অর্থনীতির বাঁকবদল

প্রকাশ: অক্টোবর ১৩, ২০২০

ড. কেএএস মুরশিদ

ভূমিকা

ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামীণ অকৃষি খাত (আরএনএফ সেক্টর) বিভিন্ন ধরনের জীবিকা যেমন—কারিগর, নরসুন্দর, খুচরা খাবারবিক্রেতা, কারুশিল্পী, দুধওয়ালা, কুমার, ঝালাইমিস্ত্রি, দর্জি, কাঠমিস্ত্রির মতো বিভিন্ন কাজের ওপর নির্ভরশীল গ্রামীণ পরিবারগুলোর সমন্বিত ভাণ্ডার দ্বারা গঠিত। এদের একটি বড় অংশ একসময় কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এবং চাহিদার বৃহৎ অংশ পূরণ করত। কিন্তু এক পর্যায়ে স্বল্প উৎপাদনশীলতা ও উপার্জনের কারণে অকৃষি খাতসংশ্লিষ্ট পরিষেবাগুলোর চাহিদা কমে যায় এবং খাতটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে এর সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর জীবিকা নির্বাহ বেশ খানিকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এটি ষাট ও সত্তরের দশকে দেশে সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার আগের কথা।

গ্রামীণ বাংলার দারিদ্র্য বিমোচন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, অকৃষি খাতের উপার্জন দরিদ্রদের আয় বৃদ্ধি ঘটায়। পাশাপাশি গতিশীল খাতটি দারিদ্র্য মোকাবেলায় শক্তিশালী প্রভাব রাখার প্রস্তাব করে (লানজউ, ১৯৯৯; সেন, বি. ১৯৯৬; হ্যাগব্ল্যাড ও প্রমুখ ১৯৮৯)। পরবর্তী গবেষণাগুলো প্রকৃতপক্ষেই গ্রামীণ আয় এবং দারিদ্র্যের ওপর খাতটির ইতিবাচক প্রভাবকে নিশ্চিত করেছে (পিট ও খন্দকার; খন্দকার, খলিলি ও সামাদ,)। ২০ বছরে (১৯৯১-৯২ থেকে ২০১০-১১ সাল) দারিদ্র্যের পরিমাণ ৭৮ থেকে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং হতদরিদ্রের পরিমাণ কমেছে ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশ। যারা অকৃষি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তারা খুব দ্রুত আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করেন। কৃষির তুলনায় অকৃষির কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তদের আয় ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং দারিদ্র্য হ্রাসের পরিমাণ ছিল ৮ শতাংশ বেশি (খন্দকার; পিট ও খন্দকার)। 

পরবর্তী গবেষণায় পিট ও খন্দকার আরো দেখেছেন, এ সময়ে কৃষি খাতের আয় যেখানে ১০ শতাংশ বেড়েছে, সেখানে অকৃষি খাতের আয় বেড়েছে ৬ শতাংশ এবং অকৃষি খাতের আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেন। 

সুতরাং সবুজ বিপ্লব শুরুর পর থেকে অকৃষি খাতে বৈচিত্র্য যোগ হয় এবং খাতটির প্রসার ঘটতে শুরু করে। নতুন ধানের জাত প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে মূলত আধুনিক সেচ পদ্ধতি, জল নিয়ন্ত্রণ ও পরিপূরক বীজের ব্যবহারের জন্য নতুন ধরনের কাজ, নতুন জীবিকা ও নতুন নতুন উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে বেসরকারি এনজিও প্রদত্ত ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধা ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে পণ্য ও পরিষেবাসংক্রান্ত চাহিদাগুলোকে বাড়িয়ে তোলে। গ্রামীণ অঞ্চলে মাছ চাষ কিংবা হাঁস-মুরগি পালনের মতো উদ্যোগগুলোতে বড় অংকের বিনিয়োগের ঘটনা ঘটে। সেচকার্য ও কৃষিকাজের জন্য যন্ত্র ব্যবহারের প্রচলনও শুরু হয়।

নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রসার মূল শহরের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রয়েছে, এমন অঞ্চলের অধিবাসীদের অকৃষিকাজের প্রতি ঝুঁকতে উৎসাহ জোগায় (ডিচম্যান ও প্রমুখ)। নগর শিল্পে শ্রমশক্তির চাহিদা বৃদ্ধির ফলে নগরের সঙ্গে গ্রামীণ অঞ্চলগুলোর ঘনিষ্ঠতা ও যোগাযোগ বেড়ে যায়। শহরে কর্মরত শ্রমিকেরা বিদেশে কর্মরত প্রবাসী শ্রমিকদের মতোই গ্রামগুলোতে তাদের পরিবারের কাছে অর্থ প্রেরণ করতে শুরু করলে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্সপ্রবাহে বৃদ্ধি ঘটে। অন্যভাবে বললে, গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব অর্থপ্রবাহ ঘটে যা বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও মজুরিকে উদ্দীপ্ত করে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (যেমন—অটোমেটিক রাইস মিল, কোল্ডস্টোরেজ, সারাইখানা ও আধুনিক খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প) ও নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে তাত্পর্যপূর্ণ পরিবর্তন যোগ করে এবং অকৃষি খাতের প্রসার ঘটায়। অকৃষি খাতের অবদানের বিষয়টি অবশ্য সমকালীন উন্নয়ন আলাপে কমই উল্লিখিত হতে দেখা যায়। সুতরাং নিবন্ধটিতে আমি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গ্রামীণ কর্মসংস্থান, বিশেষ করে গ্রামের নারীদের কর্মসংস্থান, মজুরি ও আয় বৃদ্ধিতে অকৃষি খাতের ঐতিহাসিক ভূমিকার বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করব।

অকৃষি খাতে কর্মসংস্থান

আশি ও নব্বইয়ের দশকের সময়ে অকৃষি খাতের বিকাশের গতি ছিল শ্লথ, ১৯৮৩-৮৪ ও ১৯৯০-৯১ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ (ভার্মা ও কুমার, ১৯৯৬)। তবু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে খাতটি বড় ধরনের অবদান রাখে। উদাহরণসরূপ, ১৯৮১-৮২ সালে মানিকগঞ্জের দুটি গ্রামের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, গ্রামের ৩৩ শতাংশ পরিবারই অকৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত (রহমান ও ইসলাম ১৯৮৫)। যা-ই হোক, কৃষিজমি আছে ও কৃষিজমি নেই, এমন পরিবারগুলো উভয়ই কৃষি ও অকৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত, যদিও পরিমাণের ভিন্নতা রয়েছে। জমির মালিকানাধীন খামার পরিবারগুলো বেশির ভাগই স্বনির্ভর, যদিও খামারহীন পরিবারগুলো আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি বৃহৎ পরিসরে মজুরিভিত্তিক কাজের সঙ্গেও জড়িত। সুতরাং আশির দশকের শুরুর দিকে অধিকাংশ গ্রামীণ পরিবারই (প্রায় ৭০ শতাংশ) ছিল স্বনির্ভর। কেননা ভূমিহীন কিংবা খামারহীন পরিবারগুলো সাধারণত মজুরিভিত্তিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল (মাহমুদ, ডব্লিউ রহমান ও ইসলাম ১৯৮৫)। 

জাতীয় পরিসংখ্যান অকৃষি খাতের গুরুত্বকে নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ও ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইআরআরআই) গবেষণা অনুসারে, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ১৯৮৭-৮৮ সালে অকৃষি খাতের অবদান ছিল ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ (হোসাইন ও প্রমুখ)। যদিও আদমশুমারির তথ্যানুযায়ী ১৯৮১ সালে এটি ছিল ৩২ দশমিক ৬ ও ১৯৯১ সালে ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ। তবে শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যের সঙ্গে বিআইডিএস-আইআরআরআইয়ের জরিপের মিল দেখা যায়। শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে ১৯৮৩-৮৪ সালে এটি ছিল ৩৪ দশমিক ৩ ও ১৯৯০-৯১ সালে ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশ (মাহমুদ, ডব্লিউ)।

সুতরাং আশির দশকের শেষ দিকে অকৃষি খাতের কর্মসংস্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি শুরু হয়, ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগে যা বেড়ে প্রায় ৪৫ শতাংশে পৌঁছে (বিআইডিএস-আইআরআরআইয়ের খানা জরিপ, হোসাইন ও প্রমুখ)। অনুপাতের পরিমাণ কিছুটা কম হলেও শ্রমশক্তি জরিপেও অনুরূপ প্রবণতা দেখা যায় (১৯৮৪-৮৫ সালে ৩৪ ও ১৯৯৫-৯৬ সালে প্রায় ৪০ শতাংশ)। যা-ই হোক, অন্যান্য অকৃষিকাজ সামান্য পরিমাণে বাড়লেও খামারহীন কর্মসংস্থান কাঠামো অপরিবর্তিত রয়েছে (টেবিল-১)।

নিচের টেবিলের তথ্যগুলো বেশ আকর্ষণীয়: প্রথমত, শস্য কৃষিতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ রাতারাতি কমে যায় (১৯৮৭-৮৮ থেকে ১৯৯৪-৯৫ সাল), যদিও অকৃষিতে বাড়ে; দ্বিতীয়ত, কৃষির অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সর্বোচ্চ বৃদ্ধি নিবন্ধিত হয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা ছিল ১০ শতাংশেরও বেশি। এর নেপথ্যে অনুঘটক হিসেবে


তবে নিচের সারণি ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে অকৃষি খাতের অবস্থা সম্পর্কে আরো বিশদ তথ্য সরবরাহ করে। সে সময় প্রত্যাশানুযায়ী ব্যবসা ও পরিষেবাসংক্রান্ত কাজের পরিধি বেড়ে যায়। বিশেষ করে হস্তচালিত তাঁত। ব্যবসার তুলনায় এটি ২৫ শতাংশ বেশি অবদান রাখে। অবশ্য এক দশক পর উত্পাদন দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সাময়িক অর্থ সাহায্য দিয়ে যন্ত্রচালিত তাঁত স্থাপন সত্ত্বেও আমরা তাঁত শিল্পের কার্যত বিলুপ্তি দেখব।




কাজ করেছে হাঁস-মুরগি পালন, গরুর খামার ও মৎস চাষ—এর মাধ্যমেই রাতারাতি এ বৃদ্ধি ঘটে। তৃতীয়ত, ‘অকৃষি খাত’-এর প্রবৃদ্ধি ‘অন্যান্য অকৃষি খাত’ বিশেষ করে গ্রামীণ শিল্প, হস্তচালিত তাঁত শিল্পে স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। 

 ১৯৯৫-পরবর্তী অকৃষি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রবণতা বাড়তে থাকে (টেবিল-১)। ২০১০ সাল নাগাদ কৃষি খাতের কর্মসংস্থানের পরিমাণ ৫৫-৬০ শতাংশ কমে যায়। যার বেশির ভাগের জন্যই দায়ী শস্য উপখাত, যদিও শস্যবহির্ভূত কৃষি খাত শ্রমবাজারে তার অংশগ্রহণকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে অকৃষি খাতের অবদান বেড়েছিল ৫ শতাংশেরও বেশি।

ধারাটি অব্যাহত রয়েছে—পরবর্তী বছরগুলোতে বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রম জরিপ (২০১৬-১৭) অনুযায়ী, কৃষি কর্মসংস্থান (চাষাবাদ, বনায়ন ও মৎস্য চাষ) মোট পল্লী কর্মসংস্থানের ৪১ দশমিক ২ শতাংশ, নারী কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যা ৬৩ শতাংশ। এর মানে ২০১৬-১৭ সালে অকৃষি খাতের অবদান ছিল ৫৮ দশমিক ৮ শতাংশ—২০১০ সাল থেকে যা ব্যাপক হারে বেড়েছে—কৃষি কর্মসংস্থানের তুলনায় তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছ গ্রামীণ অকৃষি খাতের ১৩ শতাংশ অবদান।

অন্যভাবে বললে গ্রামীণ অঞ্চলে অধিকাংশ কৃষিনির্ভর কর্মসংস্থান সুস্পষ্টভাবেই অকৃষিকাজের দিকে চলে গেছে। এটি গ্রামীণ শ্রমবাজারে কাঠামোগত পরিবর্তনের কথা বলে, যা সম্ভবত জীবিকা ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পুনর্বিন্যাসের প্রতিফলন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ পরিবর্তনের অনুঘটক কী এবং প্রকৃতপক্ষে এগুলো ‘ইতিবাচক’ নাকি ‘নেতিবাচক’। এটি কর্মসংস্থান ও উচ্চমজুরি/আয়ের দিকে পরিচালিত করে, সেক্ষেত্রে এটি উচ্চ উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। বিকল্প বিষয়টি হতে পারে, কম উৎপাদনশীলতা ও মজুরি দ্বারা চিহ্নিত গ্রামীণ অকৃষি খাত হচ্ছে এমন একটি অবশিষ্ট ক্ষেত্র, যেখানে লোকেরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য লড়াই করে, যা গ্রামীণ অঞ্চলে জীবিকার উৎস হিসেবে ভূমি থেকে দূরে সরে যাওয়া ও ভূমির গুরুত্ব হ্রাসের ইঙ্গিতও প্রদান করে এবং এমন একটি সম্ভাব্য উন্নয়ন যাত্রার নির্দেশনা দেয়, যার জন্য কোনোভাবেই কৃষিজমির ওপর নির্ভর করতে হয় না। 

গ্রামীণ অকৃষি—বহুমুখিতার ব্যাখ্যা: 

গ্রামীণ অকৃষি খাতের বিকাশ সাধিত হওয়ার পাশাপাশি এটি বর্তমানে পল্লী কর্মস্থানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। গ্রামীণ অকৃষির উত্থানের নেপথ্যের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সবুজ বিপ্লব ( শিল্পী ও প্রমুখ), ক্ষুদ্র ঋণ ও অকৃষি শিল্প (খন্দকার ও প্রমুখ), জমিনির্ভর শ্রম থেকে সরে আসা এবং অন্যান্য। ইকবাল (২০১৯ সালে) গ্রামীণ অকৃষি খাতের আয় ও কর্মসংস্থানকে ব্যাখ্যার জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন, কিন্তু এখানে রেমিট্যান্সকে তিনি তত্পর্যপূর্ণ কারণ হিসেবে খুঁজে পাননি। অন্য কথায় গবেষকেরা গ্রামীণ অকৃষি খাতের প্রসার লক্ষ করেছেন। তবে খাতটির বিকাশ সম্পর্কিত ব্যাখ্যাগুলো খুবই কম ও সামান্য প্রায়। ওপরের পর্যালোচনার ভিত্তিতে আমরা সম্ভাব্য অনুমানগুলো তুলে ধরছি।

গ্রামীণ অকৃষি খাতের আপনাআপনি বিকাশের সম্ভাবনা নেই। এটি বরং প্রকৃত খাতগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবা সরবরাহ করে প্রকৃত অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও বহুমুখিতার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সাড়া প্রদান করেছে। সুতরাং সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন ইনপুট ও পরিষেবার জন্য বাণিজ্য, উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, যানবাহন এবং অন্যান্য কাজের চাহিদা তৈরি হয়। সেচ পাম্প সংগ্রহ, জমিতে বসানো, রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সার ও কীটনাশকের চাহিদা বাড়ে। তাছাড়া এ ইনপুটগুলোর সম্পূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্গলটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একইভাবে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, নিড়ানি যন্ত্র ও ফসল কাটার যন্ত্রের চাহিদা বেড়ে যায়—বিক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ-পরবর্তী পরিষেবা, সংগ্রহ, বিতরণ, সংশোধন জাতীয় কার্যক্রমগুলো কর্মসংস্থান ও জীবিকার জন্য অনেক নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে। একইভাবে সেচ সারঞ্জামকে (সাধারণত কৃষি যন্ত্রপাতি) ঘিরে নতুন ধরনের শিল্প গড়ে ওঠে, যা ভাড়া বা লিজ মার্কেটের উত্থান ঘটায়। 

সবুজ বিপ্লব ছাড়াও বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চল আরো কয়েকটি ‘বাঁকবদল’ প্রত্যক্ষ করলেও এগুলো তেমন আলোচিত হয়নি। জলাশয়ে মৎস্য চাষের মাধ্যমে সংঘটিত ‘ব্লু রেভল্যুশন বা নীল বিপ্লব’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবদান রাখে (টেবিল-২)। আবারো, অ্যাকুয়াকালচারের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ অকৃষি খাতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের উন্মেষ ঘটে, যেমন—মৎস্য অহরণ, প্রক্রিয়াকরণ, কেনাবেচা ও সরক্ষণ করা। হাঁস-মুরগি পালন, দুগ্ধ খামার, মাশরুম, ফুল, ফল চাষ (দেশী-বিদেশী) ও হর্টিকালচারের ক্ষেত্রেও একই রকম সাফল্যের খবর পাওয়া যায়—প্রকৃতপক্ষে জলবিদ্যুৎ ও গ্রিনহাউজের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক কৃষির উত্থানও সংঘটিত হয়েছে—যদিও এগুলো এখনো প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। প্রকৃত অর্থনীতিতে এ ধরনের প্রকৃত পরিবর্তনগুলোর সবুজ বিপ্লব চলাকালীন আমরা যা দেখেছি তার সঙ্গে নীতিগতভাবে অনুরূপ, সঙ্গে গ্রামীণ অকৃষি খাতের কর্মসংস্থান, আয় ও প্রবৃদ্ধির সংযোগ রয়েছে। প্রকৃত খাতগুলোতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স, পল্লী ব্যাংকিং ও ক্ষুদ্র ঋণসহায়তা সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রদত্ত সুযোগগুলো গ্রামীণ অঞ্চলে তারল্যের মাধ্যমে আরো সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। সুতরাং গ্রামীণ অকৃষি খাত সরাসরি রেমিট্যান্সের সঙ্গে সংযুক্ত না হলেও অপ্রত্যক্ষভাবে এটি প্রকৃত খাতকে উদ্দীপ্ত করে। ফলে গ্রামীণ অকৃষি খাতের পরিষেবা ও ইনপুটগুলোর চাহিদা বেড়েছে। এ-সংক্রান্ত কিছু বুনিয়াদি তথ্য বক্সে উত্থাপন করা হলো।

শস্য খাতবহির্ভূত প্রকৃত অর্থনীতির উত্থান

ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) অবদানকে মোটেই উপেক্ষা করা যাবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা, স্কুল, সড়ক, বাজার নির্মাণ, গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন ও বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন ইত্যাদিতে বিনিয়োগ অকৃষি খাতকেন্দ্রিক নানা ধরনের কার্যক্রম সৃষ্টি করে। এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প, চালকল, আড়ত, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক এবং এ-সম্পর্কিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম, পরিবহন ও নির্মাণ সংস্থায় ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ও ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র নারীদের লক্ষ্য করে কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎস হিসেবে প্রচলিত এনজিও পরিচালিত কার্যক্রমের সঙ্গে যোগদান করে। সুতরাং গবেষকদের খুঁজে পাওয়া তথ্যগুলো মোটেই আকস্মিক কোনো ঘটনা নয় যে গ্রামীণ স্বকর্মসংস্থান (কৃষি ও অকৃষি) বর্তমানে আকৃষি খাতের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ধরন হিসেবে বেতনভিত্তিক কাজের পথ তৈরি করেছে, যা গ্রামীণ আয়ের ভবিষ্যবাচ্যতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। এভাবে বিভিন্ন শক্তি একীভূত হয়ে কৃষিকে গতিময় করার জন্য কাজ করে। ফলসরূপ একটি গতিশীল অকৃষি খাত তৈরি হয়। উন্নয়ন অর্থায়ন মারাত্মকভাবে বিকল ও বৈদেশিক সহায়তার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল থাকায় প্রথম দশকগুলো কঠিন ছিল। রফতানি ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে সঞ্চয় বাড়িয়ে দেশীয় সম্পদ দিয়ে এটিকে প্রতিস্থাপন করা হয়—অবশেষে ১৯৮০-এর দশকে এক অসাধ্য সাধিত হয়—স্বল্প সঞ্চয় ও অপর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দরিদ্র ও সমৃদ্ধির (টুইন ডেভেলপমেন্ট গ্যাপ) মাঝখানের ব্যবধান কমাতে সক্ষম হয়। 

সম্মুখে অগ্রসর

বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার উপায় হলো তুলনামূলক সুবিধাজনক ক্ষেত্রগুলোতে প্রযুক্তি ব্যবহার ও প্রয়োগ করা। আমরা তরুণ ও ঝুঁকি গ্রহণে ইচ্ছুক—অন্য কথায় আশীর্বাদস্বরূপ আমরা একটি তরুণ জনগোষ্ঠী পেয়েছি, যারা দেশকে উন্নয়নের পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতে সমর্থ। কৃষিক্ষেত্র ও অকৃষি খাতে নিশ্চিতভাবে উচ্চমূল্যের কৃষি উৎপাদনের মধ্যে যা নিহিত, এ লক্ষ্যে প্রযুক্তির পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য মানব পুঁজিতে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। একই সময়ে আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাকে অবশ্যই ক্ষুদ্র পল্লী উদ্যোক্তা ও আধুনিক কৃষকদের দাবিগুলোর সমাধান করতে হবে, যা খুব একটা সহজ নয়। নতুন ফিনটেকের উত্থান ও আউটরিচ ইস্যুগুলো শিগগিরই শেষ করা উচিত, এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ উৎসাহের প্রয়োজন পড়বে।

চলমান কভিড পরিস্থিতিতে আমাদের প্রতিটি সেক্টরের উন্নয়ন কৌশলগুলোকে এখন পুনর্বিবেচনা ও পর্যালোচনা করা জরুরি। কভিড আমাদের গুরুত্বপূর্ণ যে শিক্ষাটি দিয়েছে তা হলো কৃষি ও অকৃষি খাতকে মোটেই উপেক্ষা করা যাবে না, প্রকৃতপক্ষে সংকটের মুহূর্তগুলোতে। খাতগুলো স্পষ্টই গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে একটি নির্দিষ্ট স্থিতিস্থাপকতা ও স্থিতিশীলতা সরবরাহ করে, যা আমাদের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ধাক্কা সহ্য করতে সক্ষম করে। ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কৌশলগুলোতে অবশ্যই আধুনিক, উচ্চমূল্যের কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, সঞ্চয় ও বিপণনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে, কভিড-পরবর্তী বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য যা হবে যৌক্তিক পদক্ষেপ।


ড. কেএএস মুরশিদ: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫