দুধভাত ও দারিদ্র্য দর্শন

প্রকাশ: অক্টোবর ১৩, ২০২০

আব্দুল বায়েস

এক।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘দুধভাতে উৎপাত’ গল্পে অসুস্থ জয়নাবের খুব ইচ্ছা হয় দুধভাত খেতে। তার ইচ্ছাটা গরিবের ঘোড়ারোগ নয়—মামুলি একটা শখ। অবশ্য, জয়নাবের একটা গাভী ছিল, কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে ওটা হাতছাড়া হয়ে যায়। যখন গাভী ছিল তখন দুধের বিনিময়ে চাল কিনে আনতে হতো, সেও তো কথা। ওখানেও পেট্রোন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক থাকতেও পারে—শুধু আমার কাছে দুধ বিক্রি করবে এবং শুধু আমার কাছ থেকে চাল কিনবে। কিন্তু লেখক যেহেতু কোনো ইঙ্গিত রাখেননি, তাই সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই। জয়নাবের ঘরে দুধ ও ভাত দুটোরই প্রকট অভাব দেখা দিয়েছিল—দেড় পোয়া দুধের সঙ্গে দেড় সের চালের ভাত গুড় ও সবরি কলা দিয়ে মেখে সাতজনে খেত; জয়নাবের জন্য বরাদ্দ থাকত শেষ দুই লোকমা। যা-ই হোক, একসময় দুধভাত চাওয়ার অপূর্ণতা নিয়ে শেষযাত্রা করে জয়নাব।

দুই।

বাংলাদেশে এখন ভাতের অভাব নেই বললেও চলে—এমনকি ক্রয়ক্ষমতা কিংবা এনটাইটেলমেন্ট নিরিখে দেখলেও। কখনোসখনো চালের দাম চাঙ্গা থাকে, তবে প্রকৃত মজুরি সমন্বয় করে কিংবা খোলাবাজারে সরকারি কম দামি চাল কিনে গরিব কোনোমতে দুমুঠো অন্নের সংস্থান করে। দুধের অভাব আছে, তবে আগের মতো অত প্রকট নেই। গ্রামের জয়নাবরা এখন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গাভী কেনে, একাধিক গাভীর দুধ বাজারজাত করে, ফাঁকফোকরে একটুআধটু নিজে খায় এবং অন্যদের খাওয়ায়। বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রতিটি খানায় গড়পড়তা একাধিক গবাদি প্রাণী আছে। তবে ওই যে কথায় আছে, ‘এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে, এই দিন নিয়ে যাবে সেদিনের কাছে’—ব্যক্তিমালিকানার কারখানাগুলো বাড়ি বয়ে এসে দুধ নিয়ে যায় চিলিং সেন্টারে।

প্রায় চার কোটি টন খাদ্যশস্য (চাল সাড়ে তিন কোটি) দেশে উত্পন্ন হয় বলে শুনছি; বর্তমানে খাদ্যশস্যের বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি বিধায় ম্যালথাসের দুঃস্বপ্ন বাস্তব হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই বললেই চলে। তার ওপর সুখবর যে খানাপিছু চালের ভোগ নিম্নমুখী। অবশ্য এই আলোকিত ঘটনার অন্ধকার দিকটা হচ্ছে এই যে প্রান্তিক উন্নতি ঘটা সত্ত্বেও অপুষ্টিজনিত অবস্থা এখনো চরম উদ্বেগের বিষয়।

দুর্ভাগ্যবশত, গ্রামীণ বাংলার কৃষি খাতের ইতিহাস ও গবেষণা মূলত চালকেন্দ্রিক। তা যেকোনো কারণেই হোক—কবির কথা ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ অথবা হুংকার, ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো’ কিংবা ম্যালথুসিয়ান দুঃস্বপ্ন। এমন ঘোরে পতিত আমাদের চিন্তাচেতনায় চালকের আসনে বসে থাকে স্বয়ং চাল। এখনো চাল নিয়ে যত চুলচেরা বিশ্লেষণ বা কাগজ চালাচালি হয়, অন্য কোনো পণ্যের বেলায় তা হয় না। প্রধান খাদ্য বলে কথা। চাল আমাদের প্রধান খাদ্য এবং বিশেষত দরিদ্র শ্রেণী আয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় করে চাল ক্রয়ে। এ দেশের রাজনীতি ভাতের রাজনীতি বললেও বোধ করি ভুল হবে না।

তিন।

কিন্তু সময়ের বিবর্তনে, বিশেষত গ্রামীণ খানার আয়বর্ধনে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষি খাতকে টপকে যেতে লাগল অকৃষি খাত। একটা গবেষণা বলছে, ১৯৮৮ সালে একটা গ্রামীণ খানার গড়পড়তা আয় ছিল ১৫৭ ডলার, যেখানে খানার মোট আয়ের কৃষির অবদান প্রায় ৬০ ভাগ। এর বিপরীতে ২০১৪ সালে আয় দাঁড়ায় ৫৩১ ডলার এবং কৃষির অবদান নেমে আসে প্রায় ৪০ ভাগে। অন্য কথায়, এখন গ্রামীণ খানার মোট আয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অবদান রাখে অকৃষি কর্মকাণ্ড যথা ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা, বাইরে থকে প্রেরিত অর্থ, অকৃষি মজুরির বিনিময়ে আয় ইত্যাদি। একটা নির্দিষ্ট উদাহরণ দেয়া যাক, ভিত্তি বছরে গ্রামীণ খানার মোট আয়ের মাত্র আট ভাগ আয় আসত রেমিট্যান্স থেকে আর এখন আসে মোট আয়ের ৩০-৪০ ভাগ।

চার।

এর জন্য ধন্যবাদ পাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যার ফলে গ্রামীণ ব্যাবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক বিস্তৃতি সম্ভবপর হয়েছে। এখন নিজের গাড়ি নিয়ে নিজ গ্রামে যাওয়া যায়—পরিবহনের সময় অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে।

...সে কাল আর নাই। কালের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। মাঠের বুক চিরিয়া রেললাইন পড়িয়াছে। তার পাশে টেলিগ্রাফ তারের খুঁটির সারি। বিদ্যুৎ শক্তিবহ তারের লাইন। মেঠোপথ পাকা হইয়াছে। তাহার উপর দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে মোটর বাস ছুটিতেছে। নদী বাঁধিয়া খাল কাটা হইয়াছে। লোকে হুক্কা ছাড়িয়া বিড়ি সিগারেট ধরিয়াছে। কাঁধে গামছা, পরনে খাটো কাপড়ের বদলে বড় বড় ছোকরারা জামা, লম্বা কাপড় পড়িয়া সভ্য হইয়াছে। ছ-আনা দশ-আনা ফ্যাশনে চুল ছাঁটিয়াছে। ভদ্র গৃহস্থের হালচাল বদলাইয়াছে (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রাইকমল)।

ফলে কৃষি-অকৃষি খাতের গতিময়তা ও আধুনিকীকরণ, গ্রাম-শহর অভিবাসন বেড়েছে; বাজারগুলো সম্পৃক্ত হয়েছে এবং ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়ের উদ্বৃত্ত বেড়েছে। অকৃষি কর্মকাণ্ড বিস্তারে সড়ক, বিদ্যুৎ আর টেলিযোগাযোগের ভূমিকা বলা বাহুল্য: 

...এ কি কেবলই সড়ক! একটা নতুন জীবনেরো রাস্তা—সুখ আর সমৃদ্ধির। রাস্তা দিয়া তরিতরকারি যায় এমনকি থানকুনিপাতা এখানে বনে বাদাড়ে আজন্ম জন্মায় কেহ ফিরিয়াও দেখে না শহরে তাহাতেও পয়সা। ধীরে ধীরে গ্রামের সব বস্তুই শহরমুখী হয়। অধিক অর্থ উপার্জনের জন্যে মানুষ ব্যস্ত হইয়া পড়ে; গ্রাম-শহর দৌড়াদৌড়ি লাগিয়া যায় (শামসুদ্দিন আবুল কালাম, পথ জানা নেই)।

পাঁচ।

গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান প্রধানত কৃষি উপকরণ, কৃষি উৎপাদন, গবাদিপশু, মাছ, বন, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, নির্মাণ, পরিবহন, রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড ঘিরে আবর্তিত। অকৃষি কর্মকাণ্ডের অনেকগুলো খুব কম উৎপাদনশীল বলে মজুরি কম। কিন্তু তাতে কী? সামথিং ইজ বেটার দ্যান নাথিং। যা-ই হোক, কৃষি উৎপাদন ও উপকরণ সম্পর্কিত ব্যবসা একাই মোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের তিন ভাগের এক ভাগ। গবাদিপশু, মাছ আর বনজাতীয় অকৃষি কর্মকাণ্ড নিয়ে আরো ১৭ ভাগ প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলের প্রায় ৬০ ভাগ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কৃষিকেন্দ্রিক। সুতরাং গ্রামীণ আয় উৎসারণে কৃষির চেয়ে অকৃষির অবদান বেশি বলে যারা দাঁত কেলিয়ে হাসে অন্তত তাদের জানা উচিত যে কৃষি বাঁচলে অকৃষি বাঁচবে, অকৃষি খাতের অস্তিত্ব নির্ভর করছে কৃষি খাতের উন্নতির ওপর। তবে এ কথাও ঠিক, কৃষি খাতের গতিময়তা, আধুনিকীকরণ সম্পূর্ণ নির্ভরশীল অকৃষি খাতে থাকা পরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির ওপর। বলা ভালো, কৃষি-অকৃষি হলো একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। 

ছয়।

এবার দুধ নিয়ে দু-চার কথা। গেল দশকে দুধ উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছে। বার্ষিক উৎপাদন প্রায় দেড় কোটি টন, যার প্রায় ৯৭ শতাংশ গ্রামের এবং ৮৩ শতাংশ অবাণিজ্যিক খামারের দুধ। মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ এখন আমদানি করতে হয়। বস্তুত পাউডার দুধ আমদানির আগ্রাসনে দেশী দুধ নির্বাসনে যাওয়ার উপক্রম। বাংলাদেশে ডেইরি ফার্মের সংখ্যা ১২ লাখের মতো. যেখানে প্রায় এক কোটি লোক কর্মরত। এই উপখাতে মোট বিনিয়োগ ১ লাখ কোটি টাকার মতো। বাংলাদেশে গড়পড়তা মাথাপিছু দুধপ্রাপ্তি প্রতিদিন ১৬৫ মিলিলিটার, যেখানে সুপারিশকৃত ২৫০ মিলিলিটার। মনে রাখা দরকার যে খাদ্য প্রক্রিয়া খাত বাংলাদেশের ম্যানুফাকচারিং খাতের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ—মোট ম্যানুফ্যাকচারিং উৎপাদনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ, প্রায় সমভাগ ম্যানুফ্যাকচারিং শ্রমশক্তির ও জিডিপির ২ শতাংশ। তার চেয়ে বড় কথা, বিশেষ করে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির খামারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামার বেশি।

এক সময় এই গ্রামবাংলায় গোয়ালঘর আর পুকুর দেখে আভিজাত্য নির্ণয় করে আত্মীয়তা করা হতো। আজকাল যান্ত্রিক চাষের কল্যাণে এবং মাঝারি ও বড় চাষী কৃষিকাজ ছেড়ে অকৃষিতে যাওয়ার ফলে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণীর হাতে গবাদিপশু তথা দুধের জোগান। গ্রামবাংলায় একটা-দুইটা গাভী পরিচর্যা করে দুধ বিক্রি করে সংসারের আয় বাড়ায় নারী। দুধ বিক্রির অর্থ দিয়ে সে তার ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খরচ চালায়। সুতরাং গবাদিপশু উপখাতের উন্নয়ন মানে দরিদ্র নারীর উন্নয়ন তথা ক্ষমতায়ন।

আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে (Let my children have enough rice and milk for their meals)—এই অমোঘ বাণী বাস্তবে রূপ দিতে হলে সরকার ও ব্যক্তি খাতকে তাদের চলমান ভূমিকা আরো বেগবান করতে হবে। দেশে দুধ পাউডার করার কোনো কারখানা নেই বলে আমদানির পেছনে বিপুল ব্যয় করতে হচ্ছে। আমদানি বিকল্প ডেইরি শিল্পের মাধ্যমে দেশে ‘সবুজ’ বিপ্লবের মতো একটা ‘সাদা’ বিপ্লব ঘটাতে হলে আটঘাট বেঁধে নামতে হবে। মিল্ক ভিটা, প্রাণ, আড়ং ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান মোট উৎপাদনের মাত্র ১০-২০ ভাগ সংগ্রহ করে। বাকি সিংহভাগ প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় খোলাবাজারে যায় যেখানে উৎপাদক অসহায়।

দারিদ্র্য দর্শনে বাংলাদেশের দুধ উৎপাদনকারী ক্ষুদ্র খামারি বা দরিদ্র নারীর কথা ভুলি কীভাবে? ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীর ওপর যেমন আমার ভাত নির্ভর করে, তেমনি দরিদ্র গৃহস্থের ওপর নির্ভর করে আমার দুধ পান। এখন এই বাংলাদেশে স্মল ইজ বিউটিফুল—এমনকি করোনাকালেও।


আব্দুল বায়েস: প্রাক্তন উপাচার্য ও অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে খণ্ডকালীন শিক্ষক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫