আন্তর্জাতিক মানে নেই বাংলাদেশের কোনো স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান

প্রকাশ: ডিসেম্বর ৩১, ২০২০

সাইফ সুজন

একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মান কেমন তা বিচারে বেশকিছু মানদণ্ড রয়েছে। প্রকাশনার সংখ্যা গুণগত মান, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ সহযোগিতা, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নেতৃত্ব প্রদানসহ বেশকিছু বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয় এক্ষেত্রে। ধরনের আটটি মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবারের মতো বছরও বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি র্যাংকিং প্রকাশ করেছে স্পেনের সিমাগো ল্যাব যুক্তরাষ্ট্রের স্কপাস। তালিকায় উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি এশিয়ার অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের নাম থাকলেও একমাত্র আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) ছাড়া বাংলাদেশের কোনো স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থান পায়নি। স্বাস্থ্যসেবায় গত দুই দশকে বেশ অগ্রগতি করেছে বাংলাদেশ। ব্যক্তিগতভাবে দেশের অনেক গবেষক আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ সুনামও কুড়িয়েছেন। কিন্তু সে তুলনায় গড়ে উঠছে না ভালো কোনো প্রতিষ্ঠান।

২০২০ সালে সিমাগো ইনস্টিটিউশনস র‍্যাঙ্কিংসে (এসআইআর) বিশ্বের ১২ শতাধিক প্রতিষ্ঠান জায়গা করে নিয়েছে। এসআইআরের হেলথ র‍্যাঙ্কিং বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশের হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, ইনস্টিটিউট সেন্টার জায়গা পেয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ১৪টি স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান তালিকায় স্থান পেয়েছে। স্বাস্থ্য গবেষণায় অবদানের জন্য এসআইআরে স্থান নেয়া ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) বৈশ্বিকভাবে ৬২৪তম অবস্থানে থাকা আইসিএমআর দেশটির বায়োমেডিকেল রিসার্চের জন্য সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ভারতের পাঁচটি হাসপাতাল কয়েকটি মেডিকেল কলেজ ইনস্টিটিউট রয়েছে সিমাগো-স্কপাসের ওই তালিকায়।

সিঙ্গাপুরের ১২টি প্রতিষ্ঠান জায়গা পেয়েছে সিমাগো-স্কপাসের হেলথ রিসার্চ র্যাংকিংয়ে। এসআইআরে স্থান পাওয়া সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, সিঙ্গাপুর (এনসিআইএস) বৈশ্বিক অবস্থানে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান ৩৫৫তম। এছাড়া দেশটির চক্ষু, হূদ, নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট এবং নারী শিশুবিষয়ক কয়েকটি হাসপাতাল ইনস্টিটিউট রয়েছে।

স্বাস্থ্য গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে চীন। সিমাগো-স্কপাসের বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে জায়গা পাওয়া হাজার ২১৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু চীনেরই রয়েছে ১৪৫টি প্রতিষ্ঠান। চীনের সব প্রতিষ্ঠানই সেরা নয়শর মধ্যে জায়গা পেয়েছে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন চায়না; বৈশ্বিক তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান ৪৮০তম।

অথচ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হলেও সেখানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান বলতে কেবল আছে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে গড়ে ওঠা একমাত্র স্বাস্থ্য গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যশিক্ষা সেবার ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটলেও স্বাস্থ্য বা চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণায় এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য . কনক কান্তি বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে এতদিন পর্যন্ত দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একটা সেবা, আরেকটি হলো শিক্ষা। গবেষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আমরা গুরুত্ব দিতে পারিনি। এক্ষেত্রে তহবিল সংকটের একটি বিষয় রয়েছে। মৌলিক গবেষণার জন্য অনেক তহবিলের প্রয়োজন। প্রজেক্ট প্রোফাইল করে দাতাদের থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে হয়। গবেষণা তহবিল সংগ্রহে সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। ধরনের আউটলুক আমাদের শিক্ষক শিক্ষার্থী উভয়ের মধ্যেই অনুপস্থিত।

তিনি আরো বলেন, ডিগ্রি অর্জনের জন্য যতটুকু গবেষণা প্রয়োজন ততটুকুই আমরা করি। গবেষণা ফল আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। গ্লোবাল র্যাংকিং বা জার্নালগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষকের কিছু কিছু প্রকাশনা যাওয়া শুরু হয়েছে। গবেষণার জন্য যথাযথ পর্যাপ্ত প্রণোদনারও প্রয়োজন আছে। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে। তবে আমরা সম্প্রতি ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের স্বীকৃতি পেয়েছি। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। পর্যায়ক্রমে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড স্বীকৃতির পথেই রয়েছি আমরা।

বিভিন্ন জার্নালে কমপক্ষে ১০০টি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছেএমন প্রতিষ্ঠানগুলোকেই জরিপের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিয়েছে সিমাগো-স্কপাস। দেশে স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর), বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোস্যাল মেডিসিন (নিপসম), জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিরই বছরপ্রতি ১০০টি গবেষণা জার্নালে প্রকাশ করা হয় না। অর্থাৎ সিমাগো-স্কপাসের র্যাংকিংয়ে অংশ নেয়ার ন্যূনতম শর্তও অর্জন করতে পারেনি এসব প্রতিষ্ঠান।

গবেষণা কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হাসপাতালগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক . সৈয়দ মোদাসেসর আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, গবেষণা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও স্বীকৃতির সুযোগ নেই। এজন্য প্রয়োজন প্রণোদনা। দেশে অনেক ওষুধ উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে হবে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্ষেত্রেও ধরনের পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। শুধু গবেষণা করলেও চলবে না, গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনার ব্যবস্থাও করতে হবে। এগুলো নিশ্চিত করা ছাড়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব নয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, গবেষণার ক্ষেত্রে দেশের স্বাস্থ্য খাতের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমাদের স্বাস্থ্য বা চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণার জন্য বেশ কয়েকটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যদিও আমরা সে প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা বা প্রকাশনা নিশ্চিত করতে পারিনি। এজন্যই আমরা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে পিছিয়ে পড়েছি। তবে বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। আসলে উন্নত শিক্ষা সেবা নিশ্চিত করতে হলেও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫