অভিমত

‘বানান শোধক’ হতে পারত বানান সমস্যার চূড়ান্ত নিদান!

প্রকাশ: অক্টোবর ৩০, ২০২০

সৈয়দ মূসা রেজা

‘গরু’ আমাদের লেখাপড়া শেখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে কেউ কেউ মজা করে ‘গুরুত্বপূর্ণ’-কে ‘গরুত্বপূর্ণ’ বলতেই পারেন! ‘গরু’র রচনা লিখে—বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায়—রচনা লেখার হাতেখড়ি হয়েছে আমাদের, সে কথা এ কালের অনেকেই হয়তো জানেন না। এহেন একান্ত গৃহপালিত নিরীহ ‘গরু’-কে ‘গোরু’ রূপান্তর করে বাংলা একাডেমি বিতর্কের মুখে পড়েছে। 

বাংলা বানান সংশোধনের প্রচেষ্টা নতুন নয়। আইয়ুব খানের শাসনামলে এমন চেষ্টা হয়েছে। পাশাপাশি হয়েছে সে চেষ্টাবিরোধী আন্দোলন। ছড়াকার আবদুল মান্নানের ‘মিছিলের মুখের’ প্রথম ছড়াই ছিল এ বিষয়ে। পুরো ছড়া মনে নেই। তবে একটা লাইন এখনো মনে আছে—‘ভাষা নিয়ে ওরে বাবা এ কিরে যুদ্ধ!’

‘গরু’-কে ‘গোরু’ করার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, সে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। আমাদের ‘পাখি’ বদলে গেছে, বদলে গেছে ‘রানি’, বদলে দেয়া হয়েছে ‘শ্রেণি।’ ‘বাড়ী’ বদলে হয়েছে ‘বাড়ি।’ তবে পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় হয়ে এখনো টিকে আছে ‘নারী’ বা ‘নদী।’ সংস্কৃতকে বিদেশী ভাষা হিসেবে ধরে নেয়া হলে পরিচিত অনেক শব্দের বানানই বদলে যাবে। অদূর না হোক সুদূরভবিষ্যতে তেমনটা হবে না, এ কথা এখনই জোর দিয়ে বলা যাবে কি? মাঝে মাঝেই নিজেকে সে প্রশ্ন করি!

বাংলা বানান পরিবর্তনে আইয়ুবের আমলের প্রচেষ্টা প্রবল বাধার মুখে পড়লেও ‘মুনীর অপটিমা’ টাইপ রাইটার চালু হওয়ার পর কিন্তু অনেক পুরনো বানানই বদলে যায়। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতাকে কেন্দ্র করে বানানকে এভাবে বানানো হলেও কেউ তার জোরালো বিরোধিতা করেননি বোধহয়। সৃজনশীল লেখা কেবল হাতের লেখার মাধ্যমেই সম্ভব। এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে তেমন কোনো সাহায্য করেনি মুনীর অপটিমা। বাংলায় টাইপ করে সাহিত্যচর্চা বা লেখালেখি করেছেন, এমন লেখক তখন কয়জন ছিলেন? 

অবশ্য বাংলা রহস্য ও থ্রিলার সাহিত্যের মোড় পরিবর্তনকারী লেখক কাজী (আনোয়ার হোসেন) ভাইসহ ‘সেবা’র কয়েকজনকে ‘মুনীর অপটিমা’ দুর্দান্তভাবে ব্যবহার করতে দেখেছি। এমনকি ‘ঈ’র মাথা ঘষে তাকে ‘ঙ্গ’-তে পরিবর্তন করে নিয়েছিলেন কাজী ভাই। ‘ই’ কার দেয়ার আলাদা ব্যবস্থা থাকায় বাড়তি অসুবিধায় পড়তে হয়নি।

বাংলা টাইপের জগতে বিজয় পতাকা উত্তোলন করেছিল ‘বিজয়’। টাইপ করে লেখালেখির সূচনাও হয় এর মাধ্যমে। অন্যদিকে ‘বিজয়’-এর জয়জয়কারের মধ্য দিয়ে বানানের দুনিয়ায় বাংলা হরফের আবার পুরনো রূপ ফিরে পাওয়ার প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা দূর হয়। আর ‘অভ্র’র আগমনের মধ্য দিয়ে টাইপ, বাংলা টাইপ করার ক্ষেত্রে অভাবিত সফলতা সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে অ্যান্ড্রয়েডের ‘অভ্র’ হয়ে ওঠে ‘রিদমিক।’ এককালে বলা হতো, ‘কাগজ, কালি, মন—লিখে তিন জন।’ এখন বলা যায়, ‘কম্পিউটার, কিবোর্ড, মন—লেখে তিন জন’!

বাংলা ভাষার উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছে বাংলা একাডেমি। এরশাদের শাসনামলে ‘বাংলা একাডেমী’র (তখনো ‘একাডেমি’ হয়নি) সাথে মিশিয়ে দেয়া হয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে। কিন্তু বাংলা টাইপ করার সফটওয়্যার তৈরিতে বাংলা একাডেমির কোনো ভূমিকা নেই! ভাবতে গেলে বেশ মজাই লাগে! বানানকে প্রমিত করতে গিয়ে যুক্ত বর্ণকে স্বচ্ছ করার কথাও বলেছে বাংলা একাডেমি। কিন্তু এজন্য কোনো ফন্ট সাধারণজনের জন্য সহজলভ্য বা জনপ্রিয়ও করেনি একাডেমি। ফন্ট তৈরি সহজ নয়। কিন্তু এজন্য রকেট প্রযুক্তির দরকার নেই। দেখুন, অনেকের ভাষায়, বাচ্চা বাচ্চা পোলাপান কি চমত্কার ফন্ট তৈরি করছে। ইউনিকোড ও আসকি উভয় ফন্টই বানাচ্ছেন। মাগনা বিলানোর আয়োজন করছেন। কোনো কোনো ফন্ট বিক্রিও হচ্ছে এবং এটা একটা নতুন বিষয়। ফন্ট কেনাবেচা হবে, সে কথা বোধ হয় বাংলাভাষীরা কয়েক বছর আগেও ভাবেননি!

টাইপ করতে পারে না, শিক্ষিতজনদের মধ্যে আজকাল এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। আজকে যারা তরুণ তাদের মধ্যে টাইপ অজানা ব্যক্তি খুঁজতে হলে বহুল কথিত হারিকেন হাতে বের হতে হবে। বাংলা বানান প্রমিত করার কাজে এ অভ্যাসকে সহজেই লাগাতে পারে বাংলা একাডেমি। ‘স্পেল চেকার’ বা ‘বানান শোধকের’ জন্য ডাটা তৈরি করে দিতে পারে বাংলা একাডেমি। প্রযুক্তির দিক থেকে এ কাজ তেমন কঠিন নয়। নেই কোনো ‘বাধার বিন্ধ্যাচল’। মাইক্রোসফট ওয়ার্ডসহ ওপেন সোর্স সফটওয়্যারগুলোকে লক্ষ্য করে এমন কাজ করতে পারত বাংলা একাডেমি।

অভিধান গ্রন্থ প্রণয়নের পাশাপাশি ডিজিটাল অভিধান তৈরি করা যেত। ‘বিজয়’, ‘অভ্র’, ‘রিদমিক’ বা জি-বোর্ডের সঙ্গে কাজ করার উপযোগী করা হলে অন্তত বানান মুখস্থ করার ঝামেলা থাকত না। প্রযুক্তির দিক থেকে এ কাজে ঝামেলা তেমন আছে বলে মনে হয় না। বহুল ব্যবহূত মাইক্রোসফটের সফটওয়্যারে এমন প্রযুক্তি প্রয়োগে কপিরাইট-সংক্রান্ত আইনগত ঝামেলা থাকলেও থাকতে পারে, জানি না। কিন্তু এ ঝামেলা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পথও আছে। অনলাইনেও স্পেল চেকার রাখলে কে ঠেকায় বাংলা একাডেমিকে? যখনই অভিধানের কোনো নতুন সংস্করণ বের হবে তখনই তার ডিজিটাল আপডেটও বের করতে হবে। পাশাপাশি বাংলা একাডেমি প্রণীত সব অভিধান ও পরিভাষার ডিজিটাল সংস্করণ প্রকাশের বিষয়কেও গুরুত্ব দিতে হবে।

বাংলা ভাষায় প্রচুর বিদেশী শব্দ আমদানি হচ্ছে। জীবিত ভাষার স্বাভাবিক গতির কারণেই সব সময় এমন হচ্ছে এ কথা হয়তো অনেকেই ভাবেন না। ধরুন কভিড-১৯-কে কেন্দ্র করে কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন শব্দ দুটি ব্যাপক ব্যবহূত হচ্ছে। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত বাংলা একাডেমির চিকিৎসাবিদ্যা পরিভাষায় এ দুই শব্দেরই বাংলা দেয়া আছে। প্রথমটির পরিভাষা সঙ্গরোধ আর দ্বিতীয়টির পরিভাষা হিসেবে স্বতন্ত্রীকরণ, পৃথকীকরণ ও অন্তরণ দেয়া আছে। সংবাদমাধ্যমে এ দুই পরিভাষা ব্যবহার হয়নি। বাংলা একাডেমি যে পরিভাষা কোষ প্রকাশ করেছে তা-ই বা কয়জনে জানেন! গণিত থেকে দর্শন পর্যন্ত নানা শাস্ত্রের পরিভাষা কোষ প্রকাশ করেছিল ‘একাডেমী।’ একাডেমির আমলে তার কোনো প্রচারই নেই। অতীতেও ছিল না। একাডেমী আমলে প্রকাশিত সব পরিভাষাকে একটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে পারত একাডেমি। নিদেনপক্ষে ডিজিটাল সংস্করণ বের করতে তো পারতই। পরিভাষার সূত্র ধরে আরেকটি কথা বলতে চাই, তা হলো প্যানডেমিকের বাংলা করা হচ্ছে ‘অতিমারি’ বা ‘বৈশ্বিক মহামারি’। এত ঝামেলা না করে সরাসরি ‘বিশ্বমারি’ লিখলে দোষ কী!

আমদানি করা কোন কোন বিদেশী শব্দকে বাংলা ভাষায় গ্রহণ করা যায় বা যায় না তার তালিকা নিয়মিত প্রকাশ করতে পারে একাডেমি। এসব শব্দকে ডিজিটাল অভিধানে ঠাঁইও দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ডিজিটাল অভিধান যত সহজে আপডেট করা সম্ভব, কাগজে ছাপানো অভিধান করা সম্ভব নয়, এ কথা সবাই জানেন।

শেষ কথা, বাংলা একাডেমিকে প্রযুক্তিপ্রেমী হতে হবে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল রেখে এগোতে তো হবেই, এমনকি আগামী দিনে প্রযুক্তির কী পরিবর্তন ঘটতে চলেছে সেদিকে চোখ রাখতে হবে। সে প্রযুক্তিকে গ্রহণের প্রস্তুতি রাখতে হবে। ডিজিটাল খাতে একাডেমির দুর্বলতার প্রতীক হয়ে রয়েছে গোগল প্লেতে বাংলা একাডেমি অ্যাপ। সেটা এ পর্যন্ত নামানো হয়েছে মাত্র ১০ হাজারবারের বেশি। ব্যবহারকারীরা তাদের পর্যালোচনায় একাডেমির প্রতি দয়া দেখাতে কার্পণ্য করেছেন। ক্রোধ প্রকাশ করেছেন ‘উদার হাতে’। আর এ অ্যাপ সর্বশেষ আপডেট হয়েছে ২০১৬ সালে! এরপর বুড়িগঙ্গা দিয়ে কি আর কোনো পানি প্রবাহিত হয়নি?


সৈয়দ মূসা রেজা: নিবন্ধকার



সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫