আমিষের উৎপাদন বাড়লেও কমেছে মাথাপিছু প্রাপ্তি

এসডিজি অর্জনে অপুষ্টির হার কমানো কঠিন হয়ে পড়বে

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০

গত দুই দশকে বাংলাদেশ দ্রুত উচ্চহারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে অনেক মানুষ চরম দরিদ্রতা থেকে বের হয়ে এসেছে। একই সময়ে কৃষিক্ষেত্রে লক্ষণীয় সফলতা অর্জন এবং ধান উৎপাদনে স্বয়সম্পূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো উচ্চমাত্রার অপুষ্টি খাদ্য ঝুঁকিতে আছে। গত এক দশকে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে সত্য, কিন্তু এর গতি অত্যন্ত ধীর। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে আমিষের উৎপাদন ২৫০ শতাংশ বাড়লেও মাথাপিছু ভোগে তার প্রতিফলন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দুধের মতো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি আমিষের ভোগ কমেছে গত এক দশকে। মাংসের ভোগ বাড়লেও খুবই সামান্য, যা উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এছাড়া প্রাণিজ আমিষের দামও বেশি। এসবের হিসাব মেলানো কঠিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী মানবদেহের শক্তির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আসা উচিত আমিষজাতীয় খাদ্য থেকে। এই আমিষের ২০ শতাংশ আসতে হবে প্রাণিজ আমিষ থেকে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই এই আমিষের ৫০ শতাংশই আসে প্রাণিজ উৎস থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু আমিষ পরিভোগের পরিমাণ ৮৩ গ্রাম, যার ৬৭ শতাংশই প্রাণিজ আমিষ। দেশে প্রাণিজ উৎস থেকে ক্যালরিপ্রাপ্তির পরিমাণ শুধু বৈশ্বিক গড় নয়, প্রতিবেশী অনেক দেশের চেয়েও কম। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বাড়লেও পরিভোগ কম হওয়ার কারণ চিহ্নিত করা জরুরি। আমিষজাতীয় বেশকিছু পণ্যের উৎপাদনে বেশ সফলতা এলেও দাম না কমে বেড়েছে। ফলে তা সাধারণ ভোক্তাদের বড় একটি অংশের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। কারণে কম আয়ের মানুষ প্রয়োজনমতো আমিষজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। আমিষজাতীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ততক্ষণ অর্থবহ হবে না, যতক্ষণ তা সাধারণ ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না আসে। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বেঁচে থাকা, যথাযথ বিকাশ উন্নয়নের জন্য পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শৈশব কৈশোরের দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি উচ্চতা বৃদ্ধি মস্তিষ্কের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে পরবর্তী সময়ে এরা মেধা, উৎপাদনশীলতা কর্মদক্ষতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে। পুষ্টিহীনতা দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিরও অন্তরায়। দেশকে এগিয়ে নিতে দক্ষ মানবসম্পদের বিকল্প নেই।

সময়ের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যনিরাপত্তা ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খাদ্য পুষ্টি বিষয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিসর অনেকটাই বিস্তৃত হয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কিংবা আমদানির মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য সরবরাহ বা প্রাপ্যতার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো। ওয়ার্ল্ড ফুড সামিটে অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য সরবরাহ এবং তার মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার ওপর জোর দেয়া হয়। সরবরাহ বৃদ্ধির পদ্ধতিকে ঘিরে খাদ্যনিরাপত্তার কৌশলটির সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচনা করেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেন জোর দিয়ে বলেছেন, খাদ্যনিরাপত্তার জন্য শুধু উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়, সব মানুষের খাদ্যের ওপর নিজেদের স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করতে তাদের সেই খাদ্যের ওপর এনটাইটেলমেন্ট অর্জন অপরিহার্য। এমনও হতে পারে, কোনো খাদ্য ঘাটতি না থাকলেও সেখানকার জনগোষ্ঠী খাদ্য অনিরাপত্তার শিকার হতে পারে এনটাইটেলমেন্ট না থাকার কারণে। তাই খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি কেবল খাদ্যের লভ্যতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সবসময় সর্বস্তরের মানুষের ভৌত আর্থিকভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মৌলিক খাদ্যপ্রাপ্তির ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।

দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং এদের একটি অংশ অতিদরিদ্র। এরা অসহায় দুস্থ। অতিদরিদ্রদের একটি অংশ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ওপর নির্ভরশীল, যদিও কর্মসূচি থেকে প্রাপ্ত সাহায্য তাদের জীবনধারণের খুব কম চাহিদাই মেটাতে পারে। বিশেষ করে কর্মসূচির আওতাবহির্ভূত অতিদরিদ্রদের বৃহত্তর অংশটি ক্ষুধা চরম পুষ্টিতে ভোগে। বাংলাদেশের জাতীয় খাদ্যনীতির আওতায় খাদ্যনিরাপত্তার জন্য একটি পরিশীলিত সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। এতে খাদ্যের প্রাপ্যতা, প্রবেশাধিকার ব্যবহারের মাত্রা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের সব মানুষের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা নীতির প্রধান লক্ষ্য। এর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে নিরাপদ পুষ্টিকর খাবারের স্থিতিশীল সরবরাহ, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের খাদ্য অভিগম্যতা বৃদ্ধি এবং সবার জন্য বিশেষ করে নারী শিশুদের পুষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করা। নীতিমালায় খাদ্যের লভ্যতা, অভিগম্যতা পুষ্টিমানের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের দিকে বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। আমরা চাইব, নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্য উৎপাদন বণ্টনে জোর দেয়া হবে। অপুষ্টি রোধে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের সরবরাহ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি চাহিদা বৃদ্ধিতে আরো বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ সংকট দূর করে সেগুলো দ্রুত ভোক্তাদের কাছে সহনীয় মূল্যে পৌঁছাতে হবে।

প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর প্রাপ্তিও নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রথমেই এর দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হবে বা আয় বাড়াতে হবে। সন্দেহ নেই, দারিদ্র্য হ্রাস, সম্পদ বৃদ্ধি শিক্ষিত মা-বাবার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ার ফলে গত এক দশকে পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এর গতি অত্যন্ত ধীর। তাছাড়া অপুষ্টির কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে, যেগুলো দূর করতে হলে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার বণ্টন ব্যবস্থার বৈষম্য কমাতে হবে। জনগোষ্ঠীর সব অংশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপুষ্টি সম্পূর্ণভাবে দূর করা সম্ভব হবে না। অপুষ্টির কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে, যেগুলো দূর করতে হলে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার বণ্টন ব্যবস্থার বৈষম্য কমাতে হবে। জনগোষ্ঠীর সব অংশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অপুষ্টি সম্পূর্ণভাবে দূর করা সম্ভব হবে না। এটি স্বীকৃত এবং গবেষণায় প্রমাণিত যে, পুষ্টি একটি জাতীয় সমস্যা এবং উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। জাতীয় স্বাস্থ্য তথা নারী শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে পুষ্টির ভূমিকা অনস্বীকার্য। যদি একটি উন্নত কর্মক্ষম জাতিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হয়, তবে পুষ্টিহীনতা দূর করা আবশ্যক। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) ২০২৫ সালের মধ্যে অপুষ্টির হার ২৭ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। পুষ্টিসেবার ব্যাপ্তি, মান পুষ্টি আচরণে উন্নতি দরকার।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫