পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্নের মুখে অডিটররা

নিরীক্ষকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হোক

প্রকাশ: জানুয়ারি ২৬, ২০২১

এনরন, এআইজি, সত্যম, লেম্যান ব্রাদার্স কিংবা ফেডি ম্যাক কেলেঙ্কারির কথা সবার জানা। প্রতিটি কেলেঙ্কারির সঙ্গে নিরীক্ষকের অবহেলা যোগসাজশ ছিল। বাংলাদেশেও একাধিক আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে নিরীক্ষকদের অনৈতিক চর্চার খবর মিলছে। আর্থিক প্রতিবেদনে কোনো ধরনের অসংগতি আছে কিনা, সেটি খতিয়ে দেখাও নিরীক্ষকের কাজের মধ্যে পড়ে। কিন্তু তা না করে উল্টো কোম্পানির অনিয়ম আড়াল করার কাজে সহায়তা করছে কিছু নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ধরা পড়েছে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) অনুসন্ধানে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরীক্ষকদের পেশাদারিত্বের অভাবে ঋণ কেলেঙ্কারি আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। এতে প্রশ্নের মুখে পড়েছে সংশ্লিষ্ট পেশার কর্মীরা।

আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক নিরীক্ষকদের ওপর নজরদারি জোরদার করেছে। অনসাইট পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি অফসাইট সার্ভিল্যান্স, মার্কেট ইন্টেলিজেন্স আর্থিক প্রতিবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে রিজার্ভ ব্যাংক। তারা চাইছে যেকোনো কেলেঙ্কারি ঘটে যাওয়ার আগে সেটি প্রতিরোধ করতে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের নিরীক্ষক নিরীক্ষা ফার্মগুলোর বিষয়ে অভিযোগ বেশ পুরনো। দেশে নিরীক্ষার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য ২০১৫ সালে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন প্রণয়ন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি) গঠন করা হয়। যদিও এখন পর্যন্ত দেশের নিরীক্ষক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মূল দায়িত্ব ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) কাছেই রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) নিরীক্ষক নিরীক্ষা ফার্মের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও আর্থিক খাতে নিরীক্ষার বিষয়টি দেখভাল করছে। সার্বিকভাবে দেশের নিরীক্ষা মান এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে আসেনি।

নিরীক্ষকদের অনৈতিক আচরণের শিকার হয় ব্যাংক থেকে শুরু করে অনেকে। কখনো কখনো একই অডিটরের তিনটি হিসাব প্রতিবেদন একই বছর পাওয়া যায়। যারা এসব প্রতিবেদন দেয় তারা অনেক সময় জানে না তারা কী দিচ্ছে। ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যায় পড়তে হয়। এটা সমগ্র অর্থনীতির জন্যই ক্ষতিকর। একটা ভুল প্রতিবেদনের জন্য অনেকেই ক্ষতির শিকার হতে পারেন। আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজির কারণে ব্যাংক থেকে শুরু করে শেয়ারবাজার সর্বত্র ভুল বার্তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ২০০২ সালে আমেরিকায় শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের ঘটনায় ওয়ার্ল্ডকমকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়েছিল। আরেকটি বিষয় হলো অনৈতিকতার জন্য আমাদের দেশে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। যে কারণে অনৈতিক আচরণ চলতে থাকে। নৈতিকতার ব্যয় অনেক ক্ষেত্রে এত বেশি হয় যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে নৈতিকতার মান ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রক্ষা করতে পারে না। তাই নীতিনির্ধারণী মহলকে এসব বিষয়ে ভাবতে হবে।

উন্নত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিরীক্ষকদের জন্য সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড রয়েছে। নিরীক্ষকদের কাজের মূল্যায়নপূর্বক তাদের নম্বর প্রদানের ব্যবস্থাও আছে। এতে কোম্পানিগুলো নিরীক্ষক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নম্বর দেখে যাচাই করতে পারে। একই সঙ্গে উচ্চ নম্বরধারীদের ফিও বেশি হয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো নিরীক্ষকদের পেশাদারিত্ব দেখভালের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে শক্তিশালী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেরিতে হলেও সরকার এফআরসি গঠন করে। প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরুর পর বেশকিছু অনিয়ম উদ্ঘাটনের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, নিরীক্ষা কার্যক্রমের তদারকি আরো বাড়াতে হবে। সাম্প্রতিক কয়েকটি আর্থিক ঋণ কেলেঙ্কারিতে নিরীক্ষকদের জড়িত হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকের আর্থিক নিরীক্ষার লাইসেন্স বাতিল করেছে। একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি। এফআরসিও তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী আর্থিক জালিয়াতি প্রতিরোধ তদন্ত করছে। এক্ষেত্রে নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। আর্থিক খাত শেয়ারবাজারের সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন মুখ্যত অর্থনির্ভর হওয়ায় সেখানে নিরীক্ষকদের ভূমিকা অনেক বেশি। নৈতিকতা স্বাধীনতা সমুন্নত রেখে একজন হিসাববিদ নিরীক্ষা সম্পন্ন করলে সেখানে সুশাসন ঘাটতি থাকার কোনো সুযোগ নেই। পেশাদারিত্বের পাশাপাশি একাগ্রতা নৈতিকতা থাকতে হবে। নিরীক্ষার ক্ষেত্রে নৈতিকতাসম্পন্ন দক্ষ জনবল প্রয়োজন। নৈতিকতা না থাকলে শুধু দক্ষ জনবল দিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। নৈতিকতা থাকলে আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব। সবার আগে আর্থিক খাতে আমাদের দক্ষ পেশাদার প্রয়োজন। আর একজন দক্ষ পেশাদার হিসেবে বাজার, গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করাটা নৈতিক দায়িত্ব। নিরীক্ষককে পেশাদার হওয়ার পাশাপাশি নৈতিকতাসম্পন্নও হতে হবে। এক্ষেত্রে পেশাদারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫