জন্মদিন

‘অনমিত অশীতিপর’

প্রকাশ: অক্টোবর ২৭, ২০২০

আব্দুল বায়েস

আজ আমাদের সবার অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষের জন্মদিন। তিনি এম সাইদুজ্জামানসাবেক অর্থমন্ত্রী এবং অর্থ, বহিঃসম্পদ পরিকল্পনা সচিব। ক্রিকেট ভাষ্যকারের ভাষায় বলা যায়, তিনি সেঞ্চুরির দিকে ছুটছেন; নট আউট অ্যাট এইটি এইট।

শ্রদ্ধেয় এম সাইদুজ্জামানের অষ্টাশিতম শুভ এই জন্মতিথিতে আমাদের সবার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা অভিনন্দন রইল।

আভিধানিক অর্থে আশির কিংবা তারও বেশি যার বয়স, তাকে বলা হয় অশীতিপর বৃদ্ধ বা অতিবৃদ্ধ। ধরে নেয়া হয় যে দেহ, স্বাস্থ্য, মন, অর্থনীতি ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি এই শ্রেণী অনেকটাই অনুৎপাদনশীল; সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখতে অক্ষম, অপারগ। ডিপেনডেন্ট-এর সংজ্ঞায় তারা যে প্রথম কাতারে, সে কথা দেশে যেমন সত্য, বিদেশেও তেমনি সত্য।  তবে এমনতর উপসংহার যে সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়, তার দৃষ্টান্ত এই দক্ষিণ এশিয়াতেই অনেক আছে। উদাহরণ হিসেবে অনেকের নাম আনা যায়, তবে মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে নীরদ সি চৌধুরি, অমর্ত্য সেন, রেহমান সোবহান, ফজলে হাসান আবেদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং আমাদের প্রিয় এই মানুষটি, যাঁর কথা একটু আগে বললাম। দৈহিক চলমানতা, চিন্তাভাবনা কিংবা বিদ্যা বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ে এখনো তিনি দীপ্তিমান।

এম সাইদুজ্জামান ১৯৩৩ সালের ২৭ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের এক বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। ১৩ ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে মুক্তিযুদ্ধ সময়কার সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের জন্মস্থান কিশোরগঞ্জে। আবার বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস এবং বিখ্যাত বিতর্কিত লেখক নীরদ সি চৌধুরীর জন্মস্থানও সেখানেই।

যাই হোক, এমন একটা রত্নগর্ভা জায়গায় জন্ম নেয়া সাইদুজ্জামান সাহেবের উচ্চতর শিক্ষার শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে। পরবর্তীকালে উন্নয়ন অর্থনীতির ওপর অমেরিকা ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেন।  তত্কালীন সারা পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের লিখিত পরীক্ষায় প্রথম হওয়া  (লিখিত মৌখিকে ৭ম স্থান) প্রমাণ করে তিনি কত মেধাবী ছিলেন পুরো ছাত্রজীবনে। মেধার স্বাক্ষর অব্যাহত ছিল পেশা তথা কর্মজীবনেও, সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পরেই।

প্রচারবিমুখ এম সাইদুজ্জামানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়, কয়েক বছর হবে হয়তো। কৃষি পুষ্টিসংক্রান্ত একটা আন্তঃদেশীয় প্রকল্পের তিনি ছিলেন উপদেষ্টা আর ব্র্যাকের হয়ে আমি ছিলাম বাংলাদেশের প্রতিনিধি। সেই সূত্রে দু-একবার বিদেশে দেখা-সাক্ষাৎ, মতবিনিময় এতটুকুই। তবে আদ্যোপান্ত সুশীল মানুষটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক শানিত হয় ফেসবুকে পোস্ট করা আমার লেখা এবং তাঁকে দেয়া আমার দু-একটা বই কেন্দ্র করে। সাতাশিতে পা দিয়েও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার লেখা পড়েন এবং তাত্ক্ষণিক সেলফোনের মাধ্যমে মন্তব্য করতে ভুলে যান না অর্চনীয় এই অশীতিপর।

পেশাজীবনে তিনি ছিলেন একজন সৎ, দক্ষ দেশসেবক  আমলা; বাংলাদেশের অর্থ , পরিকল্পনা , বহিঃসম্পদ  সচিব এবং অর্থমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন স্বল্পভাষী বিনম্র মানুষটি। একই ব্যাচের যে পাঁচজন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর পদে আসীন হয়েছিলেন বলে একদিন লিখেছিলাম, তিনি সেই পাঁচ তারকার এক তারকা। পরিকল্পনা সচিব থাকাকালে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন; বহিঃসম্পদ সচিব হিসেবে বৈদেশিক সাহায্য আহরণে চেষ্টা চালান। তাছাড়া ইফপ্রির ডাইরেক্টর, বিশ্বব্যাংকে অল্টারনেট ডাইরেক্টর, ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান, সিপিডি, বিআইডিএস, বারি, বিরি ইত্যাদি জাতীয় আন্তর্জাতিক সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদে থেকে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে অবদান রাখেন।

প্রশাসক বা আমলা ছিলেন তিনি, তবে গবেষণা যে তাঁর হৃদয়ের গভীরে গ্রোথিত ছিল তা বলা বাহুল্য। এখনো তাঁকে দেখি দেশীয় কিংবা বৈশ্বিক আর্থসামাজিক বিষয়ে কোনো সেমিনার কিংবা কনফারেন্সে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে উপস্থিত আছেন ধোপদুরস্তকখনো প্রধান অতিথি, কখনো প্রধান বক্তা হয়ে। অথবা হয়তো এর কোনোটাই নয় কিন্তু প্রথম সারিতে বসে শুনছেন সবার কথা, নোট নিচ্ছেন নিবিষ্ট মনে। এই তো কভিডের আগে অমর্ত্য সেন পাঠচক্রের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন অতিথি বক্তা।

  বয়সেও তাঁর প্রখর স্মরণশক্তির তারিফ না করে পারা যায় না। আমার লেখা নন্দিত নগরে বইতে নারী, বাড়ি, গাড়ি শব্দ তিনটি উল্লেখ করে আবু রুশদ মতিন উদ্দিন (যাঁর বয়স এখন ১০০) ৫০ বছর আগে কোথায়, কখন এবং কীভাবে ওই শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, তা জানাতে আমাকে ফোন করলেন। অথবা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মৃত্যুর পরতাও কয়েক দশক আগের কথাজাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অনুরোধমতো অর্থ সচিব হিসেবে তিনি শিল্পাচার্যের অঙ্কন সংরক্ষণকল্পে অর্থ বরাদ্দে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তার পয়েন্ট টু পয়েন্ট ধারাবিবরণী শোনাচ্ছেন। শুনিয়েছেন মাঝেমধ্যে আমেরিকা থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকা আসা হতো শুধু দেবব্রত বিশ্বাসের জন্য ওষুধ পৌঁছে দেয়া এবং তার গান শোনার জন্য (অবশ্য তখন অসুস্থতার জন্য তিনি গান শোনাতে পারেননি) আবার অক্সফোর্ডে গিয়ে দেখা করেছেন নীরদ সি চৌধুরীর সঙ্গে, যিনি কিশোরগঞ্জ ছেড়ে কলকাতা যাওয়ার পর আর কখনো জন্মস্থানে বেড়াতে আসেননি, কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার পর কখনো কলকাতামুখী হননি এবং ভারত ছেড়ে ইংল্যান্ড যাওয়ার পর কোনো দিন ভারতে পা ফেলেননি। জামান সাহেব হয়তো জানেন না যে তাঁর এই ক্ষুরধার স্মৃতিশক্তি অন্য প্রান্তে থাকা আমার মধ্যে একদিকে যেমন বিস্ময় জাগায়, অন্যদিকে আবার হতাশও করে কারণে যে মাত্র কয় বছর আগের ঘটনার পয়েন্ট টু পয়েন্ট বিশ্লেষণ দিতে গিয়ে আমাকে বারবার হোঁচট খেতে হয়।

একটা মজার কথা দিয়ে বক্তব্য শেষ করতে চাই। তাঁর শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করতে এক বছর কেন বেশি লেগেছিল সে-সম্পর্কিত এক প্রশ্নে সাইদুজ্জামান সাহেবের উত্তর ছিল রকম: আমি তখন এসএম হলে থাকি। প্রথম থেকে আমি সিঙ্গেল রুমে ছিলাম। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল জানতে পলাশী ব্যারাকে এক চায়ের স্টলে রেডিও শুনতে যাই। যেই শুনলাম যুক্তফ্রন্টের জয় আর মুসলিম লীগের ভরাডুবি হতে চলেছে তখন এমন জোরে দৌড় দিলাম, মনে হলো যেন আমি অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করছি। হাঁপাতে হাঁপাতে হলে পৌঁছিয়েই অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়লাম। এদিকে পরের দিন ছিল পরীক্ষা। ডাক্তার এসে চেকআপ করে বললেন, কার্ডিয়াক সমস্যা, পুরো বিশ্রাম প্রয়োজন, আপাতত পরীক্ষা দেয়া যাবে না।

প্রসঙ্গত স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার যে সেই সময় যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন দেয়া ছিল প্রগতিশীলতার সমার্থক। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক লায়লা নুরের খবর নিতে গিয়ে জানালেন, তারা ভাষা আন্দোলনে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন।

আপনার দীর্ঘ উৎপাদনশীল জীবন কামনা করি স্যার। যতদিন বেঁচে থাকবেন, সমাজের প্রতি আপনার বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান অব্যাহত থাকবে কামনা বিধাতার কাছে:

তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে
তব পুণ্য কিরণ দিয়ে যাক মোর মোহ কালিমা ঘোচায়ে
মলিন মর্ম মুছায়ে।।

আব্দুল বায়েস: সাবেক উপাচার্য অর্থনীতির অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; বর্তমানে খণ্ডকালীন শিক্ষক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫