু ইভাঙ্কা ট্রাম্পের সময়ে অনেক বিষয়েই ওয়াশিংটনের কাছ থেকে রীতিমতো অন্ধ সমর্থন পেয়েছে রিয়াদ। ট্রাম্প ক্ষমতাহারা হওয়ার পর সৌদি আরব যে নিজ পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ব্ল্যাংক চেক হারাতে যাচ্ছে, সে বিষয়টি এক প্রকার নিশ্চিত ছিল। এর পরও শপথ গ্রহণের পর জো বাইডেনের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত প্রথম ভাষণের ধাক্কাটি রিয়াদের জন্য অনেকটাই আকস্মিক ছিল। ওই ভাষণে জো বাইডেন পরিষ্কার করে দেন ইয়েমেনে সৌদি আরবের যুদ্ধে আর সমর্থন দেবে না ওয়াশিংটন। এছাড়া এতদিন মার্কিন-সৌদি সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি ছিল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল। কিন্তু পণ্যও এখন আর বাইরে থেকে নেয়ার প্রয়োজন নেই ওয়াশিংটনের। নিজস্ব উৎপাদন বাড়াতে বাড়াতে নিজের ওপরই পণ্যটির অতিরিক্ত সরবরাহ চাপ তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

অন্যদিকে মুসলিম উম্মাহর অবিসংবাদিত নেতৃত্বদানকারী হিসেবে নিজের যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছিল সৌদি আরব, সেটিকেও চ্যালেঞ্জ করে বসেছে তুরস্ক। তাতে আবার যুক্ত হয়েছে কাতার ইরানের মতো বৈরী দেশগুলো। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আগেই সঙিন করে তুলেছিলেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এর প্রতিক্রিয়ায় তুরস্ক, কাতার, ইরান, মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশ এখন ওআইসির পাল্টা জোট সংগঠন দাঁড় করানোর কথা ভাবতে শুরু করে। রিয়াদের আশঙ্কা ছিল, অন্যান্য মুসলিম দেশের সঙ্গে সুর মিলিয়ে পাকিস্তানও জোটে যোগ দিতে পারে। ইসলামাবাদকে থেকে বিরত রাখতেই চাপে রাখার কৌশল নিয়েছিল সৌদি আরব।

ভূ-রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি রিয়াদকে এখন হঠাৎ করেই চাপে ফেলে দিয়েছে। অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে মরচে ধরা পুরনো কূটনৈতিক সম্পর্কগুলোকে আবারো ঝালাই করে নেয়া ছাড়া আর কোনো পথ দেখতে পাচ্ছে না সৌদি আরব। কারণেই এখন পাকিস্তানের প্রতি সুর নরম করে এনেছে দেশটি।

পাকিস্তান সৌদি আরবের মধ্যে কয়েক দশক ধরে অত্যন্ত সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু সৌদি আরবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারগুলো বদলে যেতে থাকে। ইসলামাবাদ বিষয়টি অনুধাবন করেছে বেশ তিক্তভাবে। ২০১৮ সালে পাকিস্তান মারাত্মক ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বৈদেশিক লেনদেনে চলতি হিসাবের ভারসাম্য) সংকটে পড়ে গেলে সৌদি আরব ৩০০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তার অঙ্গীকার করে। যদিও পরে অঙ্গীকারের ২০০ কোটি ডলার প্রত্যাহার করে নেয় রিয়াদ। এছাড়া স্থগিত করে দেয়া হয় জ্বালানি তেল খাতে প্রতিশ্রুত ৩২০ কোটি ডলারের আরেকটি অর্থায়ন প্রস্তাব।

তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হাওয়া উল্টোদিকে বইতে শুরু করার পর পাকিস্তানের প্রতি আবারো মনোযোগী হয়ে ওঠে রিয়াদ। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে অঙ্গীকারকৃত সহায়তার বাকি ১০০ কোটি ডলারের ঋণ বাতিল করা থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেকে বিরত রাখে সৌদি আরব। গত মাসেই ১০০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে রিয়াদ। এছাড়া দেশটি জ্বালানি তেল খাতে স্থগিত করে দেয়া অর্থায়নের পুরনো প্রতিশ্রুতিতে ফিরে আসবে বলেও প্রত্যাশা করছে পাকিস্তান।

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রিয়াদ মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের মিত্র দেশগুলো এখন পাকিস্তানকে যেকোনোভাবে হোক হাতে রাখতে চাইছে। জানুয়ারিতে সৌদি আরব সংযুক্ত আরব আমিরাতকে (ইউএই) ২০০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ করার কথা ছিল পাকিস্তানের। তবে শেষ পর্যন্ত উভয় দেশই অর্থ পরিশোধের সময় পিছিয়ে দিয়েছে।

রিয়াদের পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করতে চাওয়ার উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির আকস্মিক পরিবর্তন সৌদি আরবকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। দীর্ঘদিনের শক্তিধর মিত্রের ছত্রচ্ছায়া হারিয়ে মুহূর্তে আরেক শক্তিধর দেশ চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক করতে চাইছে সৌদি রাজপরিবার। প্রকৃতপক্ষে এটিই এখন রিয়াদের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ। রিয়াদ চাইছে, চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের সুসম্পর্ক তৈরিতে সেতুবন্ধের কাজটি পাকিস্তান করুক।

রিয়াদের চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়ন করতে চাওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো সৌদি আরবের পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠার স্বপ্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র তেলআবিব শুরু থেকেই সৌদি আরবের পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তোলার বিপক্ষে। কারণে রিয়াদের স্বপ্নপূরণের পথে এখন সহায়ক হতে পারে একমাত্র চীন। অন্যদিকে মোহাম্মদ বিন সালমানও ঘোষণা দিয়েছেন, ইরান যদি পরমাণু কর্মসূচি প্রত্যাহার না করে তবে তিনি যেভাবেই হোক সৌদি আরবকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ বানিয়ে ছাড়বেন।

এছাড়া চীন এখন বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল আমদানিকারক। অন্যদিকে পণ্যটি রফতানিতে সৌদি আরবের বাজার এখন সংকুচিত হয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের হাবভাবেও পরিষ্কার, দেশটির মুহূর্তে সৌদি তেলের কোনো প্রয়োজন নেই। অবস্থায় চীনের জ্বালানি তেলের বাজার ধরতে পারাটা এখন রিয়াদের জন্য খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। এছাড়া মোহাম্মদ বিন সালমানের ভিশন ২০৩০ অনুযায়ী সৌদি আরবের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার লক্ষ্য রয়েছে সৌদি সরকারের। কারণে মুহূর্তে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলাটাকেই দেখা হচ্ছে সৌদি আরবের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ হিসেবে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধের ভাষ্যমতে, মুহূর্তে রিয়াদের বেইজিংয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পথ করে দিতে পারে একমাত্র ইসলামাবাদ। এতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। চীন বর্তমানে কৌশলগত চুক্তির ভিত্তিতে ইরানের কাছ থেকে জ্বালানি তেল ক্রয় করছে। পাকিস্তানের পৌরোহিত্যে সৌদি আরবের সঙ্গেও যদি চীনের ধরনের কোনো চুক্তি হয়, সেক্ষেত্রে তা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তনও এনে দিতে পারে। এক্ষেত্রে বেইজিং ইসলামাবাদ যদি রিয়াদ তেহরানের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি থেকে পুরোপুরি ছিটকে পড়বে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫