ছয় দশকেও পরিণত হতে পারেনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ

ডিজিটাল রূপান্তর ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় উন্নত পুঁজিবাজার গড়ে উঠুক

প্রকাশ: অক্টোবর ২৮, ২০২০

বাংলাদেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালে। এর বয়স বিবেচনায় বিশ্বের অন্যান্য স্টক এক্সচেঞ্জের তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইর পরে প্রতিষ্ঠিত (১৯৯০ সাল) হয়েও বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০ স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকায় রয়েছে। চীনের শেয়ারবাজারের ইতিহাস মাত্র ৩০ বছরের। এই অল্প সময়েই সে দেশের স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের সেরা হয়ে উঠেছে। এটা সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে। প্রযুক্তির পরিবর্তন চীন ও দেশটির নাগরিকদের শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দেয়নি, জীবনমানকে উন্নত করেছে। জীবনকে সহজ ও সাবলীল করেছে। জীবন সেখানে হয়ে উঠেছে আরো বেশি উপভোগ্য। ১৯৭৮ সালেও শেনঝেন ছিল জেলেদের ছোট্ট একটি গ্রাম। প্রযুক্তি ওই গ্রামকে আজ বিশ্বের শীর্ষ আধুনিকতম শহরগুলোর একটি করেছে। চীনের শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জের মোট বিনিয়োগকারীর সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। এসব বিনিয়োগকারীর ৯৫ শতাংশই বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব খুলেছেন মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে। আর শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জে প্রতিদিন যে লেনদেন হয়, তার শতভাগই হয় অনলাইনের মাধ্যমে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ অ্যাপসের মাধ্যমে আর ৩০ শতাংশ বিনিয়োগকারী কম্পিউটার ব্যবহার করে প্রতিদিনের লেনদেন করেন। সেখানে বিও হিসাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের কম মানুষ শেয়ারবাজারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। সক্রিয় বিনিয়োগকারীর হিসাব ধরলে এ দেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের কম শেয়ারবাজারের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ার কেনাবেচার আদেশ (অর্ডার) দেন কাগজে ও টেলিফোনের মাধ্যমে। দীর্ঘমেয়াদি ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকা, যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ-পেশাদার কর্মীর অভাব, করপোরেট সুশাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব, নামমাত্র অটোমেশন, ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, ডিজাস্টার রিকভারি (ডিআর) সাইট না থাকাসহ নানা কারণে পুরোপুরি কার্যকর পুঁজিবাজারে পরিণত হতে পারেনি ডিএসই।

বর্তমানে দেশের ডিএসই ১ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। এটি  ৩-৫ হাজার কোটি টাকা হওয়ার কথা। আগামী দিনে বাজারে বিভিন্ন ধরনের বন্ড, এসএমই প্রডাক্টসহ অনেক ধরনের নতুন নতুন পণ্য আসবে। এসব পণ্য চালু হলে টার্নওভার তখন ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে। তার জন্য ডিএসইর আইটি বিভাগকে সংস্কার করতে হবে। পুঁজিবাজারে এখনো কাঠামোগত কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। আবার যারা বাজারসংশ্লিষ্ট অর্থাৎ পুঁজিবাজার নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, তাদের পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বিনিয়োগকারীর স্বার্থে বিশ্বের পুঁজিবাজারে কী পরিবর্তন হচ্ছে, সেটির সঙ্গে সমন্বয় রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ায় সক্রিয় থাকতে হবে। এছাড়া বাজারের গভীরতা বৃদ্ধি, স্থিতিশীল এবং উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। অর্থনীতির আকার বড় হলেও এর বিভিন্ন উপাদান একটির সঙ্গে অন্যটি অসামঞ্জস্যহীনভাবে বেড়ে উঠছে। এখানে বড় ধরনের সংস্কার দরকার। সংস্কার নিয়ে মাঝেমধ্যে আলোচনা হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি সামান্যই। নতুন অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওএমএস), নতুন ইনডেক্স ও মোবাইল অ্যাপের ব্যবহারের জন্য এর মান ও নিরাপত্তা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশ্বে একটি পূর্ণাঙ্গ অটোমেটেড এক্সচেঞ্জ বলতে যা বোঝায়, সেক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে ডিএসই; যা ডিএসইর সফলতা অর্জনে অন্যতম বাধা। তবে শুধু ডিজিটাল রূপান্তর নয়, ব্যবস্থাপনায়ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। গড়ে তুলতে হবে দক্ষ জনবল। 

নতুন প্রজন্মের বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে অনলাইন ট্রেডিং মূল চাবিকাঠি। নতুন প্রজন্মের বিনিয়োগকারীরা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো ডিজিটাল প্লাটফর্মে অভ্যস্ত। তারা যেন ডিজিটাল মাধ্যমে এক ক্লিকে মিউচুয়াল ফান্ড কিংবা ফিক্সড ইনকাম ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিশ্বের উন্নত শেয়ারবাজারের মতো ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের ক্ষেত্রে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) সব ব্রোকারের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে, যাতে ব্রোকারেজ হাউজগুলো তাদের নিজস্ব ট্রেডিং সিস্টেম চালু করে এক্সচেঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। সার্ভার ও ক্লাউডভিত্তিক কাস্টমাইজড অনলাইন ট্রেডিং সিস্টেম চালু করতে হবে। পাশাপাশি ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়ে সব স্টেকহোল্ডারকে অবগত করা; বর্ধিত হারে অনলাইন ট্রেডিং পরিচালনার জন্য এক্সচেঞ্জের ট্রেডিং প্লাটফর্ম ও সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিসিবিএল) আপগ্রেড করা; প্রত্যেক ব্রোকারকে একটি দক্ষ অনলাইন ট্রেডিং প্লাটফর্ম চালু করা; মোবাইল অ্যাপ চালু করা; ব্লুমবার্গ, চ্যাটবট এবং অন্যান্য মূল্য সংযোজন সেবার সংযুক্তি ঘটাতে হবে। আশার কথা হলো, ডিএসইর পর্ষদ অনলাইন ট্রেডিং ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য করণীয় নির্ধারণে একটি ওয়ার্কিং কমিটি করেছে। ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এক্সচেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাদের অভিজ্ঞতা ও সহায়তা দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কাজে লাগাতে উদ্যোগ নিতে হবে। ডিএসইতে ১৯৯৮ সালে ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে লেনদেন চালু হওয়ার পর দুই দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো এটি একটি পূর্ণাঙ্গ অটোমেটেড স্টক এক্সচেঞ্জ হিসেবে গড়ে ওঠেনি, যা হতাশার। 

এশিয়ার প্রায় সব দেশেই মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার প্রায় সমান গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। ফলে এসব দেশের জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদানও অনেক বেশি। কিছু দেশ রয়েছে, যাদের পুঁজিবাজারের মূলধন তাদের মোট জিডিপির পরিমাণের চেয়েও ছাড়িয়ে গেছে কয়েক গুণ। এর মধ্যে কিছু দেশ রয়েছে, যাদের বাজার মূলধন তাদের নিজেদের ডিজিপির ১ হাজার শতাংশেরও বেশি। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের পুঁজিবাজারই রয়েছে সবচেয়ে পিছিয়ে। আমাদের দুটি বাজারের মধ্যে বড় বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধনের হার শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের চেয়েও কম। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে বড় হচ্ছে, সেভাবে দেশের পুঁজিবাজার বড় হচ্ছে না। ফলে অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান কমে যাচ্ছে। অথচ শিল্পায়নের জন্য যে মূলধন প্রয়োজন হয়, তা ব্যাংক থেকে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পুঁজিবাজার থেকেও পাওয়া যায়। পুঁজিবাজারে এলে বাড়তি হিসেবে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা যায়। কেননা পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে বেশকিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। এর পরও দেশের পুঁজিবাজার অনেক পেছনে পড়ে রয়েছে। বিশ্বের সফল পুঁজিবাজারের আলোকে ডিএসইকে ঢেলে সাজাতে হবে। দক্ষ জনবলের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানোর মাধ্যমে দেশের শেয়ারবাজারকে গতিশীল করা সম্ভব। এটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাণিজ্য ও উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থেই জরুরি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫