পর্যালোচনা

৫০ বছরে বাংলাদেশের আর্থিক খাত

প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯, ২০২১

ড. শাহ্ মো. আহসান হাবীব

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে যাত্রা শুরু হয় আর্থিক খাত প্রতিষ্ঠা পুনর্গঠনের। মুক্তিযুদ্ধের মূল চার নীতির ভিত্তিতে সময় আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করা হয়। সময়ের আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠা আনুষঙ্গিক উন্নয়ন পরিকল্পনাকে অনুধাবন করতে গেলে সমসাময়িক বিশ্ব আঞ্চলিক আর্থিক খাত পরিস্থিতি, তত্কালীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা এবং মৌলিক প্রয়োজনের দিকগুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন। তত্কালীন সম্পদের স্বল্পতা আর্থিক সক্ষমতার কথা বিবেচনায় রেখে এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে কলকারখানা বড় বড় অবকাঠামো সরকারীকরণ করা হয়। আর ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠনও ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতিকে বিবেচনায় রেখেই শুরু করা হয়েছিল। স্বাধীনতাপূর্ব ১২টি ব্যাংক একত্র করে ছয়টি সরকারি ব্যাংকে রূপান্তরের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ব্যাংক খাতের যাত্রা শুরু হয়। সোনালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ব্যাংক অব ভাওয়ালপুর লিমিটেডকে একত্র করে; অগ্রণী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড, হাবিব ব্যাংক লিমিটেড কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের সমন্বয়ে; জনতা ব্যাংকের যাত্রা শুরু ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেডের সংযুক্তির মধ্য দিয়ে; রূপালী ব্যাংক স্থাপিত হয় মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডকে একত্র করে; পূবালী ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে অস্ট্রেশিয়া ব্যাংক ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংককে একসঙ্গে করে এবং উত্তরা ব্যাংকের যাত্রা শুরু ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের পরিবর্তিত নামে। সময়ে প্রতিটি ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ছিল কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক ছাড়া অন্য পাঁচটি তত্কালীন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের যাত্রা শুরু কোটি টাকা করে পরিশোধিত মূলধন দিয়ে। সোনালী ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে। ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বাইরে সময় বিদেশী ব্যাংকগুলোকে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার অনুমতি দেয়া হয়। এছাড়া শিল্প কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য দুটি বিশেষায়িত ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ অনুসারে, শিল্প ব্যাংক দীর্ঘ মাঝারি মেয়াদি শিল্পঋণ প্রদানের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে। সত্তরের দশকের ব্যাংকিংয়ের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল বিশেষায়িত ব্যাংক অর্থাৎ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কৃষক জেলেদের মাঝে ঋণপ্রবাহ নিশ্চিত করা। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঋণপ্রবাহের জন্য এই দশকেই সরকারি ব্যাংকগুলো শাখা বিস্তার শুরু করে। সত্তরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে মোট ১২টি ব্যাংকের শাখার সংখ্যা হাজার ৬০০ ছাড়িয়ে যায় এবং ১৯৮০ সালে এর সংখ্যা দাঁড়ায় হাজার ৮০০-এর ওপরে। এই শাখা বিস্তারে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোই মূলত ভূমিকা রাখে, যা ছিল মোট ব্যাংকিং শাখার প্রায় ৮৮ শতাংশ। ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের প্রাথমিক বছরগুলোয় ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব লক্ষণীয়। সাধারণভাবে ঋণ প্রস্তাব মূল্যায়ন এবং তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোয় কার্যকরী ব্যবস্থা ছিল না। একই সঙ্গে দক্ষ জনবলের অভাব ছিল।

ব্যাংকের সঙ্গে সঙ্গে বীমা কোম্পানিও জাতীয়করণ করা হয় ১৯৭২ সালে। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি সরকারি খাতের বীমা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করলেও পরবর্তী সময়ে সেগুলো সমন্বিত করে সাধারণ বীমা করপোরেশন এবং জীবন বীমা করপোরেশন নামে দুটি প্রতিষ্ঠান জন্মলাভ করে। পুঁজিবাজার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেক পুরনো হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে এর কার্যক্রম সঙ্গে সঙ্গে শুরু করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে, তবে স্বাধীন বাংলাদেশে এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। স্বাধীনতা-পরবর্তী অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকগুলোকে স্বল্প দীর্ঘমেয়াদি ঋণের গুরুদায়িত্ব নিতে হয় প্রথম থেকেই। কারণ দেশে -ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল স্বাধীনতার এক দশক পরে ১৯৮১ সালে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের আরেকটি অন্যতম স্তম্ভক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম শুরু হয় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে।

বেসরকারি খাতে বাংলাদেশে প্রথম ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালে। এর পরের বছরই উত্তরা পূবালী ব্যাংক বেসরকারি খাতে চলে আসে এবং আরো নতুন পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক যাত্রা করে। সময় বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম চালু করা হয়। পরবর্তী সময়ে মূলত নব্বইয়ের দশকে এবং ২০১২-১৩ সালে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি লাভ করে এবং এতে মোট ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৯; যেখানে ৪১টি বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে সঙ্গে ছয়টি সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, পাঁচটি বিশেষায়িত ব্যাংক এবং নয়টি বিদেশী ব্যাংক রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আটটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। এছাড়া বেশকিছু ব্যাংক তাদের শাখা উইন্ডোর মাধ্যমে শরিয়াহ ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে। ব্যাংক খাতই বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে শক্তিশালী মূল স্তম্ভ। প্রথম দশকে সরকারি ব্যাংক গ্রামীণ শাখার প্রভাব পরিলক্ষিত হলেও তা ধীরে ধীরে বেসরকারি খাত শহরকেন্দ্রিক ব্যাংকিং কার্যক্রম বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে সম্পদ, ঋণ আমানতের বিবেচনায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রভাব স্পষ্ট এবং ঋণ আমানতের বড় অংশ শহরকেন্দ্রিক। -ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে ৩৪ হলেও কার্যক্রমের বিচারে ব্যাংক খাতের তুলনায় তা ১০ ভাগের বেশি নয়। -ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি, দেশী, বিদেশী যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ১৯৮৮ সালে বেসরকারি খাতে বীমা কার্যক্রমের অনুমতি দেয়া হয় বাংলাদেশে। বর্তমানে দেশে ৭৮টি বীমা প্রতিষ্ঠান সেবা প্রদান করছে, যার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিদেশী কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ৩২টি জীবন বীমা ৪৬টি সাধারণ বীমাসংক্রান্ত সেবা প্রদান করছে প্রায় আট হাজার শাখার মাধ্যমে। জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো মোট বীমা বাজারের তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে আছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পর ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ কার্যক্রম শুরু করে। ধীরগতিতে হলেও পুঁজিবাজারের বিস্তার হচ্ছে দেশে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নতুন মাত্রা পায় ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমতিপত্র প্রদান ব্যবস্থায় আনার পর থেকে। বর্তমানে ৭৫০টির ওপরে অনুমতিপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৯ হাজার শাখার মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে নিয়োজিত।

আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচি স্বাধীন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বিস্তার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বিশেষত আর্থিক খাতের আইনি কাঠামো তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে ধরনের কয়েকটি সংস্কার কর্মসূচির আওতায়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিতে, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় এবং ব্যাংকিং পরিচালনায় বিশ্বপর্যায়ের মানদণ্ডের ব্যবহারে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। সময়ের মধ্যে ব্যাংক -ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালনায় ব্যাপক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে এসব সংস্কার উদ্যোগের কারণে। পুঁজিবাজারের আইনগত কাঠামো তৈরি সংস্কার কর্মসূচির যাত্রা ১৯৯৩ সালে যখন পুঁজিবাজার কর্মসূচি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আওতায় আসে। ২০১০ সালে বীমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ  কর্তৃপক্ষ স্থাপন বাংলাদেশের বীমা খাত সংস্কারে এবং শিল্পের আইনগত ভিত্তি স্থাপনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি বলয়ের মধ্যে আনা হয় ২০০৬ সালে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আর্থিক খাত সংস্কারের চলমান প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেগবান হয়েছে।

দীর্ঘ ৫০ বছরের যাত্রাপথে বাংলাদেশের আর্থিক খাত মুখোমুখি হয়েছে অনেক পরিবর্তনের, অনেক চড়াই-উতরাইয়ের। করোনাযুদ্ধে আজ এমন এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি সারা বিশ্ব তথা বাংলাদেশের আর্থিক খাত। তবে সময়ের মাঝে যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেছে দেশের আর্থিক খাত, পরিণত হয়েছে অনেক কার্যক্রম। অনেক সমস্যার মাঝেও ব্যাংক খাতের উন্নয়ন সম্পৃক্ততা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রশংসার দাবিদার। আজকের ব্যাংক খাত অনেক বেশি ঝুঁকি সহন করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিছু -ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রশংসনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার কার্যক্রম সমাদৃত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। ধীরগতিতে হলেও পুঁজিবাজারে কর্মচাঞ্চল্য বাড়ছে। বীমা খাতে আস্থাপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেকের জন্য দৃষ্টান্তমূলক। করোনা পরিস্থিতিতে তা বাধার মুখে পড়লেও অবস্থা স্বল্পমেয়াদি বলে আশা করা যায়। উন্নয়নের যাত্রাপথে ব্যাংক তথা আর্থিক খাতের টেকসই কার্যক্রম অত্যন্ত জরুরি। আর এজন্য আর্থিক খাতে মন্দ ঋণ নিয়ন্ত্রণে এবং রীতিশুদ্ধ নৈতিকতাপূর্ণ আর্থিক খাত পরিচালনায় আরো মনোযোগী হওয়ার সুযোগ আছে। পুঁজিবাজারের উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাংক নির্ভরতা কমাতে হবে। পাশাপাশি বীমা খাতের উন্নয়ন দেশের আর্থিক খাতে গুণগত পরিবর্তন আনবে। আজকের এই করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাংক তথা আর্থিক খাতের দৃষ্টি থাকতে হবে সরকারকে সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থনীতিকে ফিরিয়ে আনার। করোনা-পরবর্তী বা সহনীয় করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের আর্থিক খাত তথ্যপ্রযুক্তি গ্রহণ অভিযোজনের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রমে অবদান এবং আরো পরিণত আর্থিক সেবা প্রদানের সামর্থ্য অর্জন করবেএমনটাই কাম্য।

 

. শাহ্ মো. আহসান হাবীব: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫